গ্রিড লাইন নির্মাণে কচ্ছপ গতি। পিছিয়ে যাচ্ছে উৎপাদনের সময়সীমা। আটকে রয়েছে ঋণ পরিশোধও। আগেই মাত্রাতিরিক্ত খরচ, পরিচালনা, নিয়োগ, পদোন্নতিসহ নানা অনিয়মে প্রশ্নবিদ্ধ পাবনার ঈশ্বরদীর ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প’। এখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

২০১১ সালের প্রকল্পে কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতা করছে রাশিয়া। চূড়ান্ত হস্তান্তরের সময় ২০২৫ সালের ১৭ অক্টোবর থাকলেও, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৭ সাল করা হয়। দুই ইউনিটের প্রকল্প বাস্তবায়নে ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলার ব্যয় ধরা হয়, যার ৯০ শতাংশ ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজে ব্যয় হবে আরও ২০০ কোটি ডলার। ২০১৭ সালের এপ্রিলে প্রকল্পে যুক্ত হয় ভারত। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা চুক্তি হয়। ওই বছরের ৩০ নভেম্বর প্রথম ইউনিটের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এশিয়ায় সবচেয়ে ব্যয়বহুল
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) তথ্য, ভারত, রাশিয়া, তুরস্ক, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি কিলোওয়াট নির্মাণে খরচ গড়ে ১ হাজার ৫৫৬ থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৮১ ডলার। কিন্তু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় ৫ হাজার ৮৯০ ডলার। রাশিয়ার সর্বাধুনিক ভিভিআর-১২০০ প্রযুক্তিতে হচ্ছে রূপপুর কেন্দ্র। একই প্রযুক্তিতে রাশিয়ায় নির্মিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিলোওয়াটপ্রতি নির্মাণ খরচ পড়েছে ৪ হাজার ৭৫ ডলার। এমনকি রাশিয়ার রোসাটম ফিনল্যান্ড, তুরস্ক, ইরান, বুলগেরিয়াসহ কয়েকটি দেশে ভিভিআর-১২০০ প্রযুক্তিতে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হয়েছে, তার খরচ রূপপুরের চেয়ে অনেক কম। ফিনল্যান্ডে ৫ হাজার ও তুরস্কের আক্কুইউ পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি কিলোওয়াটের নির্মাণ ব্যয় ৩ হাজার ২০০ ডলার। ভারতের কুদামকুলামে রাশিয়ার ভিভিইআর-১০০০ প্রযুক্তির প্রতিটি ১ হাজার মেগাওয়াটের ছয় ইউনিটের নির্মাণ খরচ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা।

মূল প্রকল্প ব্যয়ের বাইরে আরও ১৯ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এর মধ্যে রেল মন্ত্রণালয়ের ৩৩৯ কোটি টাকার ২২ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ। বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার প্রকল্প।

বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণে খরচ হচ্ছে ১০ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। তথ্যপ্রযুক্তির জন্য নেওয়া হয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। রূপপুরের জন্য যন্ত্রপাতি আনতে নদীপথ খনন ও নাব্য রক্ষায় খরচ হচ্ছে নৌ মন্ত্রণালয়ের ৮৮২ কোটি টাকা।

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা আনু মুহাম্মদ বলেন, রূপপুর প্রকল্প দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। যাচাই-বাছাই ছাড়াই রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। কোনো জবাবদিহি ছিল না। দেশের স্বার্থেই এ প্রকল্প বন্ধের দাবি জানান তিনি।

দুর্নীতিতে হাসিনা পরিবার, তদন্তে দুদক
রূপপুর প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, রেহানার মেয়ে (সদ্য ব্রিটিশ মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ) টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধানে নেমেছে। সংস্থায় জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প থেকে ৫০০ কোটি ডলার লোপাট করেছেন হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
গ্লোবাল ডিফেন্স করপোরেশনের প্রতিবেদন বলেছে, ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সঙ্গে এ প্রকল্পের চুক্তি করেছিলেন শেখ হাসিনা। মধ্যস্থতার জন্য মোট ব্যয়ের ৩০ শতাংশ অর্থ পেয়েছেন শেখ হাসিনা, টিউলিপসহ অন্যরা। যদিও গত ১১ সেপ্টেম্বর বিবৃতিতে ঢাকার রুশ দূতাবাস রূপপুর প্রকল্পের দুর্নীতি বিষয়ে প্রচারিত সংবাদ ও তথ্য ‘বিভ্রান্তিকর’ এবং ‘মিথ্যা’ দাবি করেছে।

এক ব্যক্তির প্রকল্প
শুরু থেকে এ প্রকল্পের পরিচালক ড.

শৌকত আকবর। তাঁর নিয়োগ নিয়ে আপত্তি ছিল বিজ্ঞানীমহলের। প্রকল্প পরিচালকের পাশাপাশি তিনি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক কোম্পানি এনপিসিবিএলের এমডিও ছিলেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারির পর শৌকতকে প্রকল্পের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়। এর পর তিনি প্রকল্প পরিচালক পদ ছাড়লেও এনপিসিবিএলের এমডি রয়ে গেছেন।

সূত্র জানায়, পরমাণু শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. অশোক কুমার পাল গত বছরের ১৫ জানুয়ারি অবসরে যান। এ সময় কমিশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন সদস্য (পরিকল্পনা) ডা. শামীমা মমতাজ ফেরদৌসী এবং প্রথা মতে তাঁরই চেয়ারম্যান হওয়ার কথা। কিন্তু চেয়ারম্যান পদটি খালি রেখে ১৮ জুলাই শৌকতকে সদস্যের (ভৌত বিজ্ঞান) চলতি দায়িত্ব দিয়ে দুপুরেই চেয়ারম্যান করা হয়। সাবেক তথ্য ও বিজ্ঞান প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় জ্যেষ্ঠতার চার নম্বরে থেকে পদটি বাগিয়ে নেন শৌকত। পরে এ প্রভাব কাজে লাগিয়ে তিনি প্রকল্পে একক কর্তৃত্ব চালিয়েছেন। বিশ্বস্ত কয়েক কর্মকর্তার মাধ্যমে পুরো কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেন শৌকত। বর্তমান প্রকল্প পরিচালক ড. জাহেদুল হাছানও তাঁর আস্থাভাজন। প্রকল্পের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি পরিদর্শনে রাশিয়া যেতেন তারা দু’জন। শৌকত ও জাহেদুলের কারও পারমাণবিক বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত পড়াশোনা নেই।
জানতে চাইলে শৌকত আকবর বলেন, ‘যোগ্যতার কারণেই তৎকালীন সরকার আমাকে নিয়োগ দিয়েছে। কারও কাছে কোনো তদবির করিনি।’ প্রকল্পের কাজে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।

গ্রিড লাইন নির্মাণে বিলম্ব
ঠিক সময়ে গ্রিড লাইন নির্মাণ না হওয়ায় প্রায় দুই বছর পিছিয়ে গেছে রূপপুর কেন্দ্রের উৎপাদন কার্যক্রম। ২০২৪ সালে চালুর কথা ছিল। কিন্তু এখন ২০২৬ সালেও দেশের প্রথম পারমাণবিক কেন্দ্র চালু হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। গ্রিড লাইনে ভারত ঋণ দিতে চাইলেও, অর্থছাড়ে গড়িমসির কারণে প্রায় দুই বছর নষ্ট হয়। পরে ভারতীয় কোম্পানি গ্রিড লাইন নির্মাণেও ঢিলেমি করে। গত বছর ৫ আগস্টের পর দীর্ঘদিন কোম্পানিগুলো নির্মাণকাজ বন্ধ রাখে। আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও লাইন নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হয়।
প্রকল্পের আওতায় তিনটি সঞ্চালন লাইনের মধ্যে শেষ হয়েছে রূপপুর-বাঘাবাড়ী ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট লাইন। রূপপুর-বগুড়া ৪০০ কেভি সিঙ্গেল সার্কিট সঞ্চালন লাইনের কমিশনিং হয়েছে। আর রূপপুর-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি সিঙ্গেল সার্কিট লাইনের পদ্মা রিভার ক্রসিং অংশের কাজ বাকি রয়েছে। পাওয়ার গ্রিড অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বলেছে, চলতি বছরের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের সব কাজ শেষ হবে।

ভারতের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আপত্তি
প্রকল্পের জন্য ভারতের সঙ্গেও সহযোগিতা চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। এর আওতায় পরামর্শক সেবা ও জনবল প্রশিক্ষণে ভারতের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। চুক্তি অনুসারে নির্মাণ শেষে রূপপুর প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্ব ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের দেওয়ার কথা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের এ চুক্তি নিয়ে আপত্তি রয়েছে খাত-সংশ্লিষ্টদের। তাদের ভাষ্য, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ‘নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার্স’ গ্রুপের (এনএসজি) সদস্য নয় ভারত। অন্য দেশে পারমাণবিক বিদ্যুকেন্দ্র নির্মাণে তার অভিজ্ঞাতাও নেই। তাহলে কেন রূপপুরে ভারতীয় সহযোগিতা নেওয়া হবে? স্পর্শকাতর এ প্রকল্পে ভারতের সম্পৃক্ততা নিরাপত্তা হুমকি বলেও মনে করেন এ খাতর বিশ্লেষকরা।
সূত্র জানায়, প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখিয়ে ২০১২ সাল থেকে কয়েক দফা চিঠি দেয় ভারত। পরে ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল ৪০ বছরের পরমাণু সহযোগিতা চুক্তি করে দুই দেশ।

ঋণ পরিশোধে জটিলতা
রাশিয়া প্রকল্পের শুরুতে সমীক্ষা ও নকশার জন্য ৪৯ কোটি ডলার ঋণ দেয়। পরে মূল নির্মাণকাজে এ পর্যন্ত দেশটি ৭৩০ কোটি ডলার ছাড় করেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর আগেই বাংলাদেশ রুশ একটি ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণের সুদ পরিশোধ শুরু করে। কিন্তু রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলে আটকে যায় ঋণ পরিশোধ। বর্তমানে প্রকল্প বাবদ বাংলাদেশের কাছে রাশিয়ার পাওনা প্রায় ৮০০ কোটি ডলার। একবার চীনের মুদ্রায় শোধের আলাপ উঠলেও এগোয়নি। এখন দুই দেশ নতুন পথ খুঁজছে।

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রকল প ব প রকল প র এ প রকল প ত র জন য সহয গ ত পর শ ধ ই বছর বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

এক বছ‌রে আইন মন্ত্রণালয়ের সংস্কার, যা বল‌লেন আসিফ নজরুল

দেখতে দেখতে প্রায় এক বছর হয়ে গেল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। এ সরকা‌রের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা হি‌সে‌বে দা‌য়িত্ব পালন কর‌ছেন শিক্ষা‌বিদ ড. আসিফ নজরুল। এই এক বছরে আইন মন্ত্রণাল‌য়ের সংস্কার কার্যক্রম নি‌য়ে বৃহস্প‌তিবার (৩১ জুলাই) স‌চিবাল‌য়ে সংবাদ সম্মেলন ক‌রেন তি‌নি।

এক বছর দা‌য়িত্ব পাল‌নে মন্ত্রণাল‌য়ের আইনি সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও ডিজিটালাইজেশন, হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারসহ দৈনন্দিন কার্যক্রম সম্প‌র্কে তু‌লে ধ‌রে আসিফ নজরুল ব‌লেন, “আইন সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হি‌সে‌বে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন: আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩, সংশোধন করে আইনটিকে ন্যায়বিচারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়েছে। এই আইনে গুমকে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অভিযুক্তের অধিকার সুরক্ষা, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ এবং বিচার কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচারের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন আপিল, সাক্ষী নিরাপত্তা এবং ভুক্তভোগীর ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থাও প্রবর্তিত হয়েছে।”

“সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫: এই অধ্যাদেশ জারি করে স্বতন্ত্র জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে মেধা, সুযোগের সমতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে,” ব‌লেও জানান তি‌নি।

আরো পড়ুন:

নির্বাচন নিয়ে আসিফ নজরুল: জাস্ট ওয়েট করুন, কিছু দিনের মধ্যে ঘোষণা

দাসত্বের সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি: শিক্ষা উপদেষ্টা

তিনি বলেন, “তাছাড়া দেওয়ানি কার্যবিধিতে সংশোধন: এই সংশোধন করে দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থায় যুগান্তকারী সংস্কার আনা হয়েছে। মৌখিক সাক্ষ্যগ্রহণের পরিবর্তে এফিডেভিটের মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ, অনলাইনে সমনজারি এবং মূল মামলার অধীনেই রায় কার্যকর করার সুযোগ রাখা হয়েছে।”

ফৌজদারি আইন সংস্কার করা হ‌য়ে‌ছে জা‌নিয়ে উপ‌দেষ্টা ব‌লেন, “ফৌজদারি আইন সংশোধনের মাধ্যমে গ্রেপ্তার ও রিমান্ড প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করা হয়েছে। সেই সাথে অভিযুক্তের অধিকারের নিশ্চয়তা, জেন্ডার সংবেদনশীল শব্দ পরিহার, তদন্ত প্রক্রিয়াকে জবাবদিহির আওতায় আনা, মিথ্যা মামলার হয়রারি রোধ করাসহ বিভিন্ন সংশোধনী আনা হয়েছে।”

মামলা-পূর্ব বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার বিধান সংযোজন করা হ‌য়ে‌ছে জা‌নি‌য়ে তি‌নি ব‌লেন, “আইন সংশোধন করে নির্দিষ্ট কয়েক ধরনের মামলার ক্ষেত্রে মামলা-পূর্ব বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার এবং প্রতি জেলায় একজন স্থলে ৩ জন বিচারককে লিগ্যাল এইড অফিসে পদায়নের বিধান করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আদালতের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বাইরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিরোধের আপস নিষ্পত্তি সম্ভব হবে।”

আই‌ন সংস্কা‌রের ম‌ধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধন করা হ‌য়ে‌ছে উল্লেখ ক‌রে আসিফ নজরুল ব‌লেন, “এই সংশোধনীর মাধ্যমে তদন্ত ও বিচার শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং তদন্ত সম্পন্নে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তার জবাবদিহির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া, সাক্ষীদের সুরক্ষা, শিশু ধর্ষণ মামলার জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং পুরুষ শিশু নিপীড়নকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতিসহ বিভিন্ন যুগোপযোগী বিধান যুক্ত করা হয়েছে।”

পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বিধিমালায় সংশোধনী আনা হ‌য়ে‌ছে জা‌নি‌য়ে তি‌নি ব‌লেন, “সংশোধিত বিধিমালার আলোকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট না থাকলেও বাংলাদেশি বংশদ্ভূত ব্যক্তির পাসপোর্টে ‘নো ভিসা রিকোয়ার্ড’ স্টিকার থাকলে বা জন্ম সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেই বিদেশ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করতে পারবেন।”

“সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সাথে যৌথভাবে এই অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে পূর্বের সাইবার নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নমূলক ধারাগুলো এবং এসবের অধীনে দায়ের হওয়া মামলাগুলো বাতিল করে দেওয়া হয়েছে,” ব‌লেও জানান উপ‌দেষ্টা।

বিবাহ নিবন্ধন বিধিমালা সংশোধন করা হ‌য়ে‌ছে জা‌নি‌য়ে উপ‌দেষ্টা ব‌লেন, “বিবাহ নিবন্ধন বিধিমালা সংশোধন করে জেন্ডার বৈষম্যমূলক বিধান বাতিল করা হয়েছে। তাছাড়া, অনলাইনে বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন করার বিধান সংযোজন করা হয়েছে।”

আসিফ নজরুল জানান, আইন মন্ত্রণাল‌য়ের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও ডিজিটালাইজেশনের ম‌ধ্যে জুডিসিয়াল সার্ভিসের স্বাধীনতা, বি‌শেষ ক‌রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের পদসৃজনের ক্ষমতা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করে ‘বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫’ এবং জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের সরকারের আইন ও বিচার বিভাগে পদায়নের সুনির্দিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

তথ্য ও সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হ‌য়ে‌ছে জা‌নি‌য়ে তি‌নি ব‌লেন, “বিচারপ্রার্থী জনগণের তথ্যের অধিকার নিশ্চিতকরণে দেশের সব আদালত প্রাঙ্গণে তথ্য ও সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। মামলার সর্বশেষ অবস্থা, শুনানির তারিখ এবং আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে হয়রানি কমেছে।”

কেন্দ্রীয়ভাবে আদালতের কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হ‌য়ে‌ছে জা‌নি‌য়ে উপ‌দেষ্টা ব‌লেন, “একটি স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদালতে দক্ষ কর্মচারী নিয়োগের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগ কার্যক্রম চালু করার জন্য নীতিমালা প্রস্তুত হয়েছে।”

“তাছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রমের জন‌্য অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের সম্পত্তির হিসাব গ্রহণ এবং সংগৃহীত হিসাবের নথিসমূহ পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সাব রেজিস্ট্রারদের জন্য ব্যক্তিগত তথ্য বিবরণী তৈরি করা হয়েছে,” ব‌লেও জানান তি‌নি।

আসিফ নজরুল ব‌লেন, “জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের প্রসিকিউশন কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষ সেল গঠন করা হয়েছে। বিচার কার্যক্রম দ্রুততর করার লক্ষ্যে ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য সরকারি চাকরিজীবীদের অনলাইনে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের পত্রের আলোকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট Practice Directions জারি করেছে।বিদ্যমান আদালত ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করার লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুইটি পারিবারিক আদালতকে ই-ফ্যমেলি কোর্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।”

আইন মন্ত্রণালয়ে ডিজিটালাইজেশন করা হ‌য়ে‌ছে জা‌নি‌য়ে তি‌নি ব‌লেন, “আইন ও বিচার বিভাগের ৫০% নথি ডি-নথির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের Attestation সেবাকে শতভাগ অনলাইন প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করা হয়েছে। তাছাড়া বিচারপ্রার্থী জনগণের জামিনপ্রাপ্তি সহজীকরণের লক্ষ্যে অনলাইনে বেইলবন্ড জমা দেওয়ার নিমিত্ত প্রথমবারের মতো সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হয়েছে। শিঘ্রই পরীক্ষামূলকভাবে সফটওয়্যারটি ব্যবহার শুরু হবে।”

হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার আইন মন্ত্রণাল‌য়ের এই এক বছ‌রের বড় কাজ উল্লেখ ক‌রে আসিফ নজরুল ব‌লেন, “রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বিষয়ে জেলা পর্যায়ে গঠিত কমিটি এবং আইন ও বিচার বিভাগ কর্তৃক এজাহার, চার্জশিটসহ বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনার পর ১৫,০০০টিরও বেশি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। সূচারুভাবে সব ভুক্তভোগীকে এই সুযোগ চলমান রাখার লক্ষে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।”

“এছাড়া সাইবার আইনের অধীনে ৪০৮টি স্পিচ অফেন্স সংক্রান্ত মামলা, এবং জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে দায়ের করা ৭৫২টি হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব মামলা প্রত্যাহারের কারণে কয়েক লাখ রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও স্বাধীন মতের মানুষ হয়রানি থেকে রেহাই পেয়েছে।”

তি‌নি ব‌লেন, “বর্তমান সরকারের কার্যকালে আইন মন্ত্রণালয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রমে লক্ষণীয় গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন: গত এক বছরে মন্ত্রীপর্যায়ে নিষ্পত্তিকৃত নথির সংখ্যা ১২৮৩টি, বিগত সরকারের  একই সময়ে ৮৩৪ টি নথি নিষ্পত্তি হয়েছিল। গত এক বছরে আইন মন্ত্রণালয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগসহ অন্যান্য দপ্তরে ৩৯১টি বিষয়ে আইনি মতামত প্রদান করেছে (গত সরকারের আমলে ১৮০টি)। এ সময়ে সনদ, এফিডেভিট, দলিলসহ ৩৬ ধরনের মোট ১,৫৯,৫৪৪টি ডকুমেন্ট সত্যায়ন হয়েছে যা আগের তুলনায় দ্বিগুণ। আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে রেকর্ড ১২টি অংশীজন মতবিনিময় সভা আয়োজন করেছে।”

“নতুন দায়িত্ব হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন, গুম সংক্রান্ত অপরাধ তদন্ত কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে আইন মন্ত্রণালয় থেকে সাচিবিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো বিধিমালা ও প্রবিধানগুলোকে কোডিফাই করার কাজ শুরু হয়েছে।”

“এছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ফ্যসিষ্ট আমলে নিয়োগকৃত সব আইন কর্মকর্তা পালিয়ে যাওয়ার কারণে গত এক বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যাক আইন কর্মকর্তাকে নিয়োগ করতে হয়েছে।”

তিনি বলেন, “সারা দেশের বিভিন্ন আদালত ও ট্রাইব্যুনালে ৪৮৮৯ জন সরকারি আইন কর্মকর্তা এবং অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে ২৭৪ জন অ্যাটর্নিকে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিচারক ও প্রসিকিউটর নিয়োগ করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে ৫ জন বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগে ২৩ জন বিচারপতি নিয়োগে সাচিবিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে,” ব‌লেও জানান তি‌নি।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ