Samakal:
2025-11-04@02:21:07 GMT

পদ্মায় আড়াআড়ি বেড়া মাছ নেই জালে

Published: 30th, January 2025 GMT

পদ্মায় আড়াআড়ি বেড়া মাছ নেই জালে

‘আমার ছয় সদস্যের পরিবার। পদ্মা নদীতে মাছ ধরে সংসার চলে। দুই সপ্তাহ ধরে নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়ার ফলে জালে আর আগের মতো মাছ পড়ছে না। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন পার করতেছি’ বলছিলেন জেলে বিল্লাল ফকির। তিনি ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার গফুর মৃধা ডাঙ্গী গ্রামের বাসিন্দা। 
জানা গেছে, চরভদ্রাসন উপজেলার সদর ইউনিয়নের মাথাভাঙ্গা গ্রামের পদ্মা নদীতে দুটি বালুচরের মধ্যবর্তী নদীর মূল চ্যানেলে সারি সারি বাঁশ পুঁতে আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। দুটি চরের মধ্যবর্তী প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পুঁতে রাখা সারি সারি বাঁশের পানির নিচের অংশ জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। বেড়ার বাঁধে কিছু দূর পরপর রাক্ষুসী জালের ফাঁদ তৈরি করে রাখা হয়েছে। ওই ফাঁদে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আটকা পড়ছে। বিশেষ করে প্রতিদিন ওই ফাঁদে কয়েক মণ করে জাটকা আটকা পড়ছে। 
উপজেলার বালিয়াডাঙ্গী গ্রামের জেলে খোকা মণ্ডল বলেন, ‘এই শুকনা মৌসুমে পদ্মা নদীতে ইলিশ চলাচলের মূল স্রোত ধারায় বেড়ার বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এতে পদ্মায় মাছের আকাল দেখা দেওয়ায় উপজেলার বেশির ভাগ জেলে পরিবারের আয়-উপার্জন কমে গেছে।’ 
জেলে আলামিন ফকির (৪০) জানান, এ বছর পদ্মায় বড় ইলিশ খুবই কম। অন্যদিকে প্রতিদিন ওই বেড়ার বাঁধে মণকে মণ জাটকা মারা পড়ছে। 
স্থানীয় কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদ্মায় আড়াআড়ি বেড়ার বাঁধ দেওয়ার কারণে উপজেলার প্রায় সাড়ে ৭০০ জেলে পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে সদর ইউনিয়নের পদ্মা পারের বিভিন্ন গ্রামের দুই শতাধিক জেলের উপার্জন একবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। 
গত বুধবার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, মাথাভাঙ্গা গ্রামের প্রায় অর্ধেক পদ্মাজুড়ে আড়াআড়ি বাঁশের বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বাঁশের বেড়ার পানির নিচের অংশে ঘন জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। এভাবে নদীতে মাছ চলাচলের পথ বন্ধ করে কয়েক মিটার পর পর তৈরি করে রাখা হয়েছে জাটকা ও ইলিশ আটকের ফাঁদ। বাঁধ দেওয়ায় জড়িত জেলেরা দুই ঘণ্টা পর পর ফাঁদে আটকা পড়া জাটকা ও ইলিশ তুলে এনে বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছে। 
স্থানীয়রা জানান, পদ্মা নদীতে বেড়ার বাঁধ দেওয়ার সঙ্গে হিটু মৃধাসহ এলাকার আরও দু-একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত। খোঁজ করে বাঁধের অদূরেই হিটু মৃধাকে পাওয়া যায়। আলাপকালে তিনি জানান, অনেক টাকা খরচ করে পদ্মায় বাঁধ দিয়েছেন। মাত্র কয়েকদিন ধরে বাঁধ দেওয়া হয়েছে, বাঁধে এখনও পর্যাপ্ত মাছ আসে নাই। এখন শুধু জেলেদের খাওয়া খরচ চলছে। 
বাঁধ এলাকার বাসিন্দা ফয়সাল ফকির (৩৫) জানালেন, দুই সপ্তাহ ধরে ওই বাঁধ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে দিনরাত জাটকা ও ইলিশ নিধন করা হচ্ছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাঈদ হাসান বিপ্লব বলেন, পদ্মা নদীতে একটি আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। বাঁধটির এক অংশ নদীর চরভদ্রাসন উপজেলা এবং অপর অংশ সদরপুর উপজেলার জল সীমানায় পড়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনার পর যৌথভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছেন। 
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ ফয়সল বিন করিমের ভাষ্য, পদ্মায় আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়া হলে শিগগিরই তা অপসারণে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: উপজ ল র পর ব র পদ ম য়

এছাড়াও পড়ুন:

ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন ঠেকাতে গ্রামবাসী বানালেন ‘প্রাকৃতিক বাঁধ’

উজানের ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রবল স্রোতে ব্রহ্মপুত্র নদসহ অর্ধশতাধিক নদ-নদীর পানি বেড়ে দেখা দেয় ভাঙন। মাটির সঙ্গে ভেসে যায় বসতভিটা, ফসলি জমি, কখনো স্কুল বা মসজিদ। প্রতিবছর এই ভাঙনে নিঃস্ব হয় অসংখ্য পরিবার। সরকারি বাঁধ বা প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি মিললেও বাস্তবে কাজের গতি নেই।

এমন অবস্থায় এবার নিজেরাই নিজেদের রক্ষার পথ খুঁজে নিয়েছেন চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের খেরুয়ার চরের বাসিন্দারা। সরকারি সহায়তার অপেক্ষা না করে নিজেদের টাকায় ও স্বেচ্ছাশ্রমে তাঁরা ব্রহ্মপুত্রের তীরে গড়ে তুলছেন এক ‘প্রাকৃতিক বাঁধ’।

প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদীতীরে লাগানো হয়েছে কলাগাছ, কাশফুল, কলমিলতা ও স্থানীয় ঘাসজাতীয় গাছের চারা। এসব গাছের বিস্তৃত শিকড় নদীতীরের মাটি আঁকড়ে ধরে রাখবে, এমন ধারণা থেকেই এই উদ্যোগ।

খেরুয়ার চরের বাসিন্দা দুলাল জোয়াদ্দার বলেন, ‘প্রতিবছর ভাঙনে ঘরবাড়ি হারাই। কেউ সাহায্য করে না। তাই ভাবলাম, গাছ লাগালেই যদি কিছুটা মাটি টিকে থাকে তাতেই লাভ।’

সম্প্রতি সরেজমিনে নয়ারহাট ইউনিয়নের খেরুয়ারচর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে জেগে ওঠা বালুচরের দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে স্থানীয় বাসিন্দারা কাশফুলের চারা লাগাচ্ছেন। কিছু দূর পরপর কলাগাছ ও কলমিলতার চারাও লাগানো হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সবাই এ কাজে হাত লাগিয়েছেন। কেউ বালুচরে প্রাকৃতিক বাঁধ তৈরির কাজ করছেন, তো কেউ সেই বাঁধের জন্য কাশফুলের চারা ও কলমিলতার জোগান দিচ্ছেন। বসে নেই এলাকার নারীরাও, পুরুষের পাশাপাশি তাঁরা হাত লাগিয়েছেন পানি সরবরাহকাজে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য সানোয়ার হোসেন বলেন, আগেও সীমিত পরিসরে গাছ লাগানো হয়েছিল, কিন্তু এবার মানুষ অনেক বেশি সংগঠিত হয়েছে। তাই ব্যাপক পরিসরে লাগানো হচ্ছে। ‘মানুষ নিজেরাই টাকাপয়সা দিয়েছে, দল বেঁধে গাছ লাগিয়েছে। আমরা পাশে আছি’, বলেন তিনি।

ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে

নয়ারহাট ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরেই বজরা দিয়ারখাতা, দক্ষিণ খাউরিয়ার চর ও ফেইচকা এলাকায় অন্তত ২০০ পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। শতাধিক পরিবার বসতবাড়ি হারিয়ে অন্যের জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। ভাঙনের ঝুঁকিতে ইউনিয়নের একমাত্র আশ্রয়ণ প্রকল্প, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় বাজার।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, এ বছর নদীভাঙনে জেলার ১ হাজার ৫০০ পরিবার তাদের বসতি হারিয়েছে। এ ছাড়া গত ছয় বছরে ১৬ হাজার পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছে এবং ১৫৩ হেক্টর কৃষিজমি বিলীন হয়েছে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান বলেন, ব্রহ্মপুত্রের গভীরতা ও প্রবল স্রোতের কারণে এ ধরনের উদ্যোগ দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর না–ও হতে পারে। তবে স্থানীয়দের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ ইতিবাচক। এভাবে প্রাকৃতিক বাঁধ তৈরি হলে ভাঙনের ঝুঁকি কমে আসবে। জেলার প্রতিটি চরে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর এভাবে বাঁধ দিলে ভূমিক্ষয় ও ভাঙনের ঝুঁকি কমবে।

জলবায়ুর প্রভাব ও অভিযোজন

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর চরাঞ্চলে নদীভাঙন বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গিয়ে নদীতীর দুর্বল হয়, আর বর্ষায় প্রবল স্রোতে দ্রুত ক্ষয় ঘটে।

জেলা জলবায়ুকর্মী মার্জিয়া মেধা বলেন, চরাঞ্চলের এই উদ্যোগকে ছোট করে দেখা ঠিক হবে না। কলা, কাশফুল ও কলমি—সবই এমন উদ্ভিদ, যেগুলোর শিকড় মাটি ধরে রাখে। এটি একধরনের সবুজ বর্ম, যা ভাঙন রোধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তিনি আরও বলেন, এটি আসলে কমিউনিটিভিত্তিক জলবায়ু অভিযোজনের উদাহরণ। সরকার যদি বৈজ্ঞানিক পরামর্শ, উপযুক্ত প্রজাতির গাছ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সহায়তা দেয়, তবে এটি ব্রহ্মপুত্র তীর রক্ষার একটি টেকসই মডেল হয়ে উঠবে।

নদীগবেষক ও রিভারাইন পিপলের পরিচালক তুহিন ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙন রোধে বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা করে মানুষের জমি ও বসতভিটা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের গ্রহণ করা উচিত ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র সেখানে ব্যর্থ হয়েছে। স্থানীয় মানুষ নিজেদের বাঁচানোর তাগিদে কখনো বাঁশ-কাঠ দিয়ে, আবার কখনো কাশফুলের চারা দিয়ে প্রতিরোধব্যবস্থা করেছে। তিনি আরও বলেন, নদীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ অনেক সময় জীব ও পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলে, জলবায়ু সংকট তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। সেদিক বিবেচনায় স্থানীয় মানুষের এই প্রাকৃতিক বাঁধ ব্রহ্মপুত্র নদের তীর রক্ষার একটি টেকসই মডেল হয়ে উঠতে পারে।

চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সবুজ কুমার বসাক বলেন, ‘স্থানীয়দের প্রাকৃতিক বাঁধ নির্মাণ একটি প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা। এ বছর বন্যায় নদীভাঙনের পর সেখানে স্থায়ী বাঁধের জন্য আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দিয়েছি। এ ছাড়া স্থানীয়দের কাজকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আমরা তাদের পাশে রয়েছি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ