অন্তর্বর্তী সরকার গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য তাদের স্বল্পমেয়াদি অবস্থানের কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার বিষয়ে শুধু প্রস্তাবই পেশ করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে। তারপরও জরুরি সমস্যাগুলো সমাধানে তাদের মনোনিবেশ করতে হবে। তাদের একটি প্রধান কাজ হবে আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সূচক বা বেঞ্চমার্কগুলো সঠিকভাবে নির্ণয় করা। ঘাড়ের ওপর পড়ে যাওয়া জরুরি সমস্যাগুলোর সমাধান করে জনগণকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়াও এ সরকারের দায়িত্ব। সুতরাং আমার মতে, তাদের মূল দায়িত্ব হবে সঠিক ও স্বল্পসংখ্যক পদক্ষেপ গ্রহণ করা (ফিউয়ার অ্যান্ড বেটার)। প্রত্যাশিত এসব কাজ তারা কতদূর করতে পেরেছে তার একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা এখানে করব। 

এ ছাড়া সরকারের টাস্কফোর্স ও কমিশনগুলো নানা রকম সৃজনশীল ও অপ্রচলিত (ক্রিয়েটিভ অ্যান্ড ইনোভেটিভ) সংস্কার প্রস্তাব ইতোমধ্যে জমা দিয়েছে। কিছু সুপারিশ প্রণয়নের কাজ চলমান। অর্থনীতির হালহকিকতের ওপর যে শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়েছে, তার বিভিন্ন তথ্য নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা রয়েছে। এগুলো সম্পর্কেও প্রাসঙ্গিক কিছু মন্তব্য এ প্রবন্ধে তুলে ধরা হবে। 

শ্বেতপত্রে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত একটি গ্রন্থের মডেল ও স্টাডি ব্যবহার করে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার অতীতে যতখানি সরকারি পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছিল, বাস্তবে তা হয়নি। সম্প্রতি এই মডেলের কিছুটা সমালোচনা ও মার্জনা করে ফরেইন কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের সাবেক ডেপুটি প্রধান অর্থনীতিবিদ নিক লি মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তা মেনে নেওয়ার আগে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। ওই দাবি যদি সঠিকও হয় তাহলেও দেশটির দীর্ঘদিন ধরে অর্জিত জিডিপি হয়তো কমতে পারে কিন্তু একেবারে মুছে যাবে না। 

সম্প্রতি রেহমান সোবহান মন্তব্য করেছেন, দুর্নীতি ও বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও আসলে কীভাবে চরম দারিদ্র্যহার কমল এবং মানব উন্নয়ন সূচকগুলোতে উন্নতি অর্জিত হলো– সেটি বর্তমান উন্নয়নবিদদের তলিয়ে দেখা দরকার। কিছুই অর্জিত হয়নি– এ কথা যেমন সত্য নয়, তেমনি যেটুকু অর্জন সম্ভব ছিল, তা যে অনেকখানি দুর্নীতি ও বৈষম্যের কারণে অর্জন করা সম্ভব হয়নি– এটি আজ সবাই স্বীকার করেন। 
বোঝা যাচ্ছে, আগামী যে বাজেট অন্তর্বর্তী সরকার প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, তাতে তাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে: 

১.

কীভাবে বৈদেশিক খাতে উদ্বৃত্ত ব্যালান্স তৈরি করে ক্রমবর্ধমান ডলার রিজার্ভ তৈরি করা হবে এবং নতুন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাণিজ্য, বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগ নীতি কী হবে?

২. বাজেটে যে প্রচণ্ড রাজস্ব ঘাটতি থাকবে তা কীভাবে পূরণ করা হবে? 

৩. ব্যক্তি বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির হার যথাসম্ভব ধরে রাখা যায় কীভাবে তার উপায় উদ্ভাবন, অর্থাৎ বিনিয়োগ আবহাওয়ার উন্নতি করে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি কীভাবে অব্যাহত রাখবেন? 

৪. মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দা দুই-ই কাটিয়ে অর্থনীতিতে কীভাবে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা  আনবেন? 
নিঃসন্দেহে এগুলো খুবই চ্যালেঞ্জিং ও পুঞ্জীভূত কঠিন সমস্যা। এর জন্য যেসব জরুরি নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন, বিশেষত আর্থিক খাত, জ্বালানি খাত, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা এবং বাজার 
ব্যবস্থাপনায় যেসব আশু জরুরি সংস্কার শুরু করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে, তা অন্তত শুরু না করতে পারলে জনগণের মনে প্রয়োজনীয় বিশ্বাস, আস্থা বা ‘স্বস্তি’ ফিরিয়ে আনা যাবে না এবং গোলযোগ ও সামাজিক বিরোধ আরও বাড়বে, যার সুস্পষ্ট লক্ষণ ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। 
সুশাসন ও শৃঙ্খলার জন্য যেসব বিষয় জরুরিভাবে নিশ্চিত করা দরকার সেগুলো হচ্ছে–

১. জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকালে নিহত-আহতদের একটি সুস্পষ্ট সঠিক তালিকা প্রণয়ন, চিকিৎসা প্রদান এবং পুনর্বাসন। 

২. যেসব পুলিশ, শিক্ষা কর্মকর্তা, আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য কমবেশি অভিযুক্ত হয়েছেন, তাদের নিরপেক্ষ সুষ্ঠু তালিকা প্রণয়ন করে অপরাধের ধরন অনুসারে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা। 

৩. মব ভায়োলেন্স বন্ধ করে সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচারের পদক্ষেপ নিতে পারলে দেশে কিছুটা শৃঙ্খলা ইতোমধ্যে ফিরে আসত। পুলিশও কাজে ফিরে আসতে আস্থা পেত। 
৪. আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণগ্রহীতা, শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতা, বিদ্যুৎ খাতে ক্ষতিকর দেশি-বিদেশি চুক্তির কমিশনভোগী, মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে চিহ্নিত 
দুর্নীতিবাজদের নাম এবং অপরাধ প্রকাশ করে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। 

৫. সর্বোপরি শ্বেতপত্রে যে বড় অঙ্কের টাকা পাচারের কথা বলা হয়েছে, সেটি কীভাবে উদ্ধার হবে তা বলা কঠিন। বর্তমানে বিদেশি ভাড়া করা কোম্পানি ও দুদকের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টা চলছে। এর ফলে শত্রুদের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং নতুন বেকারত্ব সৃষ্টি হতে পারে। আমি এ অভিযান থামিয়ে দিতে বলছি না; সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে বলছি। 
৬. আশু যে কাজটি এখনও করে ওঠা যায়নি, তা হচ্ছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। নিম্নবিত্ত বিশেষত শিল্পশ্রমিক, কৃষক এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উৎপাদকদের প্রকৃত আয়ের সুরক্ষা প্রদান করে তাদের দ্রব্যমূল্যের আঘাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা উচিত। 

৬. বাজারে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগী কারা, আদৌ তাদের চিহ্নিত করে ভাঙার ক্ষমতা বাণিজ্য 
মন্ত্রণালয়ের আছে কিনা, সে প্রশ্ন আছে। তবে ক্রেতা সমবায় ও বিক্রেতাদের সমবায় তৈরি, রেশন, ওপেন মার্কেট অপারেশন ও খাদ্যের বিনিময়ে কাজ, গ্রাম-শহরে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা স্কিম চালু করা ইত্যাদি সুযোগ এখনও উন্মুক্ত।

উপসংহারে বলব, বাংলাদেশে যে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা স্বজনতোষণ পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার পরিপূরক হিসেবে রাজনীতিতে স্বৈরাচারী কর্তৃত্ব ও ফ্যাসিস্টসুলভ প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তা থেকে রাতারাতি মুক্তি পাওয়া কঠিন। তবে অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বহুদিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে। কীভাবে নিদেনপক্ষে একটি গণতান্ত্রিক অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীরা ১৯৯০ সালেই এরশাদকে হঠানোর পর ২৮টি টাস্কফোর্স রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিলেন। সেখানে ভালো ভালো সুপারিশ ছিল। অধ্যাপক রেহমান সোবহান তৎকালীন 
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে সেগুলো প্রণয়নে কোনো বাড়তি অর্থ খরচ না করেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য আমাদের, এগুলো প্রথমে বিএনপি সরকার এবং পরে আওয়ামী লীগ সরকার গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। 

প্রশ্ন তাই থেকেই যায়, এবারও এই রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার না হলে অথবা বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার বিকল্প শক্তি জনগণের মধ্যে তৈরি না হলে সংস্কার অভিযাত্রা কতদূর অগ্রসর হবে? ভবিষ্যৎ যত অনিশ্চিতই মনে হোক, দেশে যেন অন্তত মুক্তিযুদ্ধের মতো মীমাংসিত বিষয় নিয়ে কোনো নতুন বাগ্‌বিতণ্ডা-গৃহযুদ্ধ না হয়।  

এম এম আকাশ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 
অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত প রণয়ন র জন য র জন ত ব যবস সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

লন্ডন বৈঠকে বিচার ও সংস্কারের বিষয়টি নির্বাচনের মতো গুরুত্ব না পাওয়া অত্যন্ত হতাশাজনক: এনসিপি

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বিষয়টিকে ‘অত্যন্ত হতাশাজনক’ বলেছে দলটি।

আজ শুক্রবার রাতে এনসিপির এক বিবৃতিতে এই প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহউদ্দিন সিফাত বিবৃতিটি পাঠিয়েছেন।

এনসিপির বিবৃতিতে বলা হয়, রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে এনসিপি। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে লন্ডনে অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকটি ‘সংসদ নির্বাচন’ বিষয়ে দলটিকে আস্থায় আনতে সফল হয়েছে সরকার। জাতীয় ঐক্য, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। কিন্তু বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নাগরিকদের প্রধান দাবি তথা বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক বলে মনে করে এনসিপি।

নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে বারবার প্রতীয়মান হচ্ছে—এ কথা উল্লেখ করে এনসিপি আরও বলেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, জুলাই সনদ কার্যকর করা এবং বিচারের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন গণ-অভ্যুত্থানকে স্রেফ একটি ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে পরিণত করবে এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন–আকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করবে।

জনগণের দাবি তথা জুলাই সনদ রচনা ও কার্যকর করার আগে নির্বাচনের কোনো তারিখ ঘোষিত হলে তা জনগণ মেনে নেবে না বলে উল্লেখ করেছে এনসিপি। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংস্কারের বিষয়গুলোর ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ও জুলাই সনদ রচনা এবং কার্যকর করেই আসন্ন জুলাইকে যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করার উদ্যোগ নিতে সরকারকে জোর দাবি জানাচ্ছে এনসিপি।’

জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে এনসিপি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার যেভাবে হলে ভালো হয়
  • জাফলংসহ দেশের পর্যটন উন্নয়নে সমন্বিত মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে: পরিবেশ উপদেষ্টা
  • পরিবেশবান্ধব পর্যটনে সমন্বিত মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে: পরিবেশ উপদেষ্টা
  • লন্ডন বৈঠকে বিচার ও সংস্কারের বিষয়টি নির্বাচনের মতো গুরুত্ব না পাওয়া অত্যন্ত হতাশাজনক: এনসিপি