আ’লীগ ঠেকাতে অভিন্ন ভোটের ভাবনায় ভিন্ন
Published: 1st, February 2025 GMT
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চট্টগ্রামের রাজনীতিতেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে বিএনপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাঠে নেমেছে জামায়াতে ইসলামী। আওয়ামী লীগ না থাকায় রাজনীতির মাঠে বিএনপির সামনে ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে এ দলটি। দাপটের সঙ্গে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। ফলে একসময় দুই দলের মধ্যে মধুর সম্পর্ক থাকলেও এখন তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়ছে। তবে আওয়ামী লীগ ঠেকানোয় দুই দল এক হলেও ভোটের ভাবনায় তারা ভিন্ন অবস্থানে।
অন্যদিকে, ভারসাম্য রক্ষায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান-প্রশাসনও দুই দলের নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলছে। কোনো অনুষ্ঠান হলে দুই দলের নেতাদের গুরুত্ব দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। যাতে তারা অংশও নিচ্ছেন। বিশেষ করে জেলা প্রশাসনের শান্তি সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিএনপি নেতাদের পাশাপাশি দাওয়াত পাচ্ছেন জামায়াত নেতারাও।
একসময় বিএনপি ও জামায়াত– দুই দলেরই ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল চট্টগ্রাম। বিশেষ করে দেশের যে কয়েকটি এলাকায় জামায়াতের দাপট রয়েছে, তার অন্যতম একটি হচ্ছে চট্টগ্রাম। প্রতিদিনই কর্মী সমাবেশ, রুকন সমাবেশ, কর্মশালা, মিলাদ মাহফিলসহ নানা ধরনের একাধিক কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করা হচ্ছে। সর্বশেষ প্রত্যক্ষভাবে জামায়াত সমর্থিত ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের ব্যানারে নগরীর প্যারেড মাঠে পাঁচ দিনব্যাপী তাফসিরুল কোরআন মাহফিলের আয়োজন করা হয়। একসময় চকবাজার সংলগ্ন চট্টগ্রাম কলেজের এ মাঠে পাঁচ দিনব্যাপী তাফসিরুল কোরআন মাহফিলের আয়োজন করত তারা। যাতে প্রধান মুফাচ্ছির হিসেবে বয়ান করতেন আল্লামা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী। দীর্ঘসময় পর পুনরায় তাফসির মাহফিলের আয়োজন করল সমাজ কল্যাণ পরিষদ।
অন্যদিকে বসে নেই বিএনপিও। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে নির্বাচনমুখী দল পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেছে বিএনপি। পাশাপাশি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে সভা-সমাবেশের পাশাপাশি নিয়মিত লিফলেট বিতরণ করছে দলটির নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া বিভিন্ন দিবসভিত্তিক নানা কর্মসূচি তো রয়েছেই। ইতোমধ্যে গত ৭ জুলাই বিএনপি নেতা এরশাদ উল্লাহকে আহ্বায়ক ও নাজিমুর রহমানকে সদস্য সচিব করে দুই সদস্যের আংশিক নগর কমিটি ঘোষণা করা হয়। ৮৭ দিনের মাথায় গত ৪ নভেম্বর ৫১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। তারা ইতোমধ্যে নগরীর ইউনিট থেকে ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ের সব কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন করে দল পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছেন। এভাবে চট্টগ্রামে এক প্রকার শক্তিমত্তার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে বিএনপি-জামায়াত।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের কয়েকটি স্থানে সংঘর্ষ ও মারামারিতেও জড়িয়েছে বিএনপি-জামায়াত। এই ধরনের কলহ দিন দিন বাড়ছে। গত ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ বাজারে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে জামায়াত নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। উভয় পক্ষের চারজন গুরুতর আহত হন। আহতরা হলেন– জেএস এন্টারপ্রাইজের মালিক সাবেক শিবির নেতা জামাল উদ্দিন (৩৯), জামায়াতের কর্মী মো.
জানা যায়, ৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে জোরারগঞ্জ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বিজ্ঞানাগার ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। নির্মাণকাজের মালামাল সাপ্লাই নিয়ে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন দুই দলের নেতাকর্মীরা।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. হারুন জামান সমকালকে বলেন, ‘জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে দেশে আমরা নতুন স্বাধীনতা পেয়েছি। এই অর্জন যাতে কোনো কারণে নষ্ট না হয় সে জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। যাদের কারণে দলের ক্ষতি হবে তাদের দল থেকে বের করে দেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি। স্বাভাবিকভাবে আমরা গায়ে পড়ে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জামায়াত-শিবির কিছু কিছু জায়গায় গায়ে পড়ে ঝামেলা করার চেষ্টা করছে। বিপ্লবের অর্জন যাতে ম্লান না হয় সে জন্য ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে বিএনপি পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে।’
নগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি মোহাম্মদ উল্লাহ সমকালকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম হচ্ছে জামায়াতের অন্যতম ঘাঁটি। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতকে নির্মূলে এমন কোনো কাজ নেই, যা তারা করেনি। এমনকি জামায়াতকে নিষিদ্ধ পর্যন্ত করেছিল। এই ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিয়ে টিকে আছে দলটি। তাই চাইলেই কেউ আমাদের নিশ্চিহ্ন করতে পারবেন না। জামায়াত তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের কাছে দাওয়াত নিয়ে যাচ্ছে। গায়ে পড়ে কেউ ঝামেলা না করলে আমরাও ঝামেলায় জড়াতে চাই না।’
এদিকে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে যখন দূরত্ব বাড়ছে ঠিক এমন সময় সভা-সমাবেশ, অবরোধ ও হরতালের মতো কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে তাদের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন ‘নিষিদ্ধ’ ছাত্রলীগও। তারা এভাবে রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়ে চলমান রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাতে নড়েচড়ে বসেছে। এই অবস্থায় বিএনপি ও জামায়াত দুই মেরুতে থাকলেও আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগকে ঠেকাতে পৃথকভাবে রাজপথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। বিএনপি ও জামায়াত নেতারা বলছেন, দেশে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের আর কোন রাজনীতি করার অধিকার নেই। তারা এই ধরনের কিছু করে দেশে নতুন করে কোন অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করলে তাদের প্রতিহত করা হবে। প্রয়োজনে সাধারণ মানুষকে নিয়ে এলাকায় এলাকায় পৃথকভাবে অবস্থান নেবেন দুই দলের নেতাকর্মিরা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত দ ই দল র ন ত ন ত কর ম ব এনপ র র জন ত র গঠন সদস য সরক র ধরন র আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
শিক্ষা আন্দোলনের চেতনা বনাম রাষ্ট্রের নীরবতা
পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলনের ওপর দাঁড়িয়ে ইতিহাস আমাদের প্রভূত জাতীয়তাবাদী শক্তি দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুরোনো ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের’ নতুন মোড়ক জন্ম দিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ, যা তাঁরা ১৯০৫-১৯১১ সাল পর্যন্ত গ্রহণ করেননি; কিন্তু ১৯৪৮ সালের পর সেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে গ্রাহ্য করা জরুরি ছিল।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠল পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক ‘ডমিনেন্ট হেজিমনি’র বিপরীতে নিপীড়িত জাতিসত্তার কণ্ঠস্বর। এই প্রভাব বাংলাদেশকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে জন্ম দিলেও ভাষা আন্দোলন আমাদের পাঠ্যপুস্তকীয় ইতিহাসে শুধু ‘বায়ান্ন’ ও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’তে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এটা রাষ্ট্রই সুচারুভাবে গড়ে তুলেছে। কেননা, এতে তার তথাকথিত উদারবাদী রাজনীতির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা সহজ হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত করা যায় প্রতিরোধের রাজনীতিকে।
রাষ্ট্রের এই রাজনীতির সবচেয়ে বড় বলি হয়েছে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন, মুখ্যত বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে এ রাষ্ট্রে, শিক্ষা আন্দোলন প্রসঙ্গে তার সিকিভাগ বিদ্যায়তনিক মনোযোগও দেওয়া হয়নি। অথচ ভিন্ন আলাপ তুললে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন মূলত ভাষা আন্দোলনের যে প্রতিরোধ, সেটিরই একটি পরিবর্ধিত রূপ এবং প্রাথমিক পূর্ণতার জন্মদাতা।
আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এই গৌরবগাথার বয়ান পাবেন মাত্র এক অনুচ্ছেদ। এই দ্বিচারিতার পেছনেও অন্য এক রাজনীতি আছে। সত্য এই যে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান হয়ে বাংলাদেশ অর্জন পর্যন্ত; কিন্তু নতুন দেশে শিক্ষাব্যবস্থা যতটা সর্বজনীন ও বি–উপনিবেশিত করা উচিত ছিল, সেদিকে রাষ্ট্র ও সরকারগুলোর যথাযথ আগ্রহ আজও নেই।
কেন হয়েছিল শিক্ষা আন্দোলনব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার পথ ধরেছিল পাকিস্তানের সামরিক আমলাতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রী শাসকগোষ্ঠী। ঔপনিবেশিক মনোজগৎ নিয়েই ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি গঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের সচিব এস এম শরীফের নেতৃত্বাধীন শিক্ষা কমিশন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবাদর্শে শিক্ষাকে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষায় শরীফ শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়। মাত্র আট মাসে প্রস্তুত সেই প্রতিবেদন প্রত্যাঘাতের ভয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। প্রকাশিত হওয়ার পরপরই পূর্ববঙ্গ আবার ফুঁসে ওঠে। ভেঙে ফেলে আইয়ুব শাহির রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সময়ের কঠিন-কঠোর মার্শাল ল। কেন? এর গুরুত্বটা অনুধাবন করা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনের সুপারিশে শরীফ কমিশন প্রথমত বলেছিল, উর্দু হবে পাকিস্তানের শিক্ষার ভাষা, ইংরেজি হবে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বাধ্যতামূলক আর বাংলা বর্ণমালার বদলে চালু হবে রোমান হরফ (রোমান হরফে ইউরোপীয় বহু দেশ তাদের ভাষাকে লিখিতভাবে প্রকাশ করে)।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষাকে পণ্য ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্র শিক্ষার দায়িত্ব নেবে না বলে কমিশন সুপারিশ করে। অর্থাৎ যাঁর টাকা আছে, শিক্ষার অধিকার তাঁরই, এটাই ছিল এই সুপারিশের মূলকথা।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক (ফ্রি) না করার পরিপূর্ণ পাঁয়তারা ছিল এই সুপারিশে। পাকিস্তান হওয়ার পর থেকেই পূর্ববঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছিল। কমিশনের সুপারিশ তাতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে উঠল। গ্রাম-অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গে বরাবরই কৃষক ও শ্রমিকেরা ছিল সংখ্যাগুরু। ভাষা ও অর্থের মারণাস্ত্র প্রয়োগ করলে এই বিশাল মেহনতি শ্রমজীবী শ্রেণির সন্তানেরা শিক্ষিত হবে কীভাবে?
এই যে দুটি বিপদ, এগুলো নতুন নয়, পুরোনোই। ১৮৩৫ সালে দেওয়া ম্যাকওলে নীতিরই নতুন সংস্করণ। প্রথমে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি চাপিয়ে দেওয়া; তারপর ইংরেজি না জানলে চাকরি না পাওয়ার আতঙ্ক ঢোকানো ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি। ঠিক একই খড়্গ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আবারও নেমে এল ১৯৬২ সালে।
শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরোধিতা ও মাতৃভাষায় শিক্ষার দাবিতে রাজপথে নামলেন। লম্বা সে লড়াইয়ের ইতিহাস। সে ইতিহাস গৌরবেরও, চাঞ্চল্যেরও। লম্বা সময় ধরে লড়াই করার পর ১৭ সেপ্টেম্বর হরতাল ডাকা হলো, যার মূল কুশীলব ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মোহাম্মদ ফরহাদ ও ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান।
সেই হরতালের মিছিলে গুলি চলল। শহীদ হলেন মোস্তফা, বাবুল ও ওয়াজিউল্লাহ। টঙ্গীতে সুন্দর আলী। সেই থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘শিক্ষা দিবস’। কিন্তু সেটি নামে, মর্মে-কর্মে অতলান্ত বিস্মৃতির ছাপ।
ভাষার প্রশ্নটি শিক্ষা ও কর্মসংস্থানেরও প্রশ্নশিক্ষার প্রশ্নটি যে ভাষার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তা শরীফ কমিশনের সুপারিশ থেকেই স্পষ্ট। কিন্তু একে শুধু ১৯৫২ বা ১৯৬২ সালের ঘটনাবলি দিয়ে মোটেও বোঝা যাবে না। যেতে হবে ইতিহাস ও রাজনীতির আরও গভীরে।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আট বছরের সংগ্রাম তাতে আপাত সফল হয়; কিন্তু এই সাফল্যের চেয়েও বড় অর্জন আছে।
ভাষার প্রশ্নটিকে পূর্ববঙ্গের উদয়োন্মুখ (অ্যাসপায়েরিং) শিক্ষিত মধ্যবিত্ত (শিক্ষার্থী ও বুদ্ধিজীবীরা) যে আর্থসামাজিক বয়ান দিয়ে মোকাবিলা করেছিলেন, তার তুল্য বিচার হতে পারে ১৮৫৭ সালের প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহের সঙ্গে। সেই প্রতিরোধকে ঔপনিবেশিক বিদ্যায়তনিক ভাষায় ক্ষুদ্রার্থে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলা হলেও আদতে তা ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক উৎপাদন সম্পর্ক তথা সার্বিকভাবে উৎপাদন পদ্ধতিকে নাকচ করে পুরো ভারতবর্ষে প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়েছিল।
ভাষা আন্দোলনের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য প্রকট। ভাষার সঙ্গে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সম্পর্ককে সামনে আনা হয়েছিল। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতের মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হিসেবে গড়ে তোলার যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছিল, তা মুসলিম লীগ ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহই প্রথম নাকচ করে প্রতারণা করেন। সেই স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গের জমিনে সব আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে।
ভাষা হিসেবে বাংলাকে নাকচ করে দেওয়ার সঙ্গে এই স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষাকে ভূলুণ্ঠিত করার সম্পর্ক আছে। পূর্ববঙ্গ স্বায়ত্তশাসন পেলে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই তার গঠন তৈরি হতো। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতাকাঠামো তার ওপর চাপিয়ে দিতে চাইল উর্দু, যা পূর্ববঙ্গের আমজনতার কাছে ‘ভিনদেশি’ ভাষাই ছিল মুখ্যত। এমতাবস্থায় শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই সামনে এসে গেছে।
শিক্ষার মাধ্যম (মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন) ও চাকরির পরীক্ষার ভাষা উর্দু হলে বাঙালি সেই ভার বহন করতে পারত না। মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানিরা উর্দুকে শুধু একক রাষ্ট্র ভাষাই বানাতে চায়নি, পঞ্চাশের দশকে বাংলা লিখতে বলেছিল ফার্সি-আরবি প্রভাবিত নাস্তালিক হরফে, যে হরফে পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষাগুলো লিখিত।
নৌবাহিনীর পরীক্ষা উর্দুতে নেওয়ার প্রতিবাদ এ জন্যই হয়েছিল। নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গকে পশ্চিমা উর্দুভাষী রেজিমেন্ট দ্বারা চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলার এই প্রবণতা খেয়াল করার মতো। মনে রাখতে হবে, এই প্রবণতা পঞ্চাশের দশকের শুরুর প্রবণতা, একাত্তরের গণহত্যা যার চূড়ান্ত পরিণতি। ভাষাকেন্দ্রিক লড়াই তাই শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সীমিত ছিল না। এর সঙ্গে একটি প্রতারিত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিকভাবে বিকাশের সম্পর্ক জড়িত। জড়িত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইও।
আর অন্তরে ছিল এমন একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীকে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা, যারা ১৮৫৭ সালের মতোই প্রথাগত উৎপাদন–সম্পর্ক ও উৎপাদনপদ্ধতিকে সমূলে উৎপাটন করে আপামর জনগোষ্ঠীর কথা ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে। যুক্ত হয়েছিল ভূমিব্যবস্থা বদলে ফেলতে চাওয়া বিখ্যাত তেভাগা আন্দোলনের লড়াইয়ের স্পিরিট, যার প্রভাবে ১৯৫০ সালের জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হয়।
১৯৫০ সালে রাজশাহীর জেলে সংঘটিত হয় কুখ্যাত ‘খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড’, যেখানে রাজবন্দী বামপন্থী নেতা-কর্মীদের মধ্যে ৭ জন নিহত হন, আহত হন ৩০ জনের বেশি। ১৯৫৪ সালে আদমজী ও কর্ণফুলী কারখানায় বাঙালি শ্রমিকদের ওপর অবাঙালি মালিকগোষ্ঠীর লেলিয়ে দেওয়া দানবীয় হত্যাকাণ্ডে নিহত হন ৯০ জন, আহত হন ২৫০ জনের বেশি শ্রমিক। ভাষা আন্দোলন এসব নির্মমতার বিরুদ্ধেও প্রতিরোধের অপর নাম।
সবিশেষে এই আন্দোলন এমন কিছু আর্থসামাজিক বিষয় সামনে এনেছিল, যা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের মেহনতি মানুষের দুর্দশা লাঘবের বড় মঞ্চ হয়ে উঠেছিল, স্বপ্ন দেখিয়েছিল উৎপাদন-সম্পর্ক বদলের। এ কারণেই এটি একটি আন্দোলন মাত্র ছিল না, ছিল অভিজাত ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে একেকটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ‘অনন্য অভ্যুত্থান’।
শরীফ শিক্ষা কমিশন বাতিল হয় শিক্ষার্থীদের আত্মবলিদানের শক্তিতেই। মনে রাখতে হবে, রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল; লড়াইটা তাই মূল ভাষা আন্দোলনের চেয়েও কঠিন ছিল; কিন্তু এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে হলে রাষ্ট্রের খোলনলচে বদলে ফেলার প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন ছিল। নতুন রাষ্ট্র অভিজাত শ্রেণির বিপক্ষে যেতে চায়নি। তাই ভাষা আন্দোলনের পরম্পরা হিসেবে শিক্ষা আন্দোলনের যে চেতনা তৈরি হয়েছিল, তা লোপাট হয়ে গেছে।ভাষা ও ‘শিক্ষার মাধ্যম’ অঙ্গাঙ্গি ছিলনতুন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ প্রসঙ্গ মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ভারত ভাগ হওয়ার আগপর্যন্ত বারবার এড়িয়ে গেছেন। পূর্ববঙ্গের নেতারাও সেটি অনুভব করেননি। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম প্রাদেশিক পরিষদে শিক্ষার অধিকার প্রসঙ্গে যে ইশতেহার তুলে ধরেন, তাতে ভাষার প্রসঙ্গটি স্থান পায়নি। ছাত্র-যুবা ও বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু ঠিকই আলাপটা তুলেছিলেন। তবে সেটি শুধু রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গে নয়, এর সঙ্গে তাঁরা শিক্ষার মাধ্যম নিয়েও কথা বলেছেন।
১৯৪৭ সালের জুলাইয়ে গণ আজাদী লীগ, ১৯৪৭ সালের ৬-৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ, ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা—বাংলা না উর্দু শীর্ষক পুস্তিকায় তমদ্দুন মজলিস বাংলাকে পূর্ববঙ্গের দাপ্তরিক ভাষা করার পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবি তোলেন। গণতান্ত্রিক যুবলীগ তো অবৈতনিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষারও দাবি জানায়।
মোদ্দাকথা, শুধু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেই ভাষার অধিকার বাস্তবায়িত হয় না। এর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত হয় মূলত শিক্ষায়, সরকারি দপ্তরে ও চাকরির পরীক্ষায়; কিন্তু ১৯৫৬ সালে সাংবিধানিক স্বীকৃতির তথাকথিত ভণিতা ছাড়া বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি পাকিস্তানিদের মনোভাব কখনোই বদলায়নি। সেই মনোভাবেরই প্রতিফলন শরীফ শিক্ষা কমিশন। এ জন্যই শিক্ষা আন্দোলন নিয়ে আমাদের বয়ান ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি।
শিক্ষা ও আজকের বাংলাদেশশরীফ শিক্ষা কমিশন বাতিল হয় শিক্ষার্থীদের আত্মবলিদানের শক্তিতেই। মনে রাখতে হবে, রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল; লড়াইটা তাই মূল ভাষা আন্দোলনের চেয়েও কঠিন ছিল; কিন্তু এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে হলে রাষ্ট্রের খোলনলচে বদলে ফেলার প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন ছিল। নতুন রাষ্ট্র অভিজাত শ্রেণির বিপক্ষে যেতে চায়নি। তাই ভাষা আন্দোলনের পরম্পরা হিসেবে শিক্ষা আন্দোলনের যে চেতনা তৈরি হয়েছিল, তা লোপাট হয়ে গেছে।
যে কারণে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে বারবার শিক্ষার্থীদের নামতে হয়েছে। এরশাদের আমলে মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা জীবন দিয়েছেন, যে দিনটি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস নামে স্বীকৃত হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের করতে হয়েছে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে হয়েছে বর্ধিত ফি–বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
বিস্ময়কর বটে, বর্তমান শিক্ষার্থীদের অনেকেই হয়তো জানেনই না শিক্ষা দিবস কী ও কেন! ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বর সম্পর্কে জানেন; কারণ, পাঠ্যপুস্তকে এগুলো স্বাভাবিক মহিমায় প্রকাশিত হয়েছে। ১৭ সেপ্টেম্বর নিয়ে সেটি করতে গেলে রাষ্ট্রকে সরাসরি শিক্ষা সংকোচন নীতি ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে; কিন্তু রাষ্ট্র সেটি করবে না।
সেটি করলে রাষ্ট্রের তথাকথিত উদার অর্থনীতি ও ব্যক্তিমালিকানায় শিক্ষাকে সোপর্দ করার সব নকশা শিক্ষার্থী সমাজের কাছে উন্মোচিত হয়ে যাবে।
শিক্ষার্থীরা তখন প্রশ্ন করবেন, ‘এ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে আমি বৈষম্যের শিকার কেন হচ্ছি? কেন রাষ্ট্র দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক হলেও, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করতে দিলেও যেকোনো স্তরে আমার শিক্ষার ভার বহন করবে না?’
এসব প্রশ্নের উত্তর পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোয় চলতে চাওয়া রাষ্ট্রের কাছে নেই। শিক্ষা দিবসের দুর্দমনীয় চেতনা তাই শুধু কাগজের কালিতেই লেখা আছে; মর্মে নেই, কর্মে তো নেই-ই।
ড. সৌমিত জয়দ্বীপ, সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত লেখকের নিজস্ব