Samakal:
2025-05-01@03:18:22 GMT

ভাষা রক্ষায় গবেষণা

Published: 8th, February 2025 GMT

ভাষা রক্ষায় গবেষণা

ভাষার মাধ্যমে মানুষ তার বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করে আসছে সেই প্রাচীনকাল থেকে। সমাজ-সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষাও এক অবস্থায় থাকে না; তা পরিবর্তিত হয়। কোনো কোনো ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যায় চিরতরে। এর সঙ্গে বিলুপ্ত হয় একটি জনগোষ্ঠীর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি। লিখেছেন দ্রোহী তারা
-------------------------------------------

ভাষার প্রথম উৎস বা উৎপত্তি নিয়ে তেমন কোনো জোরালো প্রমাণ বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত পাননি। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও বিভিন্ন প্রাগৈতিহাসিক তথ্য, গুহাচিত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়, ভাষার উৎপত্তি সেই ৮০ লাখ বছর আগে। আফ্রিকার কিছু জঙ্গলের এপ জাতীয় প্রাণী বাস করত তাদের মধ্য থেকে। কেননা বিভিন্ন বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা গেছে, এপ জাতীয় প্রাণীগুলোর মধ্যে শিম্পাঞ্জি ও মানুষের পূর্বজ ছিল। এসব হলো ভাষার আদি অন্ত বিষয়।

পৃথিবীতে এখন ৭ হাজার ১৬৮টি ভাষা রয়েছে; যার মধ্যে ৩ হাজার ৪৫টি ভাষা হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সাধারণ দৃষ্টিতে কিছুই মনে নাও হতে পারে। একটি ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে সম্পূর্ণ একটি জাতিসত্তার সব চিহ্ন মুছে যাওয়া। সবচেয়ে বেশি চিন্তার বিষয়, এসব হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ভাষার মধ্যে বাংলাদেশের ১৪টি ভাষাও রয়েছে। সেগুলো হলো- কুন্দ, খারিয়া, কোদা, সৌরা, মুন্দারি, কোল, মাল্টো, খুমি, পাংখুয়া, রেঙ্গমিচা, চাক, খায়াং, লুসি ও লালেং। এই ভাষাভাষী যে কয়েকজন বয়সের ভাড়ে ন্যুব্জ মানুষ বেঁচে আছেন, তাদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এ তালিকা তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট একটি ভাষা গবেষণা কেন্দ্র। এটি মাতৃভাষা সংরক্ষণ, বহুভাষিক শিক্ষা প্রসার এবং বৈশ্বিক ভাষাগত বৈচিত্র্য রক্ষায় নিবেদিত। ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করে, যা ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি ঘোষণার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

মূলত এ ইনস্টিটিউট তৈরির মূল উদ্দেশ্য– বিশ্বের সব মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও গবেষণা, ভাষাগত বৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় নীতিমালা প্রণয়ন, বহুভাষিক শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক সমন্বয় বৃদ্ধি, বিপন্ন ভাষার ডকুমেন্টেশন ও ডিজিটাল সংরক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে ভাষাসংক্রান্ত জ্ঞান বিনিময়।

এ ছাড়া মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশের ৪০টিরও বেশি আদিবাসী ভাষা এবং বৈশ্বিক বিপন্ন ভাষার অডিও-ভিজ্যুয়াল ডকুমেন্টেশন রয়েছে, যা বিপন্ন ভাষার ডিজিটাল আর্কাইভ প্রকল্প নামে পরিচিত। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট শুধু কেবল বাংলাদেশ নয়, বহির্বিশ্বেও ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে প্রতিনিয়ত। ইউনেস্কো, এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল ও এথনোলোগের অংশীদারিত্বে ভাষাবিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।

একটি জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হলো ভাষা। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এশিয়া মহাদেশেই সবচেয়ে বেশি মাতৃভাষার সমাহার রয়েছে। বাংলা, হিন্দি, মান্দারিন, জাপানিসহ অসংখ্য ভাষা এ মহাদেশের বাসিন্দাদের মুখরিত করে। আফ্রিকায়ও রয়েছে ভাষার বিশাল বৈচিত্র্য। সোয়াহিলি, হাউসা, জুলু, আমহারিকের মতো ভাষাগুলো আফ্রিকান সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। ইউরোপে ইংরেজি, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, রুশের মতো ভাষাগুলো শুধু যোগাযোগের মাধ্যমই নয়; বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমেরিকা মহাদেশে ইংরেজি ও স্প্যানিশের পাশাপাশি আদিবাসী ভাষাগুলোও টিকে রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলে আদিবাসী ভাষাগুলো স্থানীয় সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে।

বৈচিত্র্যময় এ ভাষাগুলো শুধু শব্দের সমষ্টি নয়, এগুলো মানবসভ্যতার ইতিহাস, দর্শন ও জ্ঞানের ভান্ডার। প্রতিটি ভাষাই একটি সম্প্রদায়ের চিন্তা, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার প্রকাশ। মাতৃভাষার ক্ষেত্রে একটি বিষয় বিশেষভাবে পরিলক্ষিত, বাংলার ‘ম’ বর্ণের আধিক্য সব জায়গায় পরিলক্ষিত হয় বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হলেও। যেমন– বাংলায় ‘মা’, ইংরেজিতে ‘মাদার’, স্প্যানিশে ‘মাদ্রে’, ফ্রেঞ্চে ‘মিরে’, জার্মানে ‘মুটার’, রুশে ‘মাট’, চীনে ‘মামা’, জাপানিতে ‘হাহা’, আরবিতে ‘উম’, হিন্দিতে ‘মা’। মিল ও অমিল থাকা সত্ত্বেও বাস্তবতা হলো ভাষাবিদ ডেভিড ক্রিস্টালের মতে, প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড থেকে। অর্থাৎ আমরা হারাচ্ছি একেকটি সমৃদ্ধ ইতিহাস।

এর কারণ হিসেবে বলা যায়, আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য ইংরেজি, স্প্যানিশ, মান্দারিনের মতো ভাষাগুলো প্রাধান্য পাচ্ছে বর্তমানে অনেক বেশি। ফলে স্থানীয় ভাষাগুলো অবহেলিত হচ্ছে। অনেক দেশে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য আধিপত্যবাদী ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক। ফলে স্থানীয় ভাষাগুলো দুর্বল করে দিচ্ছে। আবার আকাশ সংস্কৃতির পরিবর্তনের ফলে নতুন প্রজন্ম স্থানীয় ভাষার চেয়ে আধুনিক সংস্কৃতি ও ভাষার দিকে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। ভাষাগুলোকে জীবিত, বিপন্ন এবং বিলুপ্ত– এই তিন শ্রেণিতে বিভাজিত করা হয়েছে। বর্তমানে ভাষাবিদরা বিপন্নপ্রায় ভাষাগুলোকে রক্ষার্থে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাওয়ার পাশাপাশি সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে চলেছেন।

অন্যদিকে ভাষার অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের দিকে তাকালে দেখা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন, আমেরিকায় নেটিভ আমেরিকান ভাষা সংরক্ষণ, কানাডার কুইবেকে ফরাসি ভাষার স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা লাটভিয়ায় রুশ ভাষার বিরুদ্ধে গণভোট– সবই ভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

এ ছাড়া বেলজিয়াম, বলকান অঞ্চল, স্পেন, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ভাষা প্রশ্নে আন্দোলন হয়েছে। ভাষা রক্ষার লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষা আন্দোলন এক অনন্য ঘটনা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউলরা প্রাণ দেন। এই আন্দোলন শুধু ভাষার জন্য সংগ্রাম নয়। এটি বাঙালি জাতীয়তাবোধের ভিত্তি গড়ে তোলে, যার ধারাবাহিকতায় এসেছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ।

একুশে ফেব্রুয়ারি আজ শুধু বাংলাদেশের নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী ভাষার অধিকারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাষার জন্য আত্মত্যাগের এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। পৃথিবীর সব ভাষা এবং মাতৃভাষা রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য ইউনেস্কো ১৯৯৯ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে উদযাপন করে আসছে।

পৃথিবীতে জীবিত ভাষাগুলো মানবসভ্যতার অমূল্য সম্পদ। এ ভাষাগুলো শুধু ভাব বিনিময়ের মাধ্যমই নয়, একটি জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শিকড়। একটি ভাষার মৃত্যু মানে শুধু শব্দের মৃত্যু নয়, একটি সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের মৃত্যু। সে স্থান থেকে ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষা করা হলো মানবসভ্যতার ইতিহাস রক্ষা করা।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

পদ্মা নদীতে টর্নেডো, পানির স্তম্ভ উঠে গেল আকাশের দিকে

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে পদ্মা নদীতে টর্নেডোর উৎপত্তি হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা তিনটার দিকে উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের হাটখোলা এলাকায় পদ্মা নদীতে পানির স্তম্ভ আকাশের দিকে উঠে যায়। কয়েক মিনিট পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়। ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে কুমারখালী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার ও ঈশ্বরদী আবহাওয়া কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ফেসবুকের ভিডিও থেকে বিষয়টি জানতে পেরেছেন।

এ বিষয়ে দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল হাই সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা নদীতে হাটখোলা এলাকা থেকে টর্নেডো ভেড়ামারার দিকে অগ্রসর হয়ে যায়। তবে এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ১ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, পদ্মা নদীর মাঝ থেকে পানির স্তম্ভ আকাশের দিকে উঠে গেছে। অনেকটা ফানেলের আকার ধারণ করেছে। ওই দৃশ্য দেখে কয়েকজন দৌড়ে দূরে সরে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে পানির স্তম্ভ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

কুমারখালী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের অপারেটর হারুন আর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিও ফেসবুকে ভিডিওটি দেখেছি। তবে আবহাওয়া অফিসে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই।’ একইভাবে ঈশ্বরদী আবহাওয়া কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দীন বলেন, ‘স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে টর্নেডোর খবর পাওয়া গেছে। ভিডিওতে দেখেছি। এ ছাড়া কোনো তথ্য নেই।’

আবহাওয়াবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত কোনো স্থানে নিম্নচাপ বা লঘুচাপ সৃষ্টি হলে ওই স্থানের উষ্ণ বাতাস ওপরের দিকে উঠে যায় এবং তখন ওই শূন্য জায়গা পূরণের জন্য চারদিকের শীতল বাতাস দ্রুত বেগে ধাবিত হয়। এভাবেই টর্নেডোর উৎপত্তি হয়। অল্প সময়ের জন্য তৈরি হওয়া এই ঘূর্ণিঝড় গতিপথে যা পড়ে, সবকিছু নিজের ভেতর টেনে নিতে থাকে এবং ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। স্থলে হলে বা পানি ও ভূমি মিলে টর্নেডো তৈরি হলে সেটা অনেক সময় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শুধু পানির ওপরে টর্নেডো তৈরি হলে সেটা ততটা শক্তিশালী হয় না।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টর্নেডো দেখতে সরু ফানেলের মতো হয়, যার চিকন অংশটি ভূমি স্পর্শ করে। যদিও টর্নেডো বিভিন্ন আকার কিংবা আকৃতির হতে পারে। টর্নেডো পানি টেনে নিয়ে ওপরে তুলে মেঘ তৈরি করে। পরে সেটাই আবার বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে। অনেক সময় আকাশে পানি তুলে সেটা আবার ছেড়ে দেয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পদ্মা নদীতে টর্নেডো, পানির স্তম্ভ উঠে গেল আকাশের দিকে