জনপ্রশাসনে ৭৬৪ কর্মকর্তার ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ প্রকাশ্যে এর সমালোচনা করছেন। বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

জনপ্রশাসনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ (অতিরিক্ত সচিব) থেকে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের বঞ্চিত দেখানো সঠিক কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। তাঁরা বলছেন, সবাই তো আর সচিব হবেন না। পাশাপাশি একটি ব্যাচের অনেক বেশি কর্মকর্তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পদোন্নতি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

অর্থসংকটে থাকা সরকার কেন এত তড়িঘড়ি করে অবসরপ্রাপ্তদের সুবিধা দিতে অগ্রাধিকার দিল, সেটা নিয়েও কথা বলছেন কেউ কেউ।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় ১৬ বছরে অবসরে যাওয়া ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়ে গতকাল রোববার প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তাঁরা এখন পদোন্নতি পাওয়া পদ অনুযায়ী মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা পাবেন।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং গত ২৪ ডিসেম্বর জানিয়েছিল বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির জন্য বকেয়া বেতন ও ভাতাদি বাবদ সরকারের ৪২ কোটি টাকা খরচ হবে। এ ছাড়া তাঁদের পেনশন বাবদ বছরে অতিরিক্ত ৪ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে।

সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘পদোন্নতি বঞ্চিত কমিটি থেকে প্রথমে আমাদের সবাইকে বলা হয়েছিল, অতিরিক্ত সচিব থেকে সচিব পদে পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করা হবে না। কারণ, অতিরিক্ত সচিব প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদোন্নতি প্রাপ্ত পদ। আমরা অতিরিক্ত সচিবেরা তা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ১১৯ জনের মধ্যে ৫১ জন অতিরিক্ত সচিবকে সচিব করা হয়েছে, যার মধ্যে ৪৫ জনই একই ব্যাচের। এর মধ্যে অনেকেই কোনো প্রকার বঞ্চনার স্বীকার হননি।’

জানতে চাইলে মাহবুব কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি ব্যাচ থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক কর্মকর্তাকে সচিব করা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এক ব্যাচে এত কর্মকর্তা বঞ্চিত হতে পারে না। সরকার তাঁদের এত সুবিধা দেওয়া ঠিক হয়নি।’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার গঠিত হওয়ার পরই নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে পদোন্নতির জন্য বিক্ষোভ করেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অনেকে। তারপর অনেক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পাশাপাশি অবসরে যাওয়া অনেক কর্মকর্তাকে ফিরিয়ে এনে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয় এবং অবসরে যাওয়া ‘বঞ্চিত’ দাবি করা কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও আর্থিক সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

সরকার গত বছর ১৬ সেপ্টেম্বর ‘বঞ্চনা নিরসন কমিটি’ গঠন করে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে। কমিটিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ এবং আইন ও বিচার বিভাগের একজন করে প্রতিনিধি রাখা হয়। তাঁরা সবাই প্রশাসন ক্যাডারের।

কমিটি সাড়ে চার হাজারের মতো আবেদন বিশ্লেষণ করে ১ হাজার ৫৪০ জনকে ‘বঞ্চিত’ হিসেবে পদোন্নতি ও আর্থিক সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করে। সেখান থেকে সরকার ৭৬৪ জনকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়ে গতকাল প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

এই কর্মকর্তাদের চাকরিতে ফিরতে হবে না। নতুন পদে এক দিনও কাজ করতে হবে না। শুধু আর্থিক সুবিধা পাবেন। মোট আর্থিক সুবিধার অর্ধেক পাবেন চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫), অর্থাৎ আগামী ৩০ জুনের মধ্যে। বাকিটা পাবেন আগামী অর্থবছরে।

সরকারি কর্মকর্তারা ২৫ বছর চাকরি করলে মূল বেতনের ৯০ শতাংশের সমপরিমাণ পেনশন পান। এর অর্ধেক এককালীন দেওয়া হয়। বাকিটা দেওয়া হয় মাস হিসেবে। পাশাপাশি তাঁদের আনুতোষিক, ভবিষ্য তহবিলসহ বিভিন্ন অবসর সুবিধা রয়েছে।

অতিরিক্ত সচিব পদে (গ্রেড-২) মূল বেতন ৬৬ হাজার টাকা থেকে ৭৬ হাজার ৪৯০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। সচিব পদে নির্ধারিত মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা।

একটি ব্যাচকে প্রাধান্য

গতকাল যে ৭৬৪ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১১৯ জনকে সচিব করা হয়েছে।

সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়াদের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এর মধ্যে ৩৫ জনই প্রশাসন ক্যাডারের ‘৮২ নিয়মিত ব্যাচের (১৯৮২ সাল)’ কর্মকর্তা। ‘৮২ বিশেষ ব্যাচ’ থেকে সচিব হন আরও ১০ জন। সব মিলিয়ে বিসিএস ৮২ ব্যাচের ৪৫ জন সচিব পদে পদোন্নতি পেলেন। বিগত সরকারের সময়ে এই ব্যাচ থেকে অনেকে সচিব হয়েছেন। বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, সড়ক পরিবহন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ ১১টি মন্ত্রণালয়ের সচিব ৮২ ব্যাচের।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ৮২ ব্যাচ থেকে সচিব হন আবুল কালাম আজাদ, নজিবুর রহমান, হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের মতো আওয়ামী লীগ সরকারঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা।

জনপ্রশাসনে আলোচনা আছে যে এখন নেতৃত্বে থাকা ৮২ ব্যাচের আমলারা তাঁদের ব্যাচমেটদের পদোন্নতি পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব তৈরি করেছেন।

এক লাফে চার ধাপ পদোন্নতি

পদোন্নতির তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যাঁরা সচিব হয়েছেন, তাঁদের ৫০ জন অতিরিক্ত সচিব পদ থেকে অবসরে গিয়েছিলেন।

সিনিয়র সহকারী সচিব পদ থেকে অবসরে যাওয়া ৯ জনকে সরাসরি সচিব করা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁরা এক লাফে চার ধাপ পদোন্নতি পেয়েছেন।

তাঁরা হলেন সিরাজুল ইসলাম খান, এ জে এম সালাউদ্দিন নাগরি, আখতারুজ্জামান তালুকদার, আবি আবদুল্লাহ, এ কে এম ইহসানুল হক, ফরিদুল ইসলাম, নাজমুল আমিন মজুমদার, মাহফুজুল ইসলাম ও জাহিদুল ইসলাম।

বিসিএস ৫ম (১৯৮৪) ব্যাচে প্রশাসন ক্যাডারে মেধাক্রমে তৃতীয় হয়েছিলেন জাফর সিদ্দিক। তিনি ২০১৭ সালে যুগ্ম সচিব পদ থেকে অবসরে গিয়েছিলেন। এবার মেধাক্রমে তাঁর চেয়ে পিছিয়ে থাকা ১১ জনকে সচিব পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। কিন্তু তাঁকে দেওয়া হয়নি।

জাফর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান সরকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলছে। কিন্তু এখানে বৈষম্য করা হলো।

গতকাল সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়াদের একজন হলেন জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমান। বিসিএস ৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তা উপসচিব হন ২০০১ সালে, যুগ্ম সচিব হন ২০০৪ সালে অতিরিক্ত সচিব হন ২০০৬ সালে। তিনি চাকরি থেকে অবসরে যান ২০১৫ সালে।

মোখলেস উর রহমান বঞ্চিত হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। নিয়মিত পদ হিসেবে তাঁকে সচিব করা হয়েছে ভূতাপেক্ষভাবে। আর চুক্তিতে তিনি এখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে কর্মরত।

বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (পিএটিসি) সাবেক রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, কাউকে কাউকে চুক্তিতে সিনিয়র সচিব করা হয়েছে। আবার তাঁকেই নিয়মিত পদে সচিব হিসেবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, অনেককে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, সবাইকে যদি পদোন্নতি দেওয়া হতো, তাহলে সিনিয়র সচিব পদে থাকা ব্যক্তি ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি নিয়ে আর্থিক সুবিধা নিতে পারতেন। কেউ কেউ কিছুই পেল না, কেউ কেউ অনেক বেশি পেল।

অতিরিক্ত সচিব পদ থেকে অবসরে যাওয়াদের বঞ্চিত বলা যায় কি না জানতে চাইলে আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, যদি সব যোগ্যতা থাকে, তাহলে সচিব না করলে বঞ্চিত বলা যায়। তিনি বলেন, নতুন সরকার এসে তড়িঘড়ি করে যে পদোন্নতি দিয়েছে, সেখানে ভুল হয়েছে। আবার এবারও যাচাই-বাছাইয়ে ভুল হলো।

অবসরপ্রাপ্তদের পদোন্নতি দেওয়া নিয়ে বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের ৩০তম ব্যাচের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আড়াই বছরের বেশি সময় আগে তাঁদের পদোন্নতির সময় হয়। কিন্তু সরকার দিচ্ছে না। তিনি বলেন, তাঁদের পদোন্নতি দিতে সরকারের আর্থিক চাপ খুব একটা বাড়বে না।

‘এটা অনেকটা আত্মসমর্পণের মতো অবস্থা’

সরকারের আয় ও ব্যয়ে এখন সংকটজনক অবস্থা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আয়ে ঘাটতি বেড়েছে। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়ে লাগাম টানতে হচ্ছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ওপর সম্প্রতি বাড়ানো হয়েছে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট)। উদ্যোগ নিয়েও সরকার কর্মচারীদের মহার্ঘ্য ভাতা দেওয়া থেকে আপাতত পিছিয়ে এসেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অবসরপ্রাপ্তদের ফিরিয়ে এনে পদোন্নতি ও আর্থিক সুবিধা দেওয়া সরকারের অগ্রাধিকার তালিকার নিচের দিকে থাকার কথা। আর্থিক চাপ কমলে তখন এসব সুবিধা দেওয়া যেত। এমনও হতে পারত, এখন স্বীকৃতি দেওয়া হলো, টাকা কয়েক বছর পরে দেওয়া হবে।

জাহিদ হোসেন বলেন, মনে হচ্ছে আমলাতন্ত্রের চাপে অথবা তাঁদের সহায়তা পেতে সরকার কাজটি করছে। এটা অনেকটা আত্মসমর্পণের মতো অবস্থা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ও আর থ ক স ব ধ ল গ সরক র সরক র র ল ইসল ম মন ত র

এছাড়াও পড়ুন:

তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়

ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত হয়েছিল সংবিধানে, তা–ই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে আপিল বিভাগে এ–সংক্রান্ত শুনানিতে বলেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল–পরবর্তী নির্বাচনগুলোর চিত্র দেখিয়ে জয়নুল আবেদীন বলেছেন, ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন এবং ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে—দেশের জনগণ এমন বিতর্কিত কোনো নির্বাচন হোক, তা চায় না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ওপর আজ রোববার ষষ্ঠ দিনের মতো শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে বিএনপি মহাসচিবের আপিল–সংক্রান্ত শুনানি করেন জয়নুল আবেদীন।

সকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। বেলা ১১টা থেকে মাঝে বিরতি দিয়ে ১টা পর্যন্ত শুনানি চলে। পরবর্তী শুনানির জন্য মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দিন রাখা হয়েছে। এদিন বিরতির পর শুনানি শুরুর আগে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে আসেন বাংলাদেশে সফররত নেপালের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ মান সিং রাউত। বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে বসে এই শুনানি পর্যবেক্ষণ করেন তিনি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেই একটি আলোচিত বিষয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে যুক্ত করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পর সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে এই ব্যবস্থা বাতিল করে। তার আগে সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

ওই রায়ের ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও আপিল বিভাগের রুলসের ব্যত্যয় ঘটেছে দাবি করে শুনানিতে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রায়ে সইয়ের আগেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ সংশোধনী) করে। পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও স্বাক্ষরের (বিচারপতিদের রায়ে সই করা) আগে সরকার সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের বলে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে, যা দেশবাসীর জানা। দেশের বিবেকবান মানুষ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে এই সংবিধান সংশোধনকে সরকারের হীন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল। এটি জনগণের বিরুদ্ধে বড় ষড়যন্ত্র।’

বিএনপির একসময়ের আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদীন শুনানিতে বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করেছেন। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে বহাল রাখার লক্ষ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি (বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক) দেশের প্রচলিত আইন ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুলস যথাযথভাবে অনুসরণ না করে সর্বশেষ (পূর্ণাঙ্গ রায়) রায় দেন, যা প্রথমে দেওয়া রায়ের (শর্ট অর্ডার সংক্ষিপ্ত রায়) সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।’

শুনানিতে অবসরের পর রায়ে সই প্রসঙ্গ

অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করলে তার আইনগত মূল্য কী হবে—এ প্রসঙ্গ ওঠে শুনানিতে। বিরতির পর শুনানিতে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিবের অপর আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, রায় ঘোষণা ও রায়ে সই করা দুটি ভিন্ন বিষয়। রায় ঘোষণার সময় এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদে আসীন ছিলেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে যা ছিল, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা পরিবর্তন করা হয়েছে।

দেওয়ানি কার্যবিধি, আপিল বিভাগের রুলস ও সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘শর্ট অর্ডারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ে যে পার্থক্য, তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করেছেন একজন বিচারপতি। এই বিচারপতিও বলেননি অবসরের পরে বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা রায়টি অবৈধ হয়েছে। স্বাক্ষর পরে করেছেন বলে রায় অবৈধ বলা যাবে না। কারণ, অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করতে পারবেন না কিংবা কত দিনের মধ্যে সই না করলে সেটি অবৈধ হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আইনে নেই।’

রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘প্রকাশ্য আদালতে কোনো বিচারপতি যখন কোনো রায় দেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে দিলে ছোটখাটো দাড়ি, কমা, শব্দ বাদ পড়েছে—এগুলো ছাড়া যেকোনো পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই সেটি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) ছাড়া হবে না, যার ওপর শুনানি চলছে।’

এ মামলায় সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়। ওই প্রসঙ্গে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক বলেন, ‘অবসরের পর রায়ে সই করলে তা বাতিল বা অকার্যকর হবে না। যেদিন প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করলেন, সেই তারিখ হচ্ছে মূল। এটি হচ্ছে রায়ের তারিখ। কবে সই করলেন, এটি প্রাসঙ্গিক নয়। আপিল বিভাগের রুলসে বলা আছে, এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধির (সিপিসি) বিধান কার্যকর হবে না। আপিল বিভাগের জন্য সিপিসি প্রযোজ্য নয়।’

মামলার পূর্বাপর

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন পৃথক আবেদন (রিভিউ) করেন। সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।

রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে অপর রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এ অনুসারে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের করা রিভিউসহ অপর রিভিউ আবেদন এবং বিএনপির মহাসচিবের আপিল শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।

পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের ওপর ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। এরপর ইন্টারভেনার হিসেবে যুক্ত সংগঠনের পক্ষে শুনানি করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। এরপর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল এবং এ এস এম শাহরিয়ার কবির শুনানি করেন। শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য উপস্থাপনের পর হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (রিভিউ আবেদনকারী) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক শুনানি করেন। এরপর বিএনপির মহাসচিবের পক্ষে জয়নুল আবেদীন শুনানি শুরু করেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পর গত আগস্টে বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার হন। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আপিল বিভাগের বিচারকাজ পর্যবেক্ষণ করলেন নেপালের প্রধান বিচারপতি
  • তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়
  • বিশ্ব শিক্ষক দিবস: রাবিতে ৩ অধ্যাপককে সম্মাননা
  • টি-টোয়েন্টি থেকে উইলিয়ামসনের অবসরের ঘোষণা
  • ৩০ বছরের শিক্ষকতা জীবনের ইতি টানলেন মুজিবুর রহমান