হাসিনা ও সহযোগীদের বিচার করতেই হবে
Published: 13th, February 2025 GMT
চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শত শত হত্যাকাণ্ড, মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর পেছনে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ কীভাবে দায়ী ছিল, তার অসংখ্য তথ্যপ্রমাণ গত কয়েক মাসে দেশের গণমাধ্যম, সরকারের তদন্ত সংস্থা এবং মানবাধিকার সংগঠনের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে আসছিল। এবার জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন সেই সত্যকেই নিরেট ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিল। কেননা, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) অনুসন্ধানী দল শেখ হাসিনা সরকার ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে।
বুধবার জেনেভা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ১০৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। জাতিসংঘের দলটি প্রতিবেদন তৈরির জন্য ঢাকা, চট্টগ্রামসহ আটটি বড় শহর, যেখানে বেশি মাত্রায় বিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছিল, সেখানে গিয়ে অনুসন্ধান চালায়। প্রতিবেদন তৈরির জন্য তারা অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যাঁরা ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবগত, তঁাদের সাক্ষাৎকার নেয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণের বিরোধিতার মুখেও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিল সাবেক সরকার। আর সে লক্ষ্য পূরণে বিক্ষোভ দমন করতে ‘পরিকল্পিত’ ও ‘সমন্বিত কৌশলের’ মাধ্যমে নৃশংসতা চালিয়েছিল। তাঁর এই অভিমত অত্যন্ত যৌক্তিক। কেননা, পরপর তিনটি জোরজবরদস্তির নির্বাচন করার পর নাগরিকদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে নেমে এসেছিল।
জাতিসংঘের অনুসন্ধানী দলের তথ্যমতে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের ১২-১৩ শতাংশ শিশু। তাঁদের বেশির ভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর মারণাস্ত্র ও শটগানের গুলিতে নিহত হয়েছেন। অনেককে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ‘টার্গেট কিলিং’ করা হয়েছে। হাজারো মানুষ গুরুতর ও চিরতরে আহত হয়েছেন। ১১ হাজার ৭০০-এর বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হন।
এসব পরিসংখ্যান শুধু অপরাধের ভয়াবহতা ও বিস্তৃতিকেই প্রকাশ করে না; অভ্যুত্থানে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাপ্রবাহের বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণকেও হাজির করে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন স্পষ্ট করে বলেছে, স্বৈরাচারী সরকার নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, দল ও সহযোগী সংগঠনকে যুক্ত করে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে। আন্দোলনকারীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
আমরা মনে করি, জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রকাশের পর জুলাই-আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানে সংঘটিত শত শত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাপ্রবাহের সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি নতুন মাত্রা পেল। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব ও আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার যাঁরাই এসব গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের সবাইকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
ফলকার টুর্ক অপরাধীদের ফেরাতে ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশনের প্রয়োগ, আইসিসিতে অনুরোধ জানানোর কথা বলেছেন। আমরা আশা করি, শেখ হাসিনাসহ পলাতক অপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকার এটিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাবে।
জাতিসংঘ দলের প্রতিবেদনে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণে জড়িত ব্যক্তিরা দায়মুক্তি ভোগ করছেন। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনার ক্ষেত্রেও পক্ষপাতহীন পদক্ষেপ নেবে।
জাতিসংঘ তাদের প্রতিবেদনে র্যাব ও এনটিএমসিকে বিলুপ্ত করা, অবাধ নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা, রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ না করাসহ ৫০টির মতো সুপারিশ দিয়েছে। আমরা আশা করি, এসব সুপারিশ সরকার গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেবে। সর্বোপরি, জুলাই-আগস্টের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর ন্যায়বিচার এবং নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পথে উত্তরণই বাংলাদেশকে বিগত স্বৈরশাসনের দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখাতে পারে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র ত হয় ছ অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
ফোনে খালেদা জিয়া বললেন, ‘ভাই, জিয়াকে ড্রয়িংরুমে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।’
৭৫-এর উত্তপ্ত নভেম্বর
শেখ মুজিব হত্যার পর বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ছিল দ্বিধাগ্রস্ত এবং দেশ প্রতিদিন অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় এসেই আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা সর্বজনাব নজরুল ইসলাম তাজউদ্দীন আহমেদ, মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও আবদুস সামাদ আজাদকে আটক করেন এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করে রাখেন। বাতাসে প্রতিনিয়ত নানা গুজব উড়ছিল ও সাধারণ নাগরিকগণ ভয়ভীতির মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। সেনানিবাসেও অস্থিরতা বিরাজ করছিল এবং ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, নিজেদের মধ্যে যে-কোনো সময়ে সংঘর্ষ বেঁধে যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে আর্মিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি ছিল।
পদাতিক বাহিনীর মধ্যে, বিশেষ করে ঢাকা ব্রিগেডের ১ম, ২য় ও ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারগণ মেজর ফারুক, রশিদ ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছিল এবং আর্মির চেইন অফ কমান্ড পুনঃস্থাপনের জন্য তৎকালীন ব্রিগেড অধিনায়ক কর্নেল শাফায়াত জামিলও অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। কারণ তাঁর অধীনস্থ অফিসার ও সৈন্যগণই তাঁর সার্বিক কর্তৃত্ব উপেক্ষা করে শেখ মুজিব হত্যায় জড়িত ছিল। এ পরিস্থিতিতে সেনাসদরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফও সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসারদের অনিয়ম ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির কথা বলে উত্তেজিত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন।
মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.) বীরবিক্রম