Samakal:
2025-11-03@19:04:08 GMT

আনিসুজ্জামান আমার স্মৃতিতে

Published: 13th, February 2025 GMT

আনিসুজ্জামান আমার স্মৃতিতে

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে প্রথম খুব কাছ থেকে দেখি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের চত্বরে। সঙ্গে আরও কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন। এর আগে দূর থেকে দেখেছি বাংলা একাডেমি, বুলবুল একাডেমি আর পাকিস্তান কাউন্সিলের কয়েকটি সভায়। বিভিন্ন দৈনিকের কিছু খবরেও তখনই তাঁর নাম গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হতো। 
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চাটগাঁয় কালুরঘাট বেতার ও সেতুকে ঘিরে এক বড় প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। সেতুর সন্নিহিত কধুরখীল, গোমদন্ডী, গোপাদিয়া, সাহরাস্থাতলীতে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা ঢুকতে পারেনি। এই সময়ে আমি ওই অঞ্চলেই ছিলাম। কালুরঘাটে পশ্চাৎপসরণের পর চাটগাঁয় প্রতিরোধের কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা তখন সেখানে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন। নানা রকম উত্তেজনাকর খবর আসত প্রতিদিন। তখন শুনেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড.

এ. আর মল্লিককে প্রধান করে বাংলাদেশের একটি অস্থায়ী সরকার গঠিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের এই কার্যক্রমে তখন বারবার ড. আনিসুজ্জামানের নাম শুনেছি। 
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল আমাদের সবার প্রেরণার উৎস। তখন নানা খবরে ও কথিকায় আনিসুজ্জামান ছিলেন সরব। 
১৯৭৪-৭৫ সালে স্যারকে ঢাকায় খুব একটা দেখিনি। ওই সময় তিনি লন্ডনের সোয়ান্সে ছিলেন। দেশে ফেরেন ১৯৭৫-এর মর্মান্তিক ঘটনার পরে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আসতেন প্রধানত পরীক্ষার কাজে। ’৭৫-এর আগস্টের পর বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগের পরিবেশ বদল ঘটে। ’৭৭-এ আমাদের এমএ পরীক্ষা হলো। মৌখিক পরীক্ষা নিতে এলেন আনিসুজ্জামান স্যার। আমাকে প্রশ্ন করলেন বঙ্কিমচন্দ্রের ১৪টি উপন্যাস নিয়ে। সব প্রশ্নের যে ঠিক উত্তর দিতে পেরেছিলাম এমন মনে হয় না। পরীক্ষার পর দেখলাম বারান্দা দিয়ে বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে গল্প করতে করতে চায়নিজ খেতে যাচ্ছেন। 
পরীক্ষার পরের দিন হোটেল পূর্বাণীতে জাতিসংঘ দিবস অনুষ্ঠান। আমি তখন বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির সঙ্গে বেশ জড়িয়ে পড়েছি। সমিতির কর্তা স্যারের কলেজ জীবন ও পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেন। অনুষ্ঠানের পর ঘণ্টাখানেক সময় তাঁর সঙ্গে কথা হলো। তাঁর স্নেহপ্রবণ মনটি সেদিনই আমার কাছে উদ্ভাসিত হলো। 
এমএ পরীক্ষার পর আমি বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস (বিভিএস) নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসে গঠিত এর কাজ ছিল শরণার্থীদের শিক্ষা ও সহায়তাদান। ’৭৫-এর পর এর কার্যালয় ছিল ঢাকার ৫৫ দিলকুশায়। 

অক্সফাম, কেয়ার, ফুড ফর হাংরি, জাইকা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান বিভিএস-এর মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে কাজ শুরু করেছিল। ১৯৭৮ সালে ডেনমার্কের সাহায্য সংস্থা ডিনিডা প্রথম বাংলাদেশে কাজ করতে আসে। প্রায় ৫৫ জন ডেনিশ স্বেচ্ছাসেবীকে বাংলা শেখানোর দায়িত্ব পড়ে বিভিএস-এর ওপর। বিভিএস-এর প্রধান নির্বাহী অধ্যক্ষ মামুন-অর-রশীদ এ জন্য একটি বাংলা শিক্ষার বই তৈরি করেন। আমি সেটি নিয়ে চাটগাঁ যাই স্যারকে দেখাতে। স্যার কিছু সংশোধন করে দেন। 
বছরের মাঝামাঝি চাটগাঁর হোটেল আগ্রাবাদ ডেনিডার স্বেচ্ছাসেবকদের দুই মাসের কোর্স শুরু হয়। আমি এর তত্ত্বাবধানের জন্য হোটেল আগ্রাবাদে আবাস গড়ি। আনিসুজ্জামান স্যারই এর শিক্ষক ঠিক করে দেন। ভাষাশিক্ষার বাইরে বাংলাদেশের সমাজ সম্পর্কেও ডেনিডার স্বেচ্ছাসেবকদের ধারণা দেওয়ার চেষ্টা চলে। স্যার আমাকে নিয়ে যান বিভিন্ন বক্তাকে বক্তব্যদানে অনুরোধ করতে। পরে এই বক্তব্যগুলো শ্রুতলিখন করে একটি বই তৈরি করি। বাংলাদেশের পরিচয়মূলক ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটি ‍Aspects of Bangladesh নামে প্রকাশিত হয় স্যারের ভূমিকা নিয়ে। একদিন ডেনিডা স্বেচ্ছাসেবকরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে যান। স্যারই এর সব ব্যবস্থা করেন। এভাবে প্রায় দুই মাস আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয় আমার। 
১৯৭৮-৭৯-এর দিকে স্যার আবার বিলেত প্রবাসী হন। ’৭৯-এর আগস্টে সুইডেন থেকে আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল নিয়ে ফেরার পথে লন্ডনে থামি। তখন বিমানের একটি বোয়িং। খবর পাওয়া যায়, সেটি ঢাকায় বিকল হয়ে আছে। আসতে সপ্তাহখানেক লাগবে। চারজন শিশু নিয়ে আশ্রয় নিই ছোট চাচার বাসায়। তিনি তখন বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিব। টেলিফোনে খোঁজাখুঁজি করে স্যারকে পাওয়া গেল বিবিসির স্টুডিওতে। পরদিন চাচার বাসায় স্যার আমাকে দেখতে এলেন। অনেক দিন পরে দেখা; সন্ধ্যার গল্প শেষ হতে রাত হলো। ঠিক হলো তিন দিন পর শনিবার স্যার আমাকে অক্সফোর্ড দেখাতে নেবেন। 
শনিবার সকালে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্টেশনে স্যারের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সাইনবোর্ডের নিচে দাঁড়ালাম। অচেনা জায়গা, কয়েক মিনিটের মধ্যে স্যার পৌঁছে গেলেন। প্রথমে লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেই বাসের টিকিট করলেন। বাস ছাড়তে দেরি আছে। স্যার লাইনে দাঁড়িয়ে ক্যাফে থেকে পেস্ট্রি আর কফি নিলেন। আনাড়ি আমি শুধু খেয়েই সাহায্য করলাম। লন্ডন থেকে অক্সফোর্ড দুই ঘণ্টার পথ। স্যার আমাকে জানালার কাছে বসতে দিলেন। তবে দু’পাশের দৃশ্য দেখার চেয়ে স্যারের কথার দিকে আমার আকর্ষণ বেশি। স্যার অক্সফোর্ড আর কেমব্রিজের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মিল-অমিল নিয়ে বলছিলেন। আমাকে সুইডেনের স্কুল ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন করলেন। 
অক্সফোর্ডে বাসস্ট্যান্ড থেকে আমাদের নিতে আসেন ড. হামিদা হোসেন। অক্সফোর্ড শহরে একটা চক্কর দিয়ে তার বাসায় মধ্যাহ্নভোজে। ড. কামাল হোসেন খাবার সময় বাসায় এলেন। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে নানা কথা হলো। বিকেলে হামিদা ভাবি অক্সফোর্ডের নানা স্থান ঘুরে দেখালেন। ইতিহাসের বই আর ছবির মাধ্যমে চেনা ভবনগুলো চোখের সামনে দেখে যেন শিহরিত হচ্ছিলাম। স্যার বিভিন্ন ভবনের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য আর শিল্পকলা সম্পর্কে মাঝে মাঝে বলছিলেন। ইতিহাস আর শিল্পকলায় স্যারের আগ্রহ ওই প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম। সন্ধ্যায় আমাকে লন্ডনের বাসে উঠিয়ে দিয়ে স্যার অক্সফোর্ডে রয়ে গেলেন।

স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হলে, স্যার এর ট্রাস্টি হন। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে আমি রমেশ শীলের হাতের লেখা পাণ্ডুলিপি আর তার বইপত্র নিয়ে কাজ করছিলাম। রমেশ শীলের বাড়ি আমার গ্রামের বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে রাজাকাররা রমেশ শীলের বাড়িতে কয়েকবার লুণ্ঠন করে। তাঁর পরিজন ভয় পেয়ে কবিয়ালের লেখালেখি সুপারিবাগিচায় ফেলে দেয়। পরে উদ্ধার করলেও এর বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়। আমি স্যারকে এ বিষয়ে জানালে তিনি এসব উপকরণ সম্পর্কে আগ্রহ দেখান। আশির দশকে শুরুতে একটা পরিদর্শক দল রমেশ শীলের গোমদীর বাড়িতে যায়। এ দলে স্যারের সঙ্গে ছিলেন শিল্পী মর্তুজা বশীর। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে আমি দলের সঙ্গে যোগ দিই। রমেশ শীলের বৃদ্ধ স্ত্রী এবং পরিবারের অন্যরা আমাদের সব উপকরণ দেখার ব্যবস্থা করেন। পরে রমেশ শীলের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, মুদ্রিত বইপত্র,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়। এ  কারণে পরিবারের জন্য ৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। উপকরণগুলো বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরে আছে।
১৯৮৩ সালের মাঝামাঝি নাগাদ আমার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের প্রথম খসড়া তৈরি হয়। হাতের লেখায় হাজারখানেক পৃষ্ঠা। আমি ভাবছিলাম টাইপরাইটারে যাওয়ার আগে একবার স্যারকে দেখাতে পারলে ভালো হতো। স্যারের পরামর্শ অনুযায়ী পুরো পাণ্ডুলিপি নিয়ে সরাসরি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্যারের বাসায় চলে যাই। স্যার সারাদিন কাজ করে রাতের খাবারের পর আমার জিনিস নিয়ে বসতেন। কোনোদিন রাত একটা-দেড়টা, কোনোদিন তারও বেশি। ভাবি আমাদের আপ্যায়ন করে যেতেন অবিরাম। এ রকম চলছিল সপ্তাহের বেশি। নিজের গবেষণা–ছাত্রদের তো বটেই, পরিচিত অনেক গবেষককেই এ রকম সাহায্য করতেন স্যার। সেবার সপ্তাহের বেশি বাসায় থাকার ফলে স্যারের পরিবারের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠতার সৌভাগ্য হয়েছিল, তা আর কখনও ছিন্ন হয়নি। স্যারের তিন সন্তান– রুচি, সূচি ও আনন্দও আমাকে এবং পরে আমার পরিবারের সবাইকে একান্ত আপন করে নিয়েছিল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের পত্রিকা পাণ্ডুলিপি সম্পাদনকালেও আনিসুজ্জামান একে পরিকল্পিতভাবে উঁচুমানের গবেষণা পত্রিকায় রূপ দিতে চেয়েছিলেন। আমি রমেশ শীলের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি থেকে কবিয়ালের অপ্রকাশিত কবিতার একটি সংকলন তৈরি করি। স্যার অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পুরো সংকলন পাণ্ডুলিপিতে ছাপেন। আরও আনন্দের কথা, সংকলনটি একটি প্রথম মেনাগ্রাফ হিসেবেও ছাপা হয়। 
১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর আমাদের বিয়েতে স্যার এলেন চাটগাঁ থেকে। তখন তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। এটি ছিল স্যারের স্বভাবের মধ্যেই। জাতীয় জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যের সমান্তরালে স্যার তাঁর স্নেহের মানুষদের ব্যক্তিগত-পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন গভীর আন্তরিকতা নিয়ে। দেশ-বিদেশের শত শত পরিবার ছিল যেন স্যারেরই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে স্যারের পকেটমার যায়। তাতে রাতের ট্রেনে চাটগাঁ ফিরে যাওয়ার টিকিটও। ক’দিন পরে স্যার একটি হরিণের চামড়ার ব্যাগ নিয়ে আসেন আমাদের বাসায়, বিয়ের উপহার।
১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি স্যার ঢাকায় আসেন। তারপর পুরো তিনটি যুগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। আমাদের অনেকের সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সঙ্গে এক বিভাগে কাজ করার। একই বিভাগে ক্লাস নেওয়া, পরীক্ষার জন্য হলে পর্যবেক্ষণ, বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কাজ– তাতে কত স্মৃতি! শিক্ষক হিসেবে, গবেষক হিসেবে, গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে, পণ্ডিত হিসেবে, বক্তা হিসেবে, সংগঠক হিসেবে, স্যারের বিচিত্র রূপ যেন ‘নানা আনিসুজ্জামানের মালা’। দেশ-বিদেশের কত দুর্লভ সম্মান পেয়েছেন তিনি। অথচ কখনও তাঁকে দেখে মনে হতো না অত বড় মানুষ।
তাঁর স্মৃতি অল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়; তাঁর মতো স্মৃতিশক্তি আর পরিমিতিবোধ অর্জন করতে পারিনি বলে। v
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স য র আম ক পর ব র র অন ষ ঠ ন পর ক ষ র ব যবস থ র পর ব ক জ কর ব ভ এস আম দ র তখন ব প রথম র একট

এছাড়াও পড়ুন:

খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপির নির্বাচনী যাত্রা শুরু

সব জল্পনার অবসান হলো—বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন করছেন। তিনি ফেনী-১, বগুড়া-৭ ও দিনাজপুর-৩ আসনে প্রার্থী হবেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সোমবার বিএনপি ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তাতে দলের দুই শীর্ষ নেতার নির্বাচন করা এবং তাঁদের নির্বাচনী আসনগুলো নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও-১ আসনে নির্বাচন করবেন।

তারেক রহমান বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন, অনেক আগে থেকেই এমন আলোচনা আছে। তবে অসুস্থতার কারণে এবার খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংশয় ছিল। আবার তাঁর নিজেরও নির্বাচন করার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না।

দলীয় সূত্র বলছে, নির্বাচন ঘিরে নানামুখী শঙ্কা, বিশেষ করে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে নেতৃত্ব দিতে রাজি করানো হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রার্থী হওয়ার ঘোষণায় নেতা-কর্মীরা আনন্দিত।

স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, নানা কারণে আসন্ন নির্বাচন বিএনপির জন্য খুব স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচন করতে রাজি করানোর মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে নির্বাচনের গুরুত্বটা আরও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে নতুন কোনো জটিলতার উদ্ভব হলে, সেটা মোকাবিলায়ও তাঁর ভোটে অংশগ্রহণ পরিস্থিতির ওপর একটা প্রভাব ফেলবে।

জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে সোমবার ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। বাকি ৬৩টি আসনে প্রার্থিতা পরে ঘোষণা করা হবে।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, স্থগিত রাখা কিছু আসনে প্রার্থিতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে। আর কিছু আসন জোট ও সমমনা দলগুলোর প্রার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে, যাদের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে।

ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী, বিএনপির চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির ১২ জন সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। অন্যরা হলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন (কুমিল্লা-১), মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ (ঢাকা-৮), গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (ঢাকা-৩), আবদুল মঈন খান (নরসিংদী-২), আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১০), ইকবাল হাসান মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), সালাহউদ্দিন আহমদ (কক্সবাজার-১), হাফিজ উদ্দিন আহমদ (ভোলা-৩) এবং এ জেড এম জাহিদ হোসেন (দিনাজপুর-১)।

স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। তবে তিনি বলেছেন, এটি প্রাথমিক তালিকা। প্রয়োজন বোধ করলে স্থায়ী কমিটি প্রার্থিতা পরিবর্তন করতে পারবে।

এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।

সোমবার বিকেল পাঁচটার দিকে প্রার্থী ঘোষণার আগে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী সভা হয়। সেখানে জুলাই সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়। পরে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকেরাও উপস্থিত ছিলেন।

এবারের প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। তাঁকে ফেনী-৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনে প্রথম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছি। দল আমার ওপর আস্থা রেখেছে, সে আস্থা রাখার জন্য ধন্যবাদ। আমি আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে দেখা করব, সালাম জানাব।’

যে কারণে ঢাকার সাতটি আসন ফাঁকা

ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে ১৩টিতে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সাতটি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, ঢাকায় প্রার্থিতা নিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। তাঁদের ধারণা, নির্বাচনী সমঝোতার জন্য আসনগুলোতে প্রার্থিতা স্থগিত রাখা হয়েছে।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সাতটি আসনের মধ্যে জাতীয় নাগরিক পাটির (এনসিপি) সঙ্গে সমঝোতা হলে তাদের জন্য অন্তত তিনটি আসন ছাড় দেওয়া হতে পারে। এ তালিকায় গণতন্ত্র মঞ্চ, বিজেপি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নামও আছে।

তবে এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।

ঢাকা-৯ আসন স্থগিত রাখা হলেও সেটা কার জন্য, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সেখানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবীব উন নবী খানকে (সোহেল) প্রার্থী করা হতে পারে বলে দলে আলোচনা আছে।

ঢাকা-১৪: মায়ের ডাক-এর সানজিদা

ঢাকা-১৪ আসনে এবার প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়লেন এস এ খালেকের ছেলে এস এ সিদ্দিক (সাজু)। সেখানে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের ব্যক্তিদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সংগঠক সানজিদা ইসলামকে (তুলি) প্রার্থী মনোনীত করেছে বিএনপি। এই আসনে ইতিমধ্যে জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার মীর আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান)। তিনি আট বছর গুম ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান।

সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে দলটি অভ্যন্তরীণ জরিপসহ সাংগঠনিক উপায়ে প্রার্থী বাছাই সম্পন্ন করেছে। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের নাম প্রকাশ করে নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করল বিএনপি।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বিগত ১৫-২০ বছর ভোট দিতে পারেনি। এখন জাতি উৎসাহিত হচ্ছে ভোটের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। তিনি বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি পূরণ করার লক্ষ্যে বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণা করে একটা বড় পদক্ষেপ নিল। ইতিমধ্যে অনেকে মাঠে চলে গেছেন, এ ঘোষণার পর বাকিরাও মাঠে যাবেন। এর মাধ্যমে ভোটের একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হবে।

১০ নারী প্রার্থী

ঘোষিত ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকায় নারী রয়েছেন দশজন। এর মধ্যে অন্যতম বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাকিরা হলেন সিলেট-২ আসনে তাহসিনা রুশদীর, ফরিদপুর-২ আসনে শামা ওবায়েদ ইসলাম, ফরিদপুর-৩ আসনে নায়াব ইউসুফ আহমেদ, মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আফরোজা খান রিতা, শেরপুর-১ আসনে সানসিলা জেবরিন, ঝালকাঠি-২ আসনে ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো, যশোর–২ আসনে সাবিরা সুলতানা, ঢাকা-১৪ আসনে সানজিদা ইসলাম ও নাটোর-১ আসনে ফারজানা শারমিন।

মনোনয়ন না পেয়ে দুই মহাসড়ক অবরোধ

মাদারীপুর-১ আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করে কামাল জামান মোল্লাকে। এর প্রতিবাদে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী সাজ্জাদ হোসেন লাভলু সিদ্দিকীর অনুসারীরা রাত আটটার দিকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন।

চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তাঁর অনুসারীরা সন্ধ্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ