প্লটে নয়, সিডিএর মনোযোগ ফ্ল্যাটে
Published: 13th, February 2025 GMT
চট্টগ্রামকে একটি পরিকল্পিত, আধুনিক নগর ও বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তোলার মূল দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)। নগরবাসীর জন্য আবাসন নিশ্চিত করার কাজও এ সংস্থার। সিডিএর গত ১৫ বছরের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলীরা বলছেন, পরিকল্পিত চট্টগ্রাম গড়ার চেয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বেশি নজর দিয়েছে সিডিএ। বিশেষ করে উড়ালসড়ক ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে মনযোগ ছিল তাদের। সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজও ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তারা। এসব কাজ করতে গিয়ে নগরবাসী আবাসন নিশ্চিতের দায়িত্বটি ছিল উপেক্ষিত। এছাড়াও নকশা অনুযায়ী ইমারত বা ভবন নির্মিত হচ্ছে কি না, তাও ঠিকভাবে তদারকি করেনি সংস্থাটি। ফলে অপরিকল্পিত নগরায়নে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম বলেন, ‘আবাসন প্রকল্পের দিকে খুব বেশি আগ্রহ নেই। আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা মানে মধ্যবিত্তের জায়গাগুলো অধিগ্রহণ করে উচ্চ মধ্যবিত্ত বা বিত্তশালীদের কাছে বিতরণ করে দেওয়া। সিডিএর দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম, অনেক সংসদ সদস্য কয়েকটা করে প্লট নিয়েছেন। অথচ প্লট নেওয়ার আগে অঙ্গীকার করতে হয়, চট্টগ্রাম শহরে তার কোন জায়গা নেই। যেসব সংসদ সদস্য প্লট পেয়েছেন তাদের কি চট্টগ্রাম শহরে জায়গা ছিল না? ঢাকা-চট্টগ্রামে কয়টা বাড়ি আছে ঠিক নেই। তবুও এক-দুটো প্লটের লোভ তারা সামলাতে পারেননি।’
তিনি বলেন, ‘যেসব আবাসিক প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেখানেও নাগরিক সুযোগ সুবিধা না থাকায় ভবন নির্মাণ করা হয়নি। সেগুলোকে কীভাবে বসবাসযোগ্য করা যায়, সেটা নিয়ে আমরা পরিকল্পনা করছি। এছাড়া প্লট না দিয়ে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে বরাদ্দ দেয়া যায় কি না সেটা চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।’
সিডিএ সূত্র জানায়, সিডিএর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের একটি ছিল পরিকল্পিত আবাসন নিশ্চিত করা। কিন্তু ২০০৫ সালের পর থেকে আর কোনো আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেনি সিডিএ। ২০১৭ সালে অনন্যা আবাসিক এলাকা দ্বিতীয় পর্যায় নামের একটি প্রকল্প নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে সরে এসেছে সংস্থাটি। যদিও এই প্রকল্পের আওতায় বিদেশ সফর করেছিলেন সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
প্রতিষ্ঠার পর সিডিএ প্রথম আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ১৯৬৩ সালে কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকায়। এরপর আরও ১১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিল। তবে ১৯৯৫ সালে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাশে কর্ণফুলী আবাসিক এলাকা এবং ২০০৫ সালে নেওয়া অনন্যা আবাসিক এলাকায় এখনো কোনো ভবন নির্মিত হয়নি। ন্যূনতম নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না হওয়ায় এসব আবাসিক এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে পারছেন না প্লটের মালিকেরা।
পরিকল্পিত নগরায়ণের ক্ষেত্রে সিডিএর যে ধরনের ভূমিকা পালন করার কথা ছিল, তা করেনি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি বলেন, ‘এই দায়িত্ব পালনের চেয়ে জলাবদ্ধতা প্রকল্প, উড়ালসড়ক ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের মতো অবকাঠামোগত উন্নয়নে বেশি মনোযোগ দিয়েছে সংস্থাটি। এগুলো অন্য সংস্থার কাজ। সিডিএর এমন ভূমিকার কারণে নগরের মানুষকে ভুগতে হচ্ছে।’ সিডিএর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১২টি আবাসিক প্রকল্প নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব আবাসিকে ৬ হাজার ৭৫৬টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আবাসিক প্রকল্পগুলোর মধ্যে আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকায় প্লট রয়েছে ৩৯১টি, চান্দগাঁও আবাসিকে রয়েছে ৭৫৯টি, চান্দগাঁওয়ে ৮২টি, চন্দ্রিমায় ১৮০টি, কল্পলোকে প্রথম পর্যায়ে ৪২৩ ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ১ হাজার ৩৫৬টি এবং কাতালগঞ্জে প্লট রয়েছে ৫৮টি।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ঘুঘুডাঙ্গার মনোরম তালসড়ক
অক্টোবরের প্রথম দিকে লম্বা এক ছুটিতে বেড়াতে গেলাম বগুড়া। দেশের উত্তরের জনপদ বরাবরই আমার পছন্দ। মানুষ কম, হালকা বসতি। পথে বা হাটবাজারে ততটা ভিড়ভাট্টা নেই। বাজারে কম দামে টাটকা শাকসবজি মেলে। এসব কেনার চেয়ে দেখেই তুমুল আনন্দ পাই। নিঝুম গ্রামের ভেতর ফসলের মাঠে ছড়িয়ে থাকা বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি বেশ উপভোগ করি। যত দূর চোখ যায়Ñ গ্রামের পর গ্রাম। মুঠো মুঠো সবুজের ভেতর এঁকেবেঁকে ছুটে চলা মেঠো পথ মাড়িয়ে আমরা প্রতিদিন দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। দিনের মুহূর্তগুলো মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কতটা নিপুণভাবে ক্ষণে ক্ষণে বদলে যেতে পারে,Ñ এসব গ্রামে না এলে তা বোঝার উপায় নেই। কৃষিনির্ভর এই জনপদে প্রতিমুহূর্তের ব্যস্ততা যেন অনিবার্য নিয়তি।
বগুড়ার গ্রামীণ জনপদ ঘুরে, দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে মনে হলো যথেষ্ট নয়! চোখের তৃষ্ণা মেটেনি। মনের ক্ষুধাও যায়নি! তখনই মনে পড়ল নওগাঁর ঘুঘুডাঙ্গার বিখ্যাত তালসড়কটির কথা। এত কাছে এসে তালসড়কটি দেখতে যাব না, তা কি হয়? স্থানীয় সাংবাদিক আনোয়ার পারভেজ বললেন, ‘বগুড়া থেকে মাত্র ৩ ঘণ্টারই তো জার্নি। ঘুরে আসুন।’ আমারও মনে হলো, এমন একটি অসাধারণ দৃশ্যের জন্য এই দূরত্ব কিছুই না।
সকালে তুমুল বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার থেমেও গেল। গাড়িতে ওঠার সময় স্থলপদ্মের গাছটি চোখে পড়ল। গাছভর্তি ফুলগুলো বৃষ্টির দাপটে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। অথচ বিকেলে ভেবে রেখেছিলাম, সকালে শরতের মধুর আলোয় স্থলপদ্মের ছবি তুলব। তা আর হলো না। দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে গেলাম নওগাঁর সাপাহারের কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানার বাগানে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যখন স্বপ্নমণ্ডিত সেই তালসড়কে পৌঁছাই, তখন ঠিক দুপুরবেলা।
কিন্তু দুপুর হলেও দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখর তালসড়ক। শুধু বৃহত্তর রাজশাহী নয়, দূরদূরান্ত থেকেও পর্যটকেরা এখানে আসেন। নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নে এই তালসড়কের অবস্থান। মূলত ঘুঘুডাঙ্গা-শিবপুর সড়কের দুপাশজুড়ে থাকা বীথিবদ্ধ তালগাছের জন্যই সড়কটি ‘তালসড়ক’ বা ‘তালতলী’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। হাজীনগর গ্রামের মজুমদার মোড় থেকে ঘুঘুডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার সড়কজুড়ে এই তালসড়কের অবস্থান।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন রাস্তা ও খালপাড়ে ৭২০ কিলোমিটারের বেশি জায়গাজুড়ে লাগানো হয়েছে কয়েক লাখ তালগাছ। তখন বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা, পত্নীতলা ও ধামইরহাট, রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, রহনপুর উপজেলার রাস্তার দুপাশে রোপণ করা হয়েছে অনেক তালগাছ। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে অনেক গাছই হারিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে বেঁচে আছে কিছু। তবে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গার এই গাছগুলো এখনো কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। বর্তমানে গাছগুলো ৫০ থেকে ৬০ ফুট উঁচু হওয়ায় রাস্তার দুপাশে শোভাবর্ধন করছে।
একসময় নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙা-শিবপুর সড়কটি ছিল একটি মেঠো পথ। ২০১২ সালের দিকে সড়কটি পাকা করা হয়। বর্তমানে তালসড়কের দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ থাকায় সড়কটি বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
ভাদ্র মাসে তাল পাকার মৌসুমে তালসড়ক ঘিরে উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। নানা স্বাদের তালের পিঠা এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। তবে বেড়াতে আসা পর্যটকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য এখানে মানসম্পন্ন পর্যটনসেবা থাকা প্রয়োজন।
শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলই নয়, বৃহত্তর ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানেও প্রচুর পরিমাণে তালগাছ চোখে পড়ে। খেতের আলপথ, বাড়ির সীমানা, খালপাড়, পুকুরপাড় বা পথের ধারে এসব সুদৃশ্য তালগাছ প্রকৃতিতে ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে থাকা এসব তালগাছের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও আছে। দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দৃশ্যমান তালগাছের রস থেকে ভালো মানের সুস্বাদু গুড় ও মিছরি তৈরি করা হয়। বাজারে এসব গুড়-মিছরির চাহিদাও ব্যাপক। আমাদের দেশেও এসব গাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে তালের গুড় তৈরি করা সম্ভব। প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক