পুলিশের ওপর হামলার সম্ভাব্য পরিণতি
Published: 15th, February 2025 GMT
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে দেশের পুলিশ প্রশাসন কার্যত স্থবির ও অকর্মণ্য হয়ে পড়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষাবলম্বন করায় তারা পড়েছে জনরোষের মুখে। আক্রান্ত হয়েছে থানা, আহত-নিহত হয়েছে বহুসংখ্যক পুলিশ। প্রথম কয়েক দিন কোথাও কোথাও থানাগুলো পড়েছিল জনশূন্য হয়ে। ওসি, এসআই, কনস্টেবল কেউই থাকেননি থানায়। ফলে সংশ্লিষ্ট থানার অন্তর্গত এলাকা হয়ে পড়েছিল নিয়ন্ত্রণহীন। পুলিশের অনুপস্থিতির কারণে দুষ্কৃতকারীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল, ৎনিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করেছিল সাবইকে। এমনকি রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতও ছিল না। সে অবস্থায় বেশ কয়েক দিন শিক্ষার্থীরা নগরীর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। পরে ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হতে শুরু করে। বিভিন্ন থানায় ফিরে আসতে থাকেন পুলিশ সদস্যরা। পুনরায় কার্যক্রম শুরু হয় থানা-পুলিশের। তবে এখনও পর্যন্ত দেশের সব থানায় পুলিশি কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়নি। বরং কোথাও কোথাও বিরাজ করছে বিশৃঙ্খল পরিবেশ।
এমনিতেই আমাদের দেশে পুলিশের ভাবমূর্তি নেতিবাচক, তার ওপর রাষ্ট্রীয় এ বাহিনীটিকে বিগত ক্ষমতাসীন দলের মাস্তান বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করায় জনগণ এর ওপর আর আস্থা রাখতে পারছে না। অথচ একটি সুস্থ সমাজ বিনির্মাণ ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী কতটা প্রয়োজন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থানা-
পুলিশের ওপর হামলার অশুভ প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। ১০ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পর পর তিনটি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দুটি ঘটনাই ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়। একটি নিউমার্কেট থানায়, অপরটি উত্তরা পশ্চিম থানায়। আরেকটি ঘটেছে মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানায়। ১০ জানুয়ারি শ্রীনগর থানায় হামলা ও পুলিশকে মারধর করে আসামি যুবদল নেতা তরিকুলকে ছিনিয়ে নিয়ে যান স্থানীয় বিএনপি কর্মীরা। পরে অবশ্য পুলিশ তরিকুলকে পুনরায় গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। ২৪ জানুয়ারি ঢাকার নিউমার্কেট থানায় হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসী হামলা মামলার নামীয় আসামি ছাত্রদলের এক নেতাকে ছিনিয়ে নিতে হামলা করেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের শ’দুয়েক নেতাকর্মী। যদিও তারা ‘সফল’ হতে পারেননি। তবে পুলিশকে মারধর করেছেন।
এসব ঘটনার দুটি দিক রয়েছে। এক.
নিয়ে পেশিশক্তি প্রয়োগের প্রবণতা। ২০২৪-এর
গণঅভ্যুত্থান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করলেও সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর ক্রিয়াকলাপে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
আমি নিজে এ ধরনের একটি ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। বছর তিনেক আগে ঈদুল আজহার পরের দিন আমাদের উপজেলা সদরের (শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ) একটি কফিশপে বসে আমরা কয়েকজন গল্প করছিলাম। হঠাৎ অল্প বয়সী এক এসআই এসে জিজ্ঞেস করেন, এখানে কী হচ্ছে? আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমাদের কাছে খবর আছে, এখানে বিএনপির মিটিং হচ্ছে। বললাম, এখানে উপস্থিত সবাই বিএনপির কর্মী এটা ঠিক। তবে কোনো মিটিং হচ্ছে না। যদি মিটিং হয়ই, তাহলে কি কোনো সমস্যা আছে? এসআই আরও উচ্চকণ্ঠে বলেন, আপনারা এক্ষুনি এখান থেকে চলে যান। প্রশ্ন করলাম– কেন? তিনি বললেন, আমি বলছি চলে যান। এবার আমি তাঁর চেয়ে কয়েক গুণ উচ্চকণ্ঠে বললাম, আপনি তো ছোট ব্যাপার, স্বয়ং আপনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও আমাদের এখান থেকে সরাতে পারবেন না। কোন আইনে আপনি আমাদের চলে যেতে বলছেন তা দেখান, না হয় আপনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনামা দেখান।
হইচই শুনে ছুটে এলেন আমাদের ইউপি চেয়ারম্যান হামিদুল্লাহ খান মুন। তিনি উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা। ঘটনা শুনে তিনি এসআইকে বললেন, আপনাদের জন্যই সরকারের বদনাম হয়। তার পর আমার পরিচয় দিয়ে তাঁকে ভবিষ্যতের জন্য সাবধান করে দিলেন। এসআই নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ‘সরি’ বলে বিদায় নিলেন। এসআই চলে যাওয়ার পর উপস্থিত নেতাকর্মীরা বলল, আপনি না থাকলে আজ আমাদের নির্ঘাত থানা-হাজতের মেহমান হতে হতো। সেদিন শ্রীনগরের ওই এসআইর যেমন এখতিয়ার ছিল না আমাদের কফি পানে বাধা দেওয়ার, তেমনি উত্তরার রেস্তোরাঁয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সভায় বাধা দেওয়ার কোনো আইনগত অধিকার এসআই আবু সাঈদের ছিল না। দুটি ঘটনায় পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টি স্পষ্ট। এ ধরনের ঘটনা এ পর্যন্ত বহু অঘটনের জন্ম দিয়েছে। তার পরও কেউ সংযত হচ্ছে না।
পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মীদের পুলিশের ওপর খবরদারির বিষয়টিরও অবসান হয়নি। আগে করত আওয়ামী লীগের কর্মীরা, এখন করে ক্ষমতায়-প্রত্যাশী বিএনপি কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থেকে ঢাকার নিউমার্কেট কিংবা উত্তরার ঘটনায় একটি বিষয় স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক কর্মীরা আইনের সহায়তা না নিয়ে পেশিশক্তির জোরে কার্যসিদ্ধির পন্থা গ্রহণ করেছে। উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের আটক করে বেআইনি কাজ করেছে সন্দেহ নেই। তাই বলে থানায় হামলা ও পুলিশকে মারধর করতে হবে কেন? আলোচনার মাধ্যমে আটক ছাত্রনেতাদের মুক্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী পুলিশের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পথ তো খোলা ছিল। সে পথে কেউ হাঁটেনি। যার ফলে আরও একটি ন্যক্কারজনক ঘটনার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হলো।
সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যদি এখনই রোধ করা না যায়, তাহলে সারাদেশে এক নৈরাজ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে পুলিশ বসে থাকবে হাত গুটিয়ে, আর সে সুযোগে দেশ পরিণত হবে দুষ্কৃতকারী-
দুর্বৃত্তদের অভয়ারণ্যে। এক্ষেত্রে সরকার এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিজ নিজ বাহনের লাগাম টেনে ধরা অত্যন্ত জরুরি।
মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত র জন ত ক ব যবহ র শ র নগর কর ম র আম দ র ক ষমত র ওপর ঘটন র সরক র ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
রাজশাহীতে যুবদল–ছাত্রদলের চাঁদাবাজির মামলার এজাহার ফাঁস, এসআইকে বদলি
রাজশাহীতে যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা রুজুর আগে এজাহার ফাঁসের ঘটনায় এবার এক উপপরিদর্শককে (এসআই) বদলি করা হয়েছে। ওই পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে ছাত্রদলের এক নেতার ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে রাজশাহীতে তুমুল আলোচনা চলছে।
নগরের বোয়ালিয়া থানা থেকে বদলি হওয়া ওই পুলিশ কর্মকর্তার নাম এস এম রকিবুল ইসলাম। চাঁদাবাজির মামলার এজাহার থানায় রেকর্ড হওয়ার আগেই তিনি সেটি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেন ছাত্রদল নেতা এমদাদুল হক ওরফে লিমনের কাছে। এমদাদুল হক রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজ ছাত্রদলের সদস্যসচিব। ২৩ জুলাই রাতে আবাসন ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান তাঁর বিরুদ্ধে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে বোয়ালিয়া থানায় মামলা করেন। মামলায় এমদাদুল হকসহ ৩৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।
এজাহার ফাঁসের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর গতকাল সোমবার এসআই রকিবুলকে থানার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাজশাহী পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়।
এসআই রকিবুলের সঙ্গে সেই রাতে হওয়া কথোপকথনের রেকর্ড ফাঁস করে দেন এমদাদুল হক নিজেই। হোয়াটসঅ্যাপের ওই কথোপকথন ভিডিও করে রেখেছিলেন তিনি। ভিডিওতে দেখা যায়, এমদাদুল হক সালাম দিয়ে কথা শুরু করেন। এসআই রকিবুল তাঁর উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘মামলা রেকর্ড হচ্ছে, হচ্ছে...রেকর্ডটা করতে দে।’ এমদাদুল জানতে চান, ‘আচ্ছা, ওর (মোস্তাফিজুর রহমানের) মামলাডা হলো, কে কে ভাই বলেন তো একটু। বলা যাবে?’ এসআই বলেন, ‘তুই ফোন দিছিস তোর পরে আমি গেছি। যায়ে এজাহার নিসি, তোরে দিসি। আমি জানি? কমিশনার অফিস থেকে এজাহার লিখিসে।’ এমদাদুল প্রশ্ন করেন, ‘ওখানেই এজাহার লিখেছে? কমিশনার অফিসে?’ এসআই বলেন, ‘হ্যাঁ, ওখান থাইকা অফিসে থেকে এজাহার পাঠায়ে দিসে। অপারেটর তাই কলো যে স্যার, পেনড্রাইভে করে এজাহার পাঠায় দিসে ফোর্স দিয়ে।’
ভিডিওতে আরও দেখা যায়, এমদাদুল বলেন, ‘ও, কমিশনার নিজেই লিখেছে?’ এসআই বলেন, ‘তা জানি না। সে (পুলিশ কমিশনার) তো আর নিজে লেখে না। ওই অফিস (আরএমপি সদর দপ্তর) থেকে পাঠায়ছে। আমি কাজ করতেছি, ফ্রি হয়ে ফোন দিচ্ছি। রাখো।’
পরে মামলাটি প্রত্যাহারের দাবি ও বাদীকে গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজশাহীতে মানববন্ধন করেন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা–কর্মীরা। সেখানে মাইকে বাজিয়ে শোনানো হয় এসআই রকিবুল ও এমদাদুলের এই কল রেকর্ড।
এরপর বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে পুলিশ। বিষয়টি বোয়ালিয়া জোনের উপকমিশনারকে তদন্ত করতে বলা হয়। প্রাথমিক তদন্ত শেষে এসআই রকিবুল ইসলামকে থানার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে গতকাল পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার গাজিউর রহমান বলেন, ‘রকিবুল ইসলামের গত তিন মাসের চাকরির পারফরম্যান্স খারাপ হওয়ায় তাকে থানা থেকে বদলি করা হয়েছে। এর সঙ্গে ওই কল রেকর্ডের কোনো সম্পর্ক নেই। আর কল রেকর্ডে সে যা বলেছে, তার ব্যাপারে অবশ্য ডিপার্টমেন্ট তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।’
পুলিশ কমিশনার কার্যালয় থেকে কোনো মামলার এজাহার পাঠানোর প্রসঙ্গে গাজিউর রহমান বলেন, ‘এটা কখনো হয় না। মামলার বাদী থানায় এসে লিখিত এজাহার ওসির কাছে জমা দেন অথবা লিখতে না পারলে অন্য কাউকে দিয়ে লিখে তা বাদীকে পড়ে শোনানো হয়। তিনি তাতে সায় দিলে টিপসই নেওয়া হয়।’ কমিশনার কার্যালয় থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা পাঠানো হতে পারে কি না, এমন প্রশ্নে গাজিউর রহমান বলেন, ‘এটা কখনোই সম্ভব নয়। রাতে কমিশনার অফিসে কেউ থাকে না। তা ছাড়া আমি রেকর্ডটি শুনেছি। বলেছে, কমিশনার অফিস থেকে। এখন কমিশনার তো আরও আছে। সেটা ঠিক নয়।’