জার্মানিতে চলছে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন। এই সম্মেলনে যোগ দিতে উড়োজাহাজে করে রওনা দিয়েছিলেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। পথে দেখা দেয় বিপত্তি। উড়োজাহাজের ককপিটের উইন্ডশিল্ডে দেখা দেয় ফাটল। এর ফলে বৃহস্পতিবার রাতে উড়োজাহাজটি ওয়াশিংটন ডিসির কাছে অ্যান্ড্রুস বিমানঘাঁটিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।

রুবিওর উড়োজাহাজে গোলোযোগের চেয়ে আরেকটি বিষয় তখন গণমাধ্যমগুলোতে বেশি সাড়া ফেলেছিল। তা হলো ইউরোপে দেওয়া মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথের বক্তব্য। তাঁর কথা হতবাক করেছে ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের। এর জেরে অনেকে মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সঙ্গে কোনো শান্তিচুক্তিতে যেতে বড় ছাড় দিতে হবে ইউক্রেনকে।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেগসেথ বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা অঞ্চলগুলো কিয়েভ ফিরে পাবে—এমনটা মনে করা ‘অবাস্তব’। একই সঙ্গে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হওয়ার যে দাবি ইউক্রেন করেছে, তা–ও বাস্তবসম্মত নয়। তিনি আরও বলেছেন, শান্তি বজায় রাখার বিষয়টি ইউরোপীয়দের ওপর নির্ভর করছে, মার্কিন সেনাদের ওপর নয়।

এই বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দল রিপাবলিকান পার্টির কয়েকজন নেতাসহ অনেক সমালোচক। তাঁরা বলছেন, হেগসেথের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কোনো আলোচনার আগেই দর–কষাকষির ক্ষেত্রে ইউক্রেনের অবস্থানকে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। সমালোচকদের মতে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে ওয়াশিংটন।

অবশ্য পরের দিনই নিজের বক্তব্য থেকে পিছু হটেন পিট হেগসেথ। তিনি বলেন, আলোচনার জন্য বিকল্প সবকিছু এখনো ট্রাম্পের টেবিলে রয়েছে। পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে দর–কষাকষির ক্ষেত্রে সেগুলো ব্যবহার করবেন তিনি। ইউক্রেনের নানা বিষয়ে ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করে হেগসেথ বলেন, তিনি বাস্তবতাটামাত্র তুলে ধরেছিলেন।

এদিকে উড়োজাহাজে গোলোযোগের কারণে মার্কো রুবিওর মিউনিখে পৌঁছাতে দেরি হয়। সেখানে এই সফরে রুবিওর অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছিলেন তাঁর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠান জন্য কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র। একটি ‘টেকসই নিরাপত্তাকাঠামো’ তৈরি করার কাজে নেতৃত্ব দেবে ইউরোপের দেশগুলো।

শান্তি আলোচনা নিয়ে পিট হেগসেথের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর অবস্থানের মিল নেই। মিউনিখে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও বলেছেন, একটি শান্তিচুক্তিতে যেতে রাশিয়াকে রাজি করানোর জন্য সামরিক হাতিয়ার ব্যবহার করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ হেগসেথ বলেছেন, ইউক্রেনে কোনো মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হবে না।

মিউনিখে হেগসেথের বক্তব্য নিয়ে পরে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল হেগসেথ কী বলতে যাচ্ছেন, তা প্রেসিডেন্ট আগে থেকে জানতেন কি না? ট্রাম্প এভাবে জবাবটা দেন—‘সাধারণভাবে বলতে গেলে, হ্যাঁ। সাধারণভাবে বলতে গেলে, আমি জানতাম। আমি পিটের সঙ্গে কথা বলব। কী হয়েছে, তা বের করব।’

দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ঘিরে ট্রাম্পের অবস্থান নিয়ে প্রথমবারের মতো বড় পরিসরে ধারণা দিয়েছে মিউনিখে তিন দিনের সম্মেলন। এটাও জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন কীভাবে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করছে এবং এ নিয়ে অন্যদের কাছে বার্তা দিচ্ছে।

হেগসেথ নিজের বক্তব্য থেকে পরে সরে গেলেও তিনি প্রথমে যা বলেছিলেন এবং ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরুর লক্ষ্যে পুতিনের সঙ্গে ফোনকল নিয়ে ট্রাম্প যে দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছিলেন, তা ইউরোপের রাজধানীগুলোয় বড় ধাক্কা দিয়েছে। ইউক্রেনের বক্তব্যকে পাশে সরিয়ে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কোনো চুক্তি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান কাজা কালাস বলেন, তাড়াহুড়া করে করা কোনো চুক্তি ভালো হয় না।

এরপর প্রশ্ন ওঠে—ট্রাম্পের অধীনে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে সামনে আনা হচ্ছে। মিউনিখে যা ঘটেছে, তা থেকে এটাই মনে হয়েছে যে ইউক্রেন–রাশিয়া শান্তিচুক্তি নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তাঁর প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তবে সেই প্রচেষ্টা কখনো কখনো অন্যদের সামনে বিস্ফোরক হিসেবে এসেছে। আর কর্মকর্তাদের কোনো কোনো মন্তব্যে বিরোধও দেখা দিয়েছে।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তাঁর সঙ্গে বিরোধিতা বা দ্বিমত পোষণের কারণে উচ্চপর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। অনেকে অবসরে গিয়েছিলেন। এই মেয়াদে ট্রাম্পের নিয়োগ দেওয়া কর্মকর্তাদের তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে দেখা গেছে। যেমন পিট হেগসেথের সামরিক বাহিনী বা সরকার বা কোনো সংস্থার নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। তিনি সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজের উপস্থাপক ছিলেন। কাজ করেছেন ন্যাশনাল গার্ডের সাবেক মেজর হিসেবে। তবে ট্রাম্পের চিন্তাভাবনা ও এজেন্ডা বাস্তবায়নের সঙ্গে তিনি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন।

হেগসেথের চূড়ান্ত নিয়োগের সময় সিনেটে তাঁকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। রিপাবলিকান পার্টির তিনজন সিনেটর তাঁর বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ফলে তাঁর পক্ষে ও বিপক্ষে ৫০–৫০ করে সমান ভোট পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ভোট দিয়ে হেগসেথের নিয়োগ চূড়ান্ত করেন।

চলতি সপ্তাহেই শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ না দেওয়ার পরিকল্পনাকে ‘ঠিকঠাক’ বলে উল্লেখ করেছেন ট্রাম্প। তাঁর মতে, এটা ‘বাস্তবসম্মত নয়’। ট্রাম্পের এই বক্তব্যের সঙ্গে মিউনিখে হেগসেথের বক্তব্যে অমিল নেই বললেই চলে। তিনি বরং শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে ইউক্রেনের শক্ত অবস্থান নিয়ে সচেতন একদল মানুষের কাছে তা আরও বড় পরিসরে তুলে ধরেছেন।

ভুক্তভোগীদের কাছে চ্যালেঞ্জটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সুনির্দিষ্ট অবস্থান অনেকটাই আকস্মিক হয়ে উঠেছে। এর একটি বৈশিষ্ট্য অনিশ্চয়তা। হতে পারে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতির ‘ম্যাডম্যান’ তত্ত্ব ব্যবহার করেছেন। এই তত্ত্বের ভাষ্য হলো একই সঙ্গে শক্তিশালী ও অন্যদের কাছে অপ্রত্যাশিত হওয়াটা মিত্রদের কাছাকাছি রাখার এবং প্রতিপক্ষের ওপর জোর খাটানোর একটি উপায়।

তবে ম্যাডম্যান তত্ত্বের নাম থেকেই বোঝা যায়, সহিংসতাপূর্ণ ও অনিশ্চিত এক বিশ্বে এই তত্ত্ব অনুসরণ করলে ভুল করার এবং ভুল–বোঝাবুঝি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ফিলিস্তিনের গাজাকে যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানায় আনার যে পরিকল্পনা ট্রাম্প করেছেন, তাতেও একইভাবে বিভ্রান্তি ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব রয়েছে।

গাজার মালিকানার পাশাপাশি সেখান থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেওয়ার কথাও বলেছেন ট্রাম্প। পরে ওই বক্তব্য কিছুটা সংশোধনের চেষ্টা করেছেন তাঁর প্রশাসনের কর্মকর্তারা। যেমন বলেছেন, গাজাবাসীকে ‘সাময়িক সময়ের জন্য’ সরিয়ে দেওয়া হবে। তবে সেই প্রচেষ্টার পর ট্রাম্প আবার বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে সরানো হবে। তাঁদের গাজায় ফেরার কোনো অধিকার থাকবে না।

আর মার্কো রুবিওর কথা বলতে গেলে, তিনি চান তাঁর অধীনে থাকা পররাষ্ট্র দপ্তর হবে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী সরকারি সংস্থা। তবে মিউনিখে তাঁর সহকর্মী পিট হেগসেথের বক্তব্যে ইতিমধ্যে তাঁর সেই চাওয়াকে ছাপিয়ে গেছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন র র অবস থ ন মন ত র হয় ছ ল বল ছ ন কর ছ ন ইউর প

এছাড়াও পড়ুন:

আঠারো শতকের সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ খাজা মীর দর্দ

আবদালি মারাঠিদের উৎপাত ও অত্যাচারে অন্য কবিরা যখন একে একে দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌ চলে গিয়েছিলেন, তখনো প্রিয় শহর দিল্লি ছাড়েননি সৈয়দ খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৪ খ্রি.), বরং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থানকারী কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার যে পার্থক্য ছিল, শুধু সে কারণেই তিনি সেই জায়গায় যাননি তা নয়, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর, কারও তারিফ করে কখনো কসিদা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, সর্বোপরি তাঁর জীবনদর্শনও ছিল সমকালিক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন। মির্জা রফী সওদার চেয়েও সাত বছরের অগ্রজ মীর দর্দ এই সবকিছুই নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, পারস্য ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে অনেক কিছু গ্রহণও করেছেন, তবু আমাদের ধারণা, পারিবারিক বংশধারার প্রভাবেই তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যচিন্তা শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল।

মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন।

মাহমুদ আলী খান জামী তাঁর ‘দর্দ কে সো শের’ (প্রকাশকাল: ১৯৫৫ খ্রি., দিল্লি) গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা মীর দর্দের দাদা বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে বুখারা থেকে এ দেশে এসেছিলেন, আর বাবা খাজা মাহমুদ নাসির আন্দালিব ছিলেন ‘শায়েরে উর্দু’ এবং ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুফি। ভিন্ন মতে, তাঁর বাবার নাম (মাহমুদ নাসির নয়) মুহাম্মদ, আর তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন না, ছিলেন ফারসি ভাষার কবি। এঁরা ছিলেন নকশবন্দী ঘরানার পথিকৃৎ খাজা বাহাউদ্দিনের বংশধর ও অনুসারী। সুফি পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই মাত্র বাইশ বছর—ভিন্ন মতে, সাতাশ বছর বয়সে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সুফি শুদ্ধাচারী হয়ে ওঠেন দর্দ এবং সুফি তত্ত্বসংক্রান্ত একাধিক বই লেখেন। ফলে তিনি যখন শের ও গজল লেখেন, তখন সেগুলোতে স্বভাবগত কারণেই সুফি মরমি কবিতার সহজগভীর ভাবের ছায়া পড়েছে। নিচে দর্দ কে সো শের বই থেকে—অন্যত্র গজলরূপে গণ্য এবং গীত—প্রথম ৩টি শের পড়লে এ কথার সত্যতা মিলতে পারে :

তোহমতে চন্দ অপনে জিম্মে ধর চলে
জিস লিয়ে আয়ে থে হম সো কর চলে
জিন্দেগি হ্যয় য়া কোই তোফান হ্যয়
হম তো ইস জিনে কে হাথোঁ মে মর চলে
শমা কে মানিন্দ হম ইস বজম মে
চশম নম আয়ে থে দামন তর চলে

অর্থাৎ :

কত অপবাদ বয়ে নিয়ে আমি চলছি
অথচ যে কারণে এসেছি তা–ই করে গেছি
এ কোনো জীবন, নাকি তুফান
তার হাতেই তো আমি মারা যাব
এই সভার প্রদীপ ছিলাম আমি
এখন আমার চোখের জলে আঁচল ভিজে যায়

[অনুবাদ: লেখক]

অল্প বয়স থেকে যিনি এমন ভাবনায় তাড়িত, তাঁর গজলে এই প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। সুফি কবি ও সাধক হিসেবে স্বীকৃত হলেও গজলকার হিসেবে যেরকম গণ্য হননি খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, ঠিক একই কারণেই গজলকার হিসেবে কেউ কেউ তাঁর নাম সমকালের মীর তকী মীর ও মির্জা রফী সওদার কাতারে রাখতে কুণ্ঠিত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মীর তকী মীরের একটি মন্তব্য আছে, যা অনেকেই উদ্ধৃত করেন, তা হলো: তিনি নাকি আড়াইজন কবিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যার মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন মির্জা রফী সওদা আর অর্ধজন হলেন খাজা মীর দর্দ।

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

শের ও গজলের ক্ষেত্রে মীর তকি মীর শেষমেশ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই জায়গা থেকে বিচার করে তাঁর এই কথাটিকে সদর্থে ধরে নিলে কবিতায় খাজা মীর দর্দের অবদানকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। আসলে পারস্য কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে উর্দু গজলে যখন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীর সঙ্গে আলাপের আবহ তৈরি হচ্ছে, খাজা দর্দ তখন একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন সুফি ঐতিহ্য। সমালোচকদের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ উর্দু’, কিন্তু তাঁর ‘শমা-এ মহফিল’, ‘আহ-এ দর্দ’, ‘দর্দ-এ দিল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষা ও সুফিহৃদয়ের ভাব সেই সময় ও পরবর্তীকালের কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি অনবদ্য শের হলো: ‘তমান্না তেরি হ্যাঁয় অগর হ্যাঁয় তমান্না/ তেরি আরজু হ্যায় অগর আরজু হ্যায়’ অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা তোমারই আকাঙ্ক্ষা/ আশা তোমার জন্য, আদৌ আশা বলে যদি কিছু থাকে’। প্রেমের এমন একনিষ্ঠ নিবেদন খাজা দর্দের শেরেই পাওয়া সম্ভব। নিচে পড়ে নিতে পারি তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় শের:

হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে ম্যারে আরমান ল্যাকিন পির ভি কম নিকলে

অর্থাৎ :

এমন হাজার বাসনা আমার, যার প্রতিটি বাসনার জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত
কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো বটে; কিন্তু তা খুবই সামান্য

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

আরও পড়ুনএকাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি২৮ আগস্ট ২০২৫

মীর দর্দের এমন উচ্চাসনে পৌঁছার অন্য একটি কারণ হলো, তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই গান শোনা ও তার চর্চা বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, সে বিষয়ে তাঁর সবিস্তার আলোচনা এবং গানবিষয়ক গান লেখার উদাহরণ। আমাদের অজানা নয়, গান বিষয়ে কওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমির খসরুর একাধিক বাণী আছে, যেমন: ‘গান হলো আত্মার খোরাক’, ‘দরবেশের কাছে গান হলো ঐশ্বরিক জ্যোতির সমতুল’ ইত্যাদি, আর দর্দ লিখেছেন: ‘অগর ঘিনা নফস কো বড়্কায়ে তো হারাম, অগর দিল কো ইলাহ কি তরফ নরম করে তো হালাল’ অর্থাৎ গান যদি মনকে প্রবৃত্তিতাড়িত হতে উসকে দেয় তাহলে হারাম, আর স্রষ্টামুখী করলে হালাল’। এ বিষয়ে দর্দের যে শের রয়েছে, সেটি আরও সুন্দর :

সামা’ আহলে দিল কো হ্যা সোদমন্দ দর্দ
কে ইস সে নরম হোতা হ্যা পাত্থর কা দিল ভি

অর্থাৎ :

হৃদয়বান মানুষের জন্য গান উপকারী, হে দর্দ
কারণ পাথরের মতো হৃদয়ও তাতে গলে যায়।

উল্লেখ্য যে, গান বিষয়ে আলোচনা করবার সময় এ অঞ্চলের গবেষক ও সুফি-বাউল-ফকিরেরা ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও আমির খসরুর বইয়ের তথ্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে কোথাও সৈয়দ খাজা মীর দর্দের কথা পাওয়া যায় না। জাভেদ হুসেন দর্দের কয়েকটি গজল অনুবাদ করতে গিয়ে তার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘দর্দ ছিলেন একজন বড় সংগীতজ্ঞ। সুফি সাধনায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে হুরমতে ঘিনা নামে পুস্তিকা লিখেছেন। উর্দু গজলের গীতিময়তা আজ দেখা যায় তাতে দর্দের ভূমিকা ব্যাপক ও গভীর।’ এই পুস্তিকাটি দুর্লভ, ভবিষ্যতে এটি অনূদিত হলে শায়ের ও গজলকার মীর দর্দের পাশাপাশি সংগীতচিন্তক হিসেবে তাঁর পরিচয়টাও আমরা জানতে পারব।

অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।
ই–মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ