তাহেরুল ইসলাম একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, বাইসাইকেল চালিয়ে শহরের রেলগেট থেকে সাঁড়াগোপালপুরে নিজ বাড়ি ফিরছিলেন। পথে ট্রাক থেকে রাস্তায় ঝরে পড়া বালুর আস্তরণে চাকা পিছলে ইজিবাইকের ধাক্কায় উল্টে গিয়ে পড়েন রাস্তার পাশে পাতিবিলের কিনারায়। অল্পের জন্য তিনি পানিতে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পান। অন্য যানবাহনের যাত্রীরা তাঁকে তুলে পাঠান বাড়িতে।
ঈশ্বরদীর টিপু সুলতান, উপজেলা, পাকশি পেপার মিল, ইপিজেডসহ বিভিন্ন সড়কে প্রতিদিন এমন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে যানবাহন। এতে শিক্ষক তাহেরুলের মতো বিপদে পড়ছেন অনেকে। জানা গেছে, বালু বহনকারী ট্রাক, ডাম্প ট্রাক ও ট্রাক্টর থেকে ঝরে পড়া বালু রাস্তায় জমতে জমতে পুরু আস্তরণ তৈরি হয়েছে। 
এসব সড়কে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। সরেজমিনে জানা গেছে, পদ্মা নদী থেকে ট্রাকে সড়কপথে বহন করা বালু ঝরে পড়ে বিভিন্ন সড়ক এখন বালুময় হয়ে গেছে। পাকা সড়ক ঢাকা পড়েছে বালুর আস্তরণে। চাকা পিছলে দুর্ঘটনায় পড়ছে যানবাহন।
টিপু সুলতান রোডে চলাচলকারী ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, এমনিতে এ সড়ক ভাঙা। এরই মধ্যে অতিরিক্ত ওজনের বালু বহন করায় ঝাঁকুনিতে ঝরে পড়ে। এতে বালু জমে সড়ক ঢাকা পড়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। ইজিবাইকচালক বদরুল আলমের ভাষ্য, বালুতে চাকা পিছলে প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়তে হচ্ছে। বালু না সরানো হলে এবং ট্রাকে অতিরিক্ত ভার বহন বন্ধ করা না হলে এ অবস্থার সমাধান হবে না।
পদ্মা নদী থেকে বালু ভর্তি করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে এক থেকে দেড় ফুট বালু সড়কে ঝরে পড়ে বলে জানান ট্রাকচালক জামাল হোসেন। আরেক চালক সামসুল আলম বলেন, ভাঙা সড়কের কারণে বারবার অতিরিক্ত ঝাঁকুনিতে ট্রাক থেকে বালু ঝরে পড়ে। বাধ্য হয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি বালু লোড করতে হচ্ছে। এতে গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত ঝরে পড়ার পরও ট্রাকের আকার অনুযায়ী বালু থাকে।
ইউএনও সুবীর কুমার দাশ বলেন, বালুতে সড়কে এমন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তা জানা ছিল না। ট্রাফিক বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায় বিষয়টি আলাপ করে সমাধানের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সড়ক দ র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন ঠেকাতে গ্রামবাসী বানালেন ‘প্রাকৃতিক বাঁধ’

উজানের ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রবল স্রোতে ব্রহ্মপুত্র নদসহ অর্ধশতাধিক নদ-নদীর পানি বেড়ে দেখা দেয় ভাঙন। মাটির সঙ্গে ভেসে যায় বসতভিটা, ফসলি জমি, কখনো স্কুল বা মসজিদ। প্রতিবছর এই ভাঙনে নিঃস্ব হয় অসংখ্য পরিবার। সরকারি বাঁধ বা প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি মিললেও বাস্তবে কাজের গতি নেই।

এমন অবস্থায় এবার নিজেরাই নিজেদের রক্ষার পথ খুঁজে নিয়েছেন চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের খেরুয়ার চরের বাসিন্দারা। সরকারি সহায়তার অপেক্ষা না করে নিজেদের টাকায় ও স্বেচ্ছাশ্রমে তাঁরা ব্রহ্মপুত্রের তীরে গড়ে তুলছেন এক ‘প্রাকৃতিক বাঁধ’।

প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদীতীরে লাগানো হয়েছে কলাগাছ, কাশফুল, কলমিলতা ও স্থানীয় ঘাসজাতীয় গাছের চারা। এসব গাছের বিস্তৃত শিকড় নদীতীরের মাটি আঁকড়ে ধরে রাখবে, এমন ধারণা থেকেই এই উদ্যোগ।

খেরুয়ার চরের বাসিন্দা দুলাল জোয়াদ্দার বলেন, ‘প্রতিবছর ভাঙনে ঘরবাড়ি হারাই। কেউ সাহায্য করে না। তাই ভাবলাম, গাছ লাগালেই যদি কিছুটা মাটি টিকে থাকে তাতেই লাভ।’

সম্প্রতি সরেজমিনে নয়ারহাট ইউনিয়নের খেরুয়ারচর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে জেগে ওঠা বালুচরের দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে স্থানীয় বাসিন্দারা কাশফুলের চারা লাগাচ্ছেন। কিছু দূর পরপর কলাগাছ ও কলমিলতার চারাও লাগানো হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সবাই এ কাজে হাত লাগিয়েছেন। কেউ বালুচরে প্রাকৃতিক বাঁধ তৈরির কাজ করছেন, তো কেউ সেই বাঁধের জন্য কাশফুলের চারা ও কলমিলতার জোগান দিচ্ছেন। বসে নেই এলাকার নারীরাও, পুরুষের পাশাপাশি তাঁরা হাত লাগিয়েছেন পানি সরবরাহকাজে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য সানোয়ার হোসেন বলেন, আগেও সীমিত পরিসরে গাছ লাগানো হয়েছিল, কিন্তু এবার মানুষ অনেক বেশি সংগঠিত হয়েছে। তাই ব্যাপক পরিসরে লাগানো হচ্ছে। ‘মানুষ নিজেরাই টাকাপয়সা দিয়েছে, দল বেঁধে গাছ লাগিয়েছে। আমরা পাশে আছি’, বলেন তিনি।

ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে

নয়ারহাট ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরেই বজরা দিয়ারখাতা, দক্ষিণ খাউরিয়ার চর ও ফেইচকা এলাকায় অন্তত ২০০ পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। শতাধিক পরিবার বসতবাড়ি হারিয়ে অন্যের জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। ভাঙনের ঝুঁকিতে ইউনিয়নের একমাত্র আশ্রয়ণ প্রকল্প, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় বাজার।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, এ বছর নদীভাঙনে জেলার ১ হাজার ৫০০ পরিবার তাদের বসতি হারিয়েছে। এ ছাড়া গত ছয় বছরে ১৬ হাজার পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছে এবং ১৫৩ হেক্টর কৃষিজমি বিলীন হয়েছে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান বলেন, ব্রহ্মপুত্রের গভীরতা ও প্রবল স্রোতের কারণে এ ধরনের উদ্যোগ দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর না–ও হতে পারে। তবে স্থানীয়দের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ ইতিবাচক। এভাবে প্রাকৃতিক বাঁধ তৈরি হলে ভাঙনের ঝুঁকি কমে আসবে। জেলার প্রতিটি চরে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর এভাবে বাঁধ দিলে ভূমিক্ষয় ও ভাঙনের ঝুঁকি কমবে।

জলবায়ুর প্রভাব ও অভিযোজন

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর চরাঞ্চলে নদীভাঙন বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গিয়ে নদীতীর দুর্বল হয়, আর বর্ষায় প্রবল স্রোতে দ্রুত ক্ষয় ঘটে।

জেলা জলবায়ুকর্মী মার্জিয়া মেধা বলেন, চরাঞ্চলের এই উদ্যোগকে ছোট করে দেখা ঠিক হবে না। কলা, কাশফুল ও কলমি—সবই এমন উদ্ভিদ, যেগুলোর শিকড় মাটি ধরে রাখে। এটি একধরনের সবুজ বর্ম, যা ভাঙন রোধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তিনি আরও বলেন, এটি আসলে কমিউনিটিভিত্তিক জলবায়ু অভিযোজনের উদাহরণ। সরকার যদি বৈজ্ঞানিক পরামর্শ, উপযুক্ত প্রজাতির গাছ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সহায়তা দেয়, তবে এটি ব্রহ্মপুত্র তীর রক্ষার একটি টেকসই মডেল হয়ে উঠবে।

নদীগবেষক ও রিভারাইন পিপলের পরিচালক তুহিন ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙন রোধে বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা করে মানুষের জমি ও বসতভিটা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের গ্রহণ করা উচিত ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র সেখানে ব্যর্থ হয়েছে। স্থানীয় মানুষ নিজেদের বাঁচানোর তাগিদে কখনো বাঁশ-কাঠ দিয়ে, আবার কখনো কাশফুলের চারা দিয়ে প্রতিরোধব্যবস্থা করেছে। তিনি আরও বলেন, নদীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ অনেক সময় জীব ও পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলে, জলবায়ু সংকট তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। সেদিক বিবেচনায় স্থানীয় মানুষের এই প্রাকৃতিক বাঁধ ব্রহ্মপুত্র নদের তীর রক্ষার একটি টেকসই মডেল হয়ে উঠতে পারে।

চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সবুজ কুমার বসাক বলেন, ‘স্থানীয়দের প্রাকৃতিক বাঁধ নির্মাণ একটি প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা। এ বছর বন্যায় নদীভাঙনের পর সেখানে স্থায়ী বাঁধের জন্য আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দিয়েছি। এ ছাড়া স্থানীয়দের কাজকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আমরা তাদের পাশে রয়েছি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ