বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে আর্থিক খাতের এমন সর্বনাশ আর কোথাও হয়নি। পৃথিবীর অনেক দেশে আমি কাজ করেছি আইন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে। হ্যাঁ, দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনা হয়, মূল্যস্ফীতি হয়, কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাংক লুট করার ঘটনা একমাত্র বাংলাদেশেই ঘটেছে। শুধু একটা ব্যাংক নয়, সাতটা ব্যাংক। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থ পাচার করা হয়েছে।’

নীলফামারী সরকারি কলেজের হলরুমে আজ রোববার সকালে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে গভর্নর এ কথাগুলো বলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া। বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান। সভায় কলেজের শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। এ সময় অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দেন গভর্নর।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আপনারা জানেন একটা পরিবারের হাতেই ছিল সাতটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যেটা আইনবহির্ভূত। আইন অনুযায়ী একটি পরিবারের হাতে একটি ব্যাংকের ১০ শতাংশ শেয়ার থাকতে পারে, তার বেশি নয়। তারপরও কীভাবে তারা এতগুলো ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিল। ইসলামী ব্যাংকের ৮০ শতাংশের বেশি শেয়ার এস আলম পরিবারের হাতে। এত শেয়ার কীভাবে তারা নিল? এটা পুরোপুরিভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতা। তারা ব্যাংকের পলিটিক্যাল ডাইরেক্টর হয়েছিল।’

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এস আলম পরিবারকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে গভর্নর বলেন, ‘কীভাবে তারা সাতটা ব্যাংক নিল এবং সবগুলোকে দেউলিয়া করল, এটা কি আমরা জানতাম না? অবশ্যই জানতাম। কিন্তু কিছু করা সম্ভব হয়নি। কেন হয়নি সেটাও আমরা জানি। কারণ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যদি সুরক্ষা দেওয়া হয়, গোয়েন্দা সংস্থা থেকে সুরক্ষা দেওয়া হয়, তাহলে কীভাবে সাধারণ মানুষ এটি প্রতিহত করবে। তাই এস আলমকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি।’

ব্যাংকগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়ে গভর্নর বলেন, ‘কিছু ব্যাংক আছে যেগুলো ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তার মধ্যে ইসলামী ব্যাংক অন্যতম। ব্যাংকটির আমানতকারীরা চায় ব্যাংকটা টিকে থাকুক। তারা জানে ব্যাংকটা ভালো ছিল। এই যে ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের আস্থা, এটা ব্যাংকিং খাতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ব্যাংক খাতে যদি আস্থাটা দিতে পারি তাহলে ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হবে।’

পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা হচ্ছে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে। আমরা দেখেছি নাইজেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট সম্পদ নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার ফেরত আনা হয়েছে। এটা সম্ভব, তবে সময় লাগবে। বর্তমান সরকারের পক্ষে পাচারের অর্থ ফেরত আনার কাজটি শেষ করা সম্ভব হবে না। তবে প্রক্রিয়া শুরুটা করা যাবে। আমরা শুরু করে যাব, শেষটা করতে হবে পরবর্তী সরকারকে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র বল ন পর ব র

এছাড়াও পড়ুন:

‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।

সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।

জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’

ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।

জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।

জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ