সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ ছাত্রাবাসে এক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় ছাত্রশিবিরের ‘কিছুসংখ্যক কর্মী’ জড়িত থাকার দায় স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করেছেন মহানগর জামায়াতের আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম। গতকাল রোববার রাতে নগরের সোবহানীঘাট এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বক্তব্য দেন।

তবে ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল রাতেই ছাত্রশিবিরের সিলেট মহানগর শাখা একটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে সংগঠনটি জামায়াতের আমিরের বক্তব্য প্রত্যাহারের জন্য আহ্বান জানিয়েছে।

এর আগে গত বুধবার রাত ১২টার দিকে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান মারধরের শিকার হন। তিনি সিলেটের আঞ্চলিক ইসলামী সংগঠন বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার এমসি কলেজ শাখার সহতথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক সম্পাদক। মিজানুর রহমানের অভিযোগ, তাঁকে এমসি কলেজ ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা রড দিয়ে মারধর করেছেন।

তবে কলেজ ছাত্রশিবিরের সভাপতি ইসমাঈল খান ঘটনার পর প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, এ ঘটনায় ছাত্রশিবিরের কোনো নেতা-কর্মী জড়িত নন। ছাত্রশিবিরের জনপ্রিয়তা নষ্ট করতে তৃতীয় একটি পক্ষ কলকাঠি নাড়াচ্ছে। মূলত কলেজ ছাত্রাবাসে মিজানুর রহমান নামের ওই শিক্ষার্থী ও একই কলেজের জাকিরুল ইসলাম নামের অন্য একজন শিক্ষার্থী নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছেন। এতে দুজনই আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এদিকে নিজ সংগঠনের শিক্ষার্থীকে পেটানোর পর ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে সিলেট নগরে বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া সিলেট মহানগর শাখা বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ করে। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে এ ঘটনায় জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরাও ছাত্রশিবিরের দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে সমাবেশ, মিছিল করেছেন।

একইভাবে এ ঘটনায় ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালানোর অভিযোগে সিলেট মহানগর ছাত্রশিবিরও বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ করেছে। এ ছাড়া গত কয়েক দিন উভয় পক্ষের অনুসারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও পাল্টাপাল্টি তৎপরতা চালান। এতে তাঁরা একে অন্যেকে দোষারোপ করতে থাকেন।
উভয় পক্ষের পাল্টাপাল্টি এমন অবস্থানের মধ্যে গতকাল সন্ধ্যায় সিলেট নগরের সোবহানীঘাট এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে জামায়াত ও আনজুমানে আল ইসলাহের নেতাদের মধ্যে বৈঠক হয়। এতে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে সৃষ্ট অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় জামায়াতের নেতারা দুঃখ প্রকাশ করেন। এরপর উভয় পক্ষ বিষয়টি নিষ্পত্তির ঘোষণা দেন।

আরও পড়ুনএমসি কলেজে তালামীয নেতাকে ‘রড দিয়ে পেটানোর’ অভিযোগ শিবিরের বিরুদ্ধে২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বৈঠকে সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির ফখরুল ইসলাম, জেলার আমির হাবিবুর রহমান, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান লোকমান আহমদ, আনজুমানে আল ইসলাহের নেতা রেদওয়ান আহমদ চৌধুরী ফুলতলী, রফিকুল ইসলাম খান, আবদুর রকিব, নাজমুল হুদা, কাজী বুরহান উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে রাতে সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির ফখরুল ইসলাম গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় জামায়াত ও বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহের নেতৃত্বস্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

সাংবাদিকদের ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘দুই ছাত্রসংগঠনই ইসলামী আদর্শের অনুসারী—ইসলামী ছাত্রশিবির ও তালামীযে ইসলামিয়া। দুটি সংগঠন আমাদের হৃদয়েরই একটা ভালোবাসার সংগঠন। এই সংগঠনের মধ্যে এমসি কলেজে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল, এটা নিয়েই আমাদের বসা হয়েছিল। উভয় পক্ষের আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই আমরা এ ঘটনার সুস্পষ্ট নিন্দাজ্ঞাপন করছি, দুঃখ প্রকাশ করছি।’

ফখরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ফেসবুকে একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে সেখানে যে বাড়াবাড়িটুকু হয়েছে, আমাদের দৃষ্টিতে সেখানে ছাত্রশিবিরের কিছুসংখ্যক কর্মী সেটার সঙ্গে জড়িত। এবং যেটা করেছে, সেটা অন্যায়ভাবে করেছে এবং সেটা দুঃখজনক। আমরা পরস্পরই ইসলামী সংগঠন। আমরা দেশ ও জাতির ভালো চাই। আমরা এই দেশে একটি ইসলামী পরিবেশ চাই।’

ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এমসি কলেজের ঘটনায় আহত শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান রিয়াদ আসলে যেভাবে আহত হয়েছে, আমরা তার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করছি, দুঃখপ্রকাশ করছি। এবং তার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং তার আশু সুস্থতা আমরা কামনা করছি। তার পরিবার-পরিজনদের প্রতিও আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি।’

আরও পড়ুনএমসি কলেজে শিক্ষার্থী পেটানোর ঘটনায় পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল, সমাবেশ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

তবে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মহানগর জামায়াতের আমিরের মতবিনিময়ের খবর জানাজানি হওয়ার পরপরই রাত সাড়ে ১০টার দিকে সিলেট মহানগর ছাত্রশিবিরের প্রচার ও মিডিয়া সম্পাদক নাঈম হোসাইন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। পরে রাত একটার দিকে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে তিনি বিজ্ঞপ্তি পাঠানোর বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগর সভাপতি শাহীন আহমদ এবং মহানগর সেক্রেটারি শহিদুল ইসলাম এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘সিলেটের এমসি কলেজে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বে হাতাহাতির ঘটনায় কয়েকজন আহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু স্থানীয় রাজনৈতিক মহল ফায়দা হাসিল করতে ছাত্রশিবিরের ওপর দায় চাপিয়ে আসছে। আজ (গতকাল) সন্ধ্যায় সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির ফখরুল ইসলামের প্রদত্ত একটি বক্তব্য আমাদের নজরে আসে। আমরা তার এই বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বকে সংঘবদ্ধ অপপ্রচারের মাধ্যমে ছাত্রশিবিরের ওপর দায় দিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা ইতিমধ্যে দেশবাসীর দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সিলেট মহানগর জামায়াতের আমিরও এ অপপ্রচার দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছেন বলে আমরা মনে করছি। আমরা অবিলম্বে এ বক্তব্য প্রত্যাহারের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ফখর ল ইসল ম ম জ ন র রহম ন আল ইসল হ র কল জ ছ ত র র ল ইসল ম এ ঘটন য় র ঘটন য় আম দ র কর ছ ন স গঠন গতক ল গণম ধ

এছাড়াও পড়ুন:

আঠারো শতকের সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ খাজা মীর দর্দ

আবদালি মারাঠিদের উৎপাত ও অত্যাচারে অন্য কবিরা যখন একে একে দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌ চলে গিয়েছিলেন, তখনো প্রিয় শহর দিল্লি ছাড়েননি সৈয়দ খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৪ খ্রি.), বরং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থানকারী কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার যে পার্থক্য ছিল, শুধু সে কারণেই তিনি সেই জায়গায় যাননি তা নয়, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর, কারও তারিফ করে কখনো কসিদা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, সর্বোপরি তাঁর জীবনদর্শনও ছিল সমকালিক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন। মির্জা রফী সওদার চেয়েও সাত বছরের অগ্রজ মীর দর্দ এই সবকিছুই নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, পারস্য ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে অনেক কিছু গ্রহণও করেছেন, তবু আমাদের ধারণা, পারিবারিক বংশধারার প্রভাবেই তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যচিন্তা শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল।

মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন।

মাহমুদ আলী খান জামী তাঁর ‘দর্দ কে সো শের’ (প্রকাশকাল: ১৯৫৫ খ্রি., দিল্লি) গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা মীর দর্দের দাদা বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে বুখারা থেকে এ দেশে এসেছিলেন, আর বাবা খাজা মাহমুদ নাসির আন্দালিব ছিলেন ‘শায়েরে উর্দু’ এবং ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুফি। ভিন্ন মতে, তাঁর বাবার নাম (মাহমুদ নাসির নয়) মুহাম্মদ, আর তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন না, ছিলেন ফারসি ভাষার কবি। এঁরা ছিলেন নকশবন্দী ঘরানার পথিকৃৎ খাজা বাহাউদ্দিনের বংশধর ও অনুসারী। সুফি পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই মাত্র বাইশ বছর—ভিন্ন মতে, সাতাশ বছর বয়সে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সুফি শুদ্ধাচারী হয়ে ওঠেন দর্দ এবং সুফি তত্ত্বসংক্রান্ত একাধিক বই লেখেন। ফলে তিনি যখন শের ও গজল লেখেন, তখন সেগুলোতে স্বভাবগত কারণেই সুফি মরমি কবিতার সহজগভীর ভাবের ছায়া পড়েছে। নিচে দর্দ কে সো শের বই থেকে—অন্যত্র গজলরূপে গণ্য এবং গীত—প্রথম ৩টি শের পড়লে এ কথার সত্যতা মিলতে পারে :

তোহমতে চন্দ অপনে জিম্মে ধর চলে
জিস লিয়ে আয়ে থে হম সো কর চলে
জিন্দেগি হ্যয় য়া কোই তোফান হ্যয়
হম তো ইস জিনে কে হাথোঁ মে মর চলে
শমা কে মানিন্দ হম ইস বজম মে
চশম নম আয়ে থে দামন তর চলে

অর্থাৎ :

কত অপবাদ বয়ে নিয়ে আমি চলছি
অথচ যে কারণে এসেছি তা–ই করে গেছি
এ কোনো জীবন, নাকি তুফান
তার হাতেই তো আমি মারা যাব
এই সভার প্রদীপ ছিলাম আমি
এখন আমার চোখের জলে আঁচল ভিজে যায়

[অনুবাদ: লেখক]

অল্প বয়স থেকে যিনি এমন ভাবনায় তাড়িত, তাঁর গজলে এই প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। সুফি কবি ও সাধক হিসেবে স্বীকৃত হলেও গজলকার হিসেবে যেরকম গণ্য হননি খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, ঠিক একই কারণেই গজলকার হিসেবে কেউ কেউ তাঁর নাম সমকালের মীর তকী মীর ও মির্জা রফী সওদার কাতারে রাখতে কুণ্ঠিত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মীর তকী মীরের একটি মন্তব্য আছে, যা অনেকেই উদ্ধৃত করেন, তা হলো: তিনি নাকি আড়াইজন কবিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যার মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন মির্জা রফী সওদা আর অর্ধজন হলেন খাজা মীর দর্দ।

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

শের ও গজলের ক্ষেত্রে মীর তকি মীর শেষমেশ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই জায়গা থেকে বিচার করে তাঁর এই কথাটিকে সদর্থে ধরে নিলে কবিতায় খাজা মীর দর্দের অবদানকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। আসলে পারস্য কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে উর্দু গজলে যখন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীর সঙ্গে আলাপের আবহ তৈরি হচ্ছে, খাজা দর্দ তখন একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন সুফি ঐতিহ্য। সমালোচকদের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ উর্দু’, কিন্তু তাঁর ‘শমা-এ মহফিল’, ‘আহ-এ দর্দ’, ‘দর্দ-এ দিল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষা ও সুফিহৃদয়ের ভাব সেই সময় ও পরবর্তীকালের কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি অনবদ্য শের হলো: ‘তমান্না তেরি হ্যাঁয় অগর হ্যাঁয় তমান্না/ তেরি আরজু হ্যায় অগর আরজু হ্যায়’ অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা তোমারই আকাঙ্ক্ষা/ আশা তোমার জন্য, আদৌ আশা বলে যদি কিছু থাকে’। প্রেমের এমন একনিষ্ঠ নিবেদন খাজা দর্দের শেরেই পাওয়া সম্ভব। নিচে পড়ে নিতে পারি তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় শের:

হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে ম্যারে আরমান ল্যাকিন পির ভি কম নিকলে

অর্থাৎ :

এমন হাজার বাসনা আমার, যার প্রতিটি বাসনার জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত
কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো বটে; কিন্তু তা খুবই সামান্য

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

আরও পড়ুনএকাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি২৮ আগস্ট ২০২৫

মীর দর্দের এমন উচ্চাসনে পৌঁছার অন্য একটি কারণ হলো, তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই গান শোনা ও তার চর্চা বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, সে বিষয়ে তাঁর সবিস্তার আলোচনা এবং গানবিষয়ক গান লেখার উদাহরণ। আমাদের অজানা নয়, গান বিষয়ে কওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমির খসরুর একাধিক বাণী আছে, যেমন: ‘গান হলো আত্মার খোরাক’, ‘দরবেশের কাছে গান হলো ঐশ্বরিক জ্যোতির সমতুল’ ইত্যাদি, আর দর্দ লিখেছেন: ‘অগর ঘিনা নফস কো বড়্কায়ে তো হারাম, অগর দিল কো ইলাহ কি তরফ নরম করে তো হালাল’ অর্থাৎ গান যদি মনকে প্রবৃত্তিতাড়িত হতে উসকে দেয় তাহলে হারাম, আর স্রষ্টামুখী করলে হালাল’। এ বিষয়ে দর্দের যে শের রয়েছে, সেটি আরও সুন্দর :

সামা’ আহলে দিল কো হ্যা সোদমন্দ দর্দ
কে ইস সে নরম হোতা হ্যা পাত্থর কা দিল ভি

অর্থাৎ :

হৃদয়বান মানুষের জন্য গান উপকারী, হে দর্দ
কারণ পাথরের মতো হৃদয়ও তাতে গলে যায়।

উল্লেখ্য যে, গান বিষয়ে আলোচনা করবার সময় এ অঞ্চলের গবেষক ও সুফি-বাউল-ফকিরেরা ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও আমির খসরুর বইয়ের তথ্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে কোথাও সৈয়দ খাজা মীর দর্দের কথা পাওয়া যায় না। জাভেদ হুসেন দর্দের কয়েকটি গজল অনুবাদ করতে গিয়ে তার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘দর্দ ছিলেন একজন বড় সংগীতজ্ঞ। সুফি সাধনায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে হুরমতে ঘিনা নামে পুস্তিকা লিখেছেন। উর্দু গজলের গীতিময়তা আজ দেখা যায় তাতে দর্দের ভূমিকা ব্যাপক ও গভীর।’ এই পুস্তিকাটি দুর্লভ, ভবিষ্যতে এটি অনূদিত হলে শায়ের ও গজলকার মীর দর্দের পাশাপাশি সংগীতচিন্তক হিসেবে তাঁর পরিচয়টাও আমরা জানতে পারব।

অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।
ই–মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ