প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের নারীরা মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক সংহতি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে সামাজিক পরিবর্তনে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন নারীদের প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করার জন্য জাতিসংঘ সিডও (CEDAW) চুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতি আরও দৃঢ় করে। এটি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং আইনি সংস্কারের বিষয়ে আন্দোলনকে আরও ত্বরান্বিত করে।

১৯৯১ সাল থেকে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে বিভিন্ন দফায় নারীরা দায়িত্ব পালন করলেও দেশের সর্বস্তরে নারীর অবস্থান এবং ক্ষমতায়ন সমভাবে দৃশ্যমান হয়নি। নারীর প্রতি অবিচার এবং ঘরে-বাইরে সর্বত্র যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছিল। ফলে ২০২০ সালে বাংলাদেশে নারীবাদী আন্দোলন এবং জনরোষের শক্তিশালী উত্থান ঘটে, যা মূলত ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ক্রমবর্ধমান ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছিল। সাম্প্রতিক ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’-এর মাধ্যমে নারীদের জন্য নির্ধারিত ১০ শতাংশ কোটা বাতিল করা হয়েছে, যা কাঠামোগত বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDGs) লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। এর ফলে নারীরা আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন।

২০২৪-এর যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সরকার পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছিল, সেখানেও নারীরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংস্কার কমিশনে ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব পাননি, বিশেষ করে তরুণ নারীরা আরও উপেক্ষিত হয়েছেন। তাই নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গসমতা এবং নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য চলমান আন্দোলন আরও জোরদার করা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

দেশে নারী আন্দোলনের পূর্ববর্তী সাফল্যকে সম্মান জানিয়ে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, লিঙ্গ সংবেদনশীল ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও বহ্নিশিখা, ইউএন উইমেনের সহায়তায় একটি দাবিনামা তৈরি করেছে। বিভিন্ন পর্যায়ের ও প্রজন্মের নারীদের একত্র করে, বিশেষত যাঁরা প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, তাঁদের সমান অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এই চার্টার প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও আন্তপ্রজন্মভিত্তিক পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে জাতীয় থেকে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন অংশীদারের শতভাগ অংশগ্রহণ ও মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

নারী ও কন্যাশিশুর অধিকার

এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বিষয়বস্তু  হলো, ‘সকল নারী ও মেয়েদের জন্য: অধিকার, সমতা এবং ক্ষমতায়ন। ইউএন উইমেনের বেইজিং ডিক্লারেশন এবং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশনের ৩০তম বার্ষিকী উপলক্ষে বৈশ্বিক প্রচারণার আওতায় ‘সকল নারী ও মেয়েদের জন্য’ বিষয়বস্তুর অধীনে এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একটি জোরালো আহ্বান জানানো হয়। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জোর দেওয়া হচ্ছে, যা হলো নারী এবং কন্যাশিশুদের অধিকার উন্নীত করা, নারী ও কন্যাশিশুদের পূর্ণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া এবং সব ধরনের সহিংসতা, বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলা—

১। নারী ও মেয়েদের অধিকারের অগ্রগতি: সব ধরনের সহিংসতা, বৈষম্য এবং শোষণকে চ্যালেঞ্জ করে নারী ও মেয়েদের পূর্ণাঙ্গ মানবাধিকারের জন্য নিরলসভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়া।

২। লিঙ্গসমতা প্রচার: কাঠামোগত বাধা দূর করা, পিতৃতন্ত্র ভাঙা, চিরাচরিত বৈষম্য দূর করা এবং প্রান্তিক নারী ও কন্যাশিশু, বিশেষ করে তরুণীদের কণ্ঠ তুলে ধরা করা, যাতে অন্তর্ভুক্তি এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা যায়।

৩। ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি: শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নেতৃত্ব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে ক্ষমতা কাঠামো পুনর্নির্ধারণ। তরুণী ও মেয়েদের নেতৃত্ব ও উদ্ভাবনের সুযোগকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

জুলাইয়ের আন্দোলনের পর নারীপক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারকে মোট ৮টি ক্যাটাগরিকে প্রাধান্য দিয়ে একটি দাবিনামা উপস্থাপন করে। বিভাগীয় পর্যায়ে অংশীজনদের সঙ্গে বিস্তর আলোচনার মাধ্যমে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারা স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রস্তাবনা দেয়। আটটি বিভাগের মধ্যে রয়েছে: সহিংসতা থেকে নারীদের মুক্তি, নারীদের অর্থনৈতিক অধিকার, নারীদের রাজনৈতিক অধিকার, নারীদের স্বাস্থ্য অধিকার, নারীদের শিক্ষা, জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষা, প্রান্তিক নারীদের অধিকার এবং সাম্প্রদায়িক ঐক্য প্রতিষ্ঠা।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং বহ্নিশিখা সম্মিলিতভাবে যে দাবিনামাটি তৈরি করেছে, তা ছয়টি প্রধান বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে—শিক্ষা, যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, স্বাস্থ্য, আইন সংস্কার ও ন্যায়বিচারের প্রাপ্যতা, নারীদের অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং অবৈতনিক কাজ; জেন্ডার বাজেট এবং সুশাসন। নারী এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলোর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য নির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে এই ক্ষেত্রগুলোর অধীনে; যা স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য বাস্তবায়নযোগ্য।

ফওজিয়া মোসলেম,

সভাপ্রধান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

‘রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীদের নেতৃত্বে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন শুধু নারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং এটি জাতীয় উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে মূলধারার রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।’

Suvra Kanti Das.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক ষমত য ন ত ক ক ষমত দ র জন য র জন ত ক দ র কর র র জন গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

ইসির ভূমিকা তদন্তে কমিটি গঠন করার নির্দেশ

বিতর্কিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে জড়িত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার ও সচিবালয়ের সচিবদের ভূমিকা তদন্তে অবিলম্বে কমিটি গঠনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক বৈঠকে এ-সংক্রান্ত আলোচনা শেষে এমন নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে ।

এই বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফররাজ হোসেন ও মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

বৈঠকে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে যে অতীতের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজনে কর্মকর্তাদের ভূমিকা তদন্ত করা এবং তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।

জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই সনদ

বৈঠকে কমিশন সদস্যরা জুলাই সনদ তৈরির কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বেশ কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। শিগগিরই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সনদ চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘সবাই জুলাই সনদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আশা করি, আগামী জুলাই মাসের মধ্যে আমরা এটি জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারব।’

‘প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে’

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর লন্ডন সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, লন্ডনে বাংলাদেশি কমিউনিটির যাঁদের সঙ্গেই দেখা হয়েছে, তাঁরা সংস্কার নিয়ে জানতে চেয়েছেন। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা খুব আগ্রহী। তাঁরা বিস্তারিতভাবে ঐকমত্য কমিশনের কাজ নিয়ে তাঁর (প্রধান উপদেষ্টা) সঙ্গে আলোচনা করেছেন, মতামত দিয়েছেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যেখানেই গিয়েছি, সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, “আমরা আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে পারব তো?” আমাদের প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। পোস্টাল ব্যালট এবং আর কী কী অপশন আছে, সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ