মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ ও মামলার ঘটনায় সমাজের নানা পেশার মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গতকাল রোববার বলেছেন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে তদন্তের সময় ৩০ দিন থেকে কমিয়ে ১৫ দিন করা হচ্ছে। আর ধর্ষণের মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে বিচার করতে হবে।

পাঁচ বছর আগে (২০২১) নোয়াখালীর হাতিয়ায় এক গৃহবধূকে ধর্ষণচেষ্টার পর বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর একইভাবে সমাজের নানা পেশার মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। তখন মানবাধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’ রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন পাস হয়। এখন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, গত বছর সারা দেশে বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার ৫টি। এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতনসংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ১৭ হাজার ৫৭১টি। শতকরা হিসাবে দেশের ফৌজদারি অপরাধের মামলার ১০ শতাংশ হচ্ছে নারী ও শিশু নির্যাতনসংক্রান্ত। এর আগের বছরও (২০২৩) নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় সারা দেশে ১৮ হাজার ৯৪১টি মামলা হয়।

অর্থাৎ দেশে প্রতিনিয়ত নারী ও শিশুদের নানাভাবে যৌন নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুনের শিকার হওয়ার অভিযাগে মামলা হচ্ছে। ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধের ঘটনায় এসব মামলা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীদের শাস্তি হচ্ছে না। এর পেছনে একটি বড় কারণ রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতা।

‘সাজা মাত্র ৩ শতাংশ মামলায়’

নারী ও শিশু নির্যাতনে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের বিশেষ আইনটি পাস হয় ২০০০ সালে। এর আগেও ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিশেষ আইন ছিল। আইন থাকলেও নারী ও শিশু নির্যাতন কমছে না। ধর্ষণের মতো অপরাধ করার পরও যদি কারও শাস্তি না হয়, মামলা থেকে খালাস হয়ে যায়, তখন সেই অপরাধী আবার নতুন নতুন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ভুক্তভোগী নারী ন্যায়বিচার না পেয়ে মনঃকষ্ট নিয়ে দিনের পর দিন দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।

ছয় বছর আগে (২০১৮) প্রথম আলো ঢাকা মহানগরসহ ঢাকা জেলার বিগত ১৫ বছরে ছয় ধরনের অপরাধ (ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত মৃত্যু ও হত্যা, দলবদ্ধ ধর্ষণ, সম্ভ্রমহানি করে আত্মহত্যায় প্ররোচনা, যৌনপীড়ন ও যৌতুকের জন্য হত্যা বা হত্যাচেষ্টা) নিয়ে অনুসন্ধান করে। তার ভিত্তিতে ২০১৮ সালে প্রথম আলোর অনুসন্ধান, ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, ‘সাজা মাত্র ৩ শতাংশ’ শীর্ষক বই প্রকাশ করে প্রথমা প্রকাশন।

প্রথম আলোর সেই অনুসন্ধান অনুযায়ী, ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ২০০২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ২৭৭টি। চলমান মামলার সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫৮৭টি। নিষ্পন্ন হওয়া মামলার মধ্যে সাজা হয়েছিল ১০৯টি মামলায়। শতকরা হিসাবে সাজা মাত্র ৩ শতাংশ। বাকি ৯৭ শতাংশ মামলার ক্ষেত্রে আসামিরা হয় অব্যাহতি পেয়েছেন (অর্থাৎ মামলা পর্যন্ত যায়নি), নয়তো তাঁরা বিচারে খালাস পেয়েছেন।

খালাসের পেছনের অন্যতম কারণ হচ্ছে যথাসময়ে সাক্ষীদের হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছেন পুলিশ ও সরকারি কৌঁসুলিরা (পিপি)। তখন ১৫ বছর ধরে ঝুলে থাকা ধর্ষণ মামলার সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৬০৪টি। কেন এমনটি হয়, তার ব্যাখ্যায় ফৌজদারি আইনবিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, দেশে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিসের ব্যবস্থা না থাকায় দলীয় ভিত্তিতে পিপি নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয় তাঁদের সম্মানীও অনেক কম। যত দিন পর্যন্ত স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস চালু না হবে, তত দিন ফৌজদারি মামলায় দোষীদের সাজার হার বাড়বে না। মামলা হবে, তদন্তও হবে, দিনের পর দিন মামলা আদালতে ঝুলতে থাকবে, সাক্ষী আসবেন না, বহু বছর পর আদালত থেকে আসামি খালাস পেয়ে যাবেন। আবার নতুন করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে। তখন সমাজের নানা পেশার মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাবেন। বেশ কয়েক দিন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হতে থাকবে। আবার নতুন কোনো ঘটনা আসার পর ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণের মতো অপরাধের ঘটনাগুলো অনেকটা আড়ালে চলে যাবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও তলিয়ে দেখেন না, কেন বছরের পর বছর ফৌজদারি মামলা ঝুলে থাকে? কেন খুন, ধর্ষণ, ডাকাতির ঘটনায় দোষীদের সাজা হয় না? দেশে তৈরি হয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি।

‘প্রয়োজন স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস’

আইনজ্ঞরা মনে করেন, সরকার যদি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গড়ে তোলে, অভিজ্ঞ আইনজীবীদের ভালো সম্মানী দিয়ে পিপি হিসেবে নিয়োগ দেয়, তাঁদের প্রত্যেককে জবাবদিহির আওতায় আনে, তাহলে ধর্ষণসহ ফৌজদারি মামলায় দোষীদের সাজার হার বিচারিক আদালতে বাড়বে। ধর্ষণসহ প্রতিটি ফৌজদারি মামলার বিচারসংক্রান্ত তথ্যের হালনাগাদ আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে রাখতে হবে।

বিশ্বের প্রতিটি আধুনিক রাষ্ট্রে ফৌজদারি অপরাধসংক্রান্ত প্রতিটি তথ্য, মামলা, তদন্ত ও বিচারের সাজার হার–সংক্রান্ত যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহের আলাদা দপ্তর বা ব্যুরো রয়েছে। এই দপ্তর ধর্ষণ, খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, মানি লন্ডারিংসহ প্রতিটি ফৌজদারি মামলায় কত শতাংশ মামলায় অভিযোগপত্র জমা হয়, কত শতাংশ মামলায় সাজা হয়, সেটির বাৎসরিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশেই এর ব্যতিক্রম। সংশ্লিষ্ট আইনজ্ঞরা মনে করেন, সরকার যত দিন পর্যন্ত প্রতিটি ফৌজদারি মামলার বিচারের তথ্য সংগ্রহের আলাদা দপ্তর না করছে, যত দিন না ফৌজদারি অপরাধের সাজার হারের তথ্য প্রকাশ করছে, তত দিন পুলিশ কিংবা পিপিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ জবাবদিহির আওতায় আসবেন না। সে কারণে যত দ্রুত সম্ভব ফৌজদারি মামলার তথ্য সংগ্রহের জন্য আলাদা একটি দপ্তর করা প্রয়োজন।

বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিচারের জন্য কীভাবে দিনের পর দিন ঘুরতে হয়, তার একটি উদাহরণ হিসেবে ২০০৭ সালের একটি মামলার কথা উল্লেখ করা যায়। ওই বছর এক সন্ধ্যায় ঢাকার প্রান্তে আত্মীয়ের বাড়ি থেকে শহরের মধ্যে বাসায় ফিরছিল ১৩ বছরের একটি মেয়ে। পরিচিত দুই তরুণ তাকে ডেকে নিয়ে সারা রাত আটকে রেখে ধর্ষণ করেন। এই অভিযোগে তার মা মামলা করেন। মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পেয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু পুলিশ এক আসামির হদিস বের করতে না পারায় তিনি অব্যাহতি পান। অন্যজন প্রায় আট বছর বিচার চলার পর সাক্ষীর অভাবে খালাস পান। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ১৩ জন সাক্ষী ছিলেন। কিন্তু মামলার বাদী মেয়েটির মা ও মেয়েটি ছাড়া আর কোনো সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। একটি বড় সময়জুড়ে পিপিরা সাক্ষী হাজির করার জন্য সময় চেয়ে আবেদন করে গেছেন। একপর্যায়ে ঢাকার একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থেকে আসামিরা খালাস পান।

আমাদের সমাজে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতির মতো নৃশংস ঘটনা ঘটতে থাকে, বেশির ভাগ ঘটনায় মামলা হয়, তদন্ত হয়, বিচারের জন্য আদালতে বারবার তারিখ পড়তে থাকে, সাক্ষী আসে না, রাষ্ট্রপক্ষ দরখাস্ত দিয়ে যেতেই থাকে। এভাবে কেটে যায় বছরের পর বছর। ধুলা জমতে থাকে মামলার নথিতে। তবে এর ব্যতিক্রম রয়েছে। যেসব মামলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ তৎপর থাকে, বিশেষ করে ভুক্তভোগীর পরিবার বিচারের জন্য উদ্‌গ্রীব থাকে, দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় ঘোরে, সাক্ষীদের হাজির করা হয়, সেসব ক্ষেত্রে বিচারের ফলাফল আসে রাষ্ট্রপক্ষে। অপরাধীর সাজা হয়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যায়বিচার।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ পাসের পর বিগত ২৫ বছরে কত নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন? কতজন অপরাধীর সাজা হয়েছে? সেসব পরিসংখ্যান প্রকাশ করা জরুরি। তাহলে বিচারহীনতার যে অভিযোগ জনমনে দানা বেঁধেছে, তা পরিষ্কার হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ ন র পর দ ন র ষ ট রপক ষ হ জ র কর র র জন য র ঘটন য় অপর ধ র র পর ব প রথম র করত র একট বছর র সরক র তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের বেতন বাড়াল বিসিবি

জাতীয় দলের নারী ক্রিকেটারদের বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। আজ মিরপুরে বিসিবি পরিচালকদের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এত দিন ‘এ’ ক্যাটাগরিতে থাকা মেয়েরা ১ লাখ ২০ হাজার টাকা মাসিক বেতন পেতেন। তাঁদের বেতন ৪০ হাজার টাকা বাড়ানো হচ্ছে। ‘বি’ ক্যাটাগরিতে থাকা ক্রিকেটাররা পেতেন ১ লাখ টাকা করে বেতন। তাঁরা এখন থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বেতন পাবেন।

‘সি’ ক্যাটাগরিতে থাকা ক্রিকেটারদের বেতন ৭০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৫ হাজার টাকা করা হয়েছে আর ‘ডি’ ক্যাটাগরিতে ৬০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ হাজার টাকা।
এ ছাড়া জাতীয় দলের অধিনায়কদের জন্য ৩০ হাজার ও সহ-অধিনায়কদের জন্য ২০ হাজার টাকা অতিরিক্ত দেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছে।
১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া নারী ক্রিকেটারদের নতুন চুক্তিতে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে আছেন তিন ক্রিকেটার—নিগার সুলতানা, নাহিদা আক্তার ও শারমিন আক্তার। ‘বি’ ক্যাটাগরিতে আছেন ফারাজনা হক, রিতু মনি, ফাহিমা খাতুন, মারুফা আক্তার, রাবেয়া খান ও সোবহানা মোস্তারি। ‘সি’ ক্যাটাগরিতে একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে আছেন স্বর্ণা আক্তার।

আরও পড়ুনবিশ্বকাপে কোনো ম্যাচ না জিতলেও ৩ কোটি টাকা পাবেন নিগাররা৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

‘ডি’ ক্যাটাগরিতে আছেন সুমাইয়া আক্তারর, ফারিহা ইসলাম, রুবাইয়া হায়দার, সানজিদা আক্তার, নিশিতা আক্তার। এই চুক্তির বাইরে থাকা ক্রিকেটারদের কেউ জাতীয় দলে এলে মাসে ৬০ হাজার টাকা বেতন পাবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ