পরিবারের সচ্ছলতার জন্য লিবিয়া পাড়ি জমান মতিয়ার রহমান সাগর (২৪)। যখন তিনি দেশটির বেনগাজী পৌঁছান, তখনও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন চোখে। বাড়িতে রেখে যাওয়া নববধূকে ঘিরে সংসার সাজানোর জন্য কষ্টের কাজ নেন। পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে তিন-চার মাস কাজ করার পরই বিপদ গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে এই তরুণের দিকে। যার পরিসমাপ্তি হয়েছে গত ১১ ফেব্রুয়ারি। এদিন ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়ে মৃত ভেবে সাগরকে ফেলে যায় লিবিয়ার মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। এর আগে ১০টি মাস পৈশাচিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে সাগরকে।
ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার জামতলাপাড়া গ্রামের কৃষক ইছা নবী ও মিনারা বেগম দম্পতির বড় ছেলে সাগর। তাদের ছোট ছেলে মারুফের বয়স ১৪। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে সাগর লিবিয়ার বেনগাজী যান। সেখানে ক্লিনারের কাজ নেন। মাস তিনেক পর পাশের বাউলি গ্রামের মোজাম্মেল হক মোজাম জানায়, সাগরকে তিনি ইতালি পাঠাতে পারবেন। সেখানে বেতনও বেশি পাওয়া যাবে। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানার পাটিকাবাড়ী এলাকার রবিজুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলামের মাধ্যমে ইতালিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেয় মোজাম।
এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে ইছা নবী ১৭ ফেব্রুয়ারি মহেশপুর থানায় যে মামলা করেছেন, তার এজাহারে। সম্প্রতি এই পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সাগরের ওপর লিবিয়ায় ভয়াবহ নির্যাতন চালানোর তথ্য পাওয়া যায়। তারা জানিয়েছেন, মোজামের হাতে ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট প্রথম দফায় ৪ লাখ টাকা দেন তারা। একই মাসের ২৫ তারিখে দেওয়া হয় আরও ৭ লাখ টাকা। এর কয়েক মাস পরই (২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি) বেনগাজি থেকে ইতালি নেওয়ার জন্য দালাল চক্রের সদস্যরা সাগরসহ পাঁচ বাংলাদেশিকে অজ্ঞাত এক মরুভূমিতে নিয়ে যায়। সেখানকার একটি ঘরে মোট সাতজনকে বন্দি করে রাখে। সেখানে নিয়ে শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি কল করে বাবা ইছা নবীকে জানায়, সাগরকে ছাড়াতে হলে ৩৬ লাখ টাকা লাগবে। এ সময় তারা ভিডিও কলে দেখানো হয় তাঁর সন্তানকে নির্মমভাবে মারধরের দৃশ্য। 
ওই চক্রের কথামতো তারা প্রথম দফায় ৯ লাখ টাকা মাদারীপুর জেলার ফকিরপাড়ার একটি গোরস্তানের কবরে রেখে আসেন। কিছুদিন পর আরেকটি খড়ের গাদায় রাখতে হয় ৬ লাখ টাকা। তৃতীয় কিস্তিতে কুষ্টিয়ার পোড়াদহ তাহের মোড়সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা আল-আমিনের (লিবিয়াপ্রবাসী) বাবার কাছে আরও ৪ লাখ টাকা দেন তারা। সর্বশেষ দুটি লেনদেন করতে হয় ব্যাংকিং মাধ্যমে। ২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর যমুনা ব্যাংক ঝিনাইদহ শাখায় একটি অ্যাকাউন্টে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা ও চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সামন্তা বাজার শাখার একটি অ্যাকাউন্টে ১ লাখ টাকা জমা দেওয়া হয়। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি সাগর ও আরেক বাংলাদেশিকে মরুভূমিতে ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা।
সম্প্রতি জামতলাপাড়ায় গিয়ে কথা হয় সাগরের বাবা ইছা নবীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ছেলেকে ওরা খুবই নির্যাতন করত। সপ্তাহে এক দিন ঘরের বাইরে বের করে গায়ে পানি ছিটাতো; সূর্যের আলো দেখতে দিত। একটি কক্ষে সাতজনকে রেখেছিল। এদের দু’জন মারা গেলে ১১ ফেব্রুয়ারি তাঁর ছেলেসহ পাঁচজনকে একটি মরুভূমিতে ফেলে আসে। 
মুক্তিপণের টাকা দিতে গিয়ে সব হারিয়েছেন বলে জানান সাগরের মা মিনারা বেগম। তিনি বলেন, তারা সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। এ ঘটনায় জড়িতদের কঠোর শাস্তি চান। পাশাপাশি ছেলেকে দেশে ফেরাতে সরকারের সহায়তা কামনা করেন। 

আলোহীন কক্ষে সাগরের মতো অন্য বাংলাদেশিদের ওপর দুর্বৃত্তরা অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায়। নিয়মিত মারধর করা হয় লোহার রড ও লাঠি দিয়ে। প্রায়ই দেওয়া হতো বৈদ্যুতিক শক। ওই দুর্বৃত্তদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর একটি ভিডিও বার্তা দেন সাগর। সেখানে বলেন, ‘আমাকে খুবই নির্যাতন করত। দীর্ঘদিন মাফিয়া চক্রের 
কাছে জিম্মি ছিলাম। শরীরের অবস্থা খুব খারাপ, ঠিকমতো দাঁড়াতে পারি না। হাতে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে পচন ধরেছে। মুক্তিপণের টাকা দিয়ে 
আমার পরিবার সর্বস্বান্ত। দেশে ফিরব বা চিকিৎসা করব সে সামর্থ্য আমার নেই।’ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আকুতি জানান তিনি। 
এ ঘটনায় ১৭ ফেব্রুয়ারি মহেশপুর থানায় মামলা করেন সাগরের বাবা ইছা নবী। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে টাকা লেনদেনকারী মোজাম্মেল হক মোজামকে। এ ছাড়া কুষ্টিয়ার রবিজুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলামের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও সাতজনকে আসামি করেন তিনি। 
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মোজাম্মেল হক মোজামের বাড়ি মহেশপুরের বাউলি গ্রামে যান এ প্রতিবেদক। সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি। গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ মুন্নাফ ও আব্দুল্লাহ বলেন, মোজাম্মেল হক মোজাম টাকা নিয়ে মানুষকে বিদেশ পাঠান। এ চক্রের প্রধান ব্যক্তিরা কুষ্টিয়া জেলার বাসিন্দা। মোজাম লোক খোঁজার মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন।
গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর সাগরের পরিবার দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা জমা দিয়েছিল যমুনা ব্যাংকের ঝিনাইদহ শাখায়। ওই শাখার ব্যবস্থাপক আতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমরা এনআইডি রেখে টাকা জমা নিয়েছি। মামলা হয়েছে। এখন আদালত যদি লেনদেন বা এই অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে তথ্য চায়, তখন আমরা বিস্তারিত দিতে পারব।’
মহেশপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাজ্জাদুর রহমান জানান, সাগরের বিষয়ে তাঁর বাবা ইছা নবী ১৭ ফেব্রুয়ারি মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে থানায় মামলা করেছেন। এতে তিনজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় সাতজনকে আসামি করা হয়। মানব পাচারকারী ওই চক্রের সদস্যদের ধরতে তারা অভিযান চালাচ্ছেন। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ম জ ম ম ল হক ম জ ম ল ইসল ম স তজনক পর ব র র একট স গরক

এছাড়াও পড়ুন:

একই সময় একই মাঠে ফুটবল ও ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে সংঘর্ষে আহত ১৫, একজন আইসিইউতে

রাজশাহীর বাঘায় একই দিন একই সময়ে ফুটবল ও ক্রিকেট প্রীতি ম্যাচের আয়োজনকে কেন্দ্র করে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। উপজেলার বাউসা হারুন অর রশিদ শাহ্ দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এ ঘটনায় ১৫ জন আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সাতজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। একজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটায় ওই মাঠে বিবাহিত ও অবিবাহিত প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করেন আড়ানী ইউনিয়নের বেড়েরবাড়ি গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁরা স্কুলের মাঠটিতে খেলার জন্য বিএনপির স্থানীয় নেতা শাহিনুর রহমানের কাছে অনুমতি নিয়ে মাঠে আসেন। অপর দিকে একই মাঠে বিবাহিত ও অবিবাহিতদের প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করেন বাউসা ইউনিয়নের বাউসা চকরপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা।

একই দিন ও একই সময়ে ক্রিকেট ও ফুটবল দলের খেলোয়াড়েরা মাঠে নামলে মারামারির ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের ১৫ জন আহত হন। গুরুতর আহত সাতজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

আড়ানী বেড়েরবাড়ি ক্রিকেট দলের আহত ব্যক্তিরা হলেন রানা আলী (২৪), মতিউর রহমান (৪২), আনছার আলী (২৮), বিল্পব আলী (২০)। বাউসা চকর পাড়া ফুটবল দলের আহত ব্যক্তিরা হলেন ফরহাদ আলী (১৬), তপু আহম্মেদ (১৫) ও সিয়াম হোসেন (১৮)। এর মধ্যে রানা আলী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে ও মতিউর রহমান ৮ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জানান, শাহিনুর রহমান বিএনপির কোনো পদ–পদবিতে নেই। এ ছাড়া তিনি স্কুলের মাঠ অনুমতি দেওয়ার কেউ না।

শাহিনুর রহমান বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী আড়ানী ইউনিয়নের বেড়েরবাড়ি গ্রামের লোকজন স্কুলের মাঠে ক্রিকেট খেলার জন্য বলেছিলেন। তাই আমি তাদের খেলতে বলেছি। বিষয়টি জানার পরও চকরপাড়া গ্রামের লোকজন ফুটবল খেলার জন্য মাঠে আসে। পরে তাদের অনুরোধ করেও মানাতে পারিনি। পরে উভয় পক্ষের মারামারিতে অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন।’

বাঘা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি আ ফ ম আছাদুজ্জামান বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় রানার বাবা রুস্তুম আলী বাদী হয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • একই সময় একই মাঠে ফুটবল ও ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে সংঘর্ষে আহত ১৫, একজন আইসিইউতে