ট্রেনের ই-টিকিট কালোবাজারি বন্ধ হবে?
Published: 13th, March 2025 GMT
ট্রেনের টিকিট নিয়ে যাত্রী দুর্ভোগ, কালোবাজারি বহুল আলোচিত। ধারণা করা হতো, টিকিট কাটার ব্যবস্থা ডিজিটাল হলে এসব সমস্যা থাকবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, টিকিট অনলাইনে এলেও যাত্রী দুর্ভোগ শেষ হয়নি। এখন ট্রেনের টিকিট কাটতে কাউন্টারের বদলে অনলাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।
এটা ঠিক, ঈদ উপলক্ষে ট্রেনের শতভাগ টিকিট অনলাইনে দেওয়া হচ্ছে। অনলাইনে ফোন নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে নিবন্ধন করে একসঙ্গে সর্বোচ্চ চারটি টিকিট কাটা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ফোন নম্বরে ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) পাঠিয়ে সফল যাচাইয়ের পরই যাত্রীকে টিকিট সরবরাহ করার কথা। কিন্তু তাতে কি যাত্রী হয়রানি দূর হবে?
গত ঈদুল আজহাতেও শতভাগ টিকিট অনলাইনে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনেকে বারবার চেষ্টা করেও কাটতে পারেননি কাঙ্ক্ষিত টিকিট। এ কথা সত্যি, ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে বছরের পর বছর চলা অসন্তোষ আর অব্যবস্থাপনা কিছুটা দূর হয়েছে। ব্যাপক হারে কালোবাজারির অভিযোগও কিছুটা কমেছে। তবে পুরোপুরি ঠেকানো যায়নি।
স্তরভিত্তিক যাচাইকরণের মাধ্যমে অনলাইন থেকে শতভাগ টিকিট বিক্রির সুবিধা চালু হওয়ার পরও গত বছর ঈদুল আজহার সময় ৫০০ টিকিটসহ ১২ কালোবাজারিকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছিল। র্যাব সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল, তারা অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে টিকিট কেটে তা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করে আসছিল! সামাজিক মাধ্যমে কিন্তু এ ধরনের বিজ্ঞাপন এখনও দেখা যায়। ঈদ ও ছুটিছাটায় এই দুর্বৃত্ত চক্রের দৌরাত্ম্য বাড়ে।
গত বছর ১৫ নভেম্বর কিশোরগঞ্জে ট্রেনের ৭০টি আসনের ১৯টি টিকিটসহ কালোবাজারি চক্রের দু’জন আটক হয়েছিল। তারা পরিচিতজনের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে টিকিট কেটে দুই থেকে তিন গুণ দামে বিক্রি করত। এ রকম ঘটনা প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে আসছে। কাজেই এটা স্পষ্ট, শতভাগ ডিজিটাল হলেও কালোবাজারি আটকানো যাচ্ছে না। উল্টো ডিজিটালের চক্করে পড়ে কিছু মানুষ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ট্রেন ভ্রমণে নিরুৎসাহিত কিংবা বঞ্চিত হচ্ছেন।
কালোবাজারিদের আটকাতে একটা এনআইডির বিপরীতে সর্বোচ্চ চারটি টিকিট কাটা যাচ্ছে। কিন্তু পরিবারে সদস্য চারজনের বেশি হলে তাদের জন্য সমাধান কী? ফের অনলাইনে ঢুকে নতুন এনআইডি দিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য টিকিট পাওয়া যাবে কিনা, গ্যারান্টি নেই। পাওয়া গেলেও পাশাপাশি আসনে কিংবা একই কামরায় যাওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। ছুটিছাটায় অনেকে দলবদ্ধ হয়ে কক্সবাজার, সিলেটসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমণ করেন। তাদের জন্যও ব্যবস্থাটি সুখকর নয়। কালোবাজারি বন্ধ করতে গিয়ে নতুন সমস্যার উদ্ভব তো টেকসই সমাধান হতে পারে না!
বলা হচ্ছে, রেলের কর্মকর্তারা পয়েন্ট অব সেল (পিওএস) মেশিনের মাধ্যমে টিকিট যাচাই করবেন। কেউ অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকিট কেটে ভ্রমণ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যবস্থাকে ‘টিকিট যার ভ্রমণ তার’ বলছে রেলওয়ে। এর পরও কীভাবে একজনের টিকিটে অন্য কেউ ট্রেনে ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছেন– সে প্রশ্নের উত্তর রেলওয়েকেই দিতে হবে। এ রকমও তো অভিযোগ আছে, ট্রেনের যাত্রীর বড় একটা অংশ টিকিট ছাড়াই ভ্রমণ করে থাকে। রেলওয়ের বছরের পর বছর আর্থিক ক্ষতির কারণ হিসেবে অনেকের মধ্যেই ‘বিনামূল্যে’ ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে।
মানুষ যেন পরিবার-পরিজন নিয়ে একসঙ্গে ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারে, এ জন্য এক এনআইডির বিপরীতে চার টিকিট দেওয়ার বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।
‘টিকিট যার ভ্রমণ তার’– এ ব্যবস্থাটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে এক এনআইডির বিপরীতে টিকিট দেওয়ার সীমা তুলে দেওয়া সম্ভব।
প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখেই যদি এনআইডি এবং টিকিট চেক করে যাত্রীর পরিচয় নিশ্চিত করা হয়, তবে কালোবাজারি ও টিকিটবিহীন অবৈধ যাত্রীর ভ্রমণ বন্ধ করা সম্ভব। আর ট্রেনের ভেতরে চেকিং তো রয়েছেই। পরিচয়পত্রের সঙ্গে টিকিটের ওপরে মুদ্রিত যাত্রীর তথ্য না মিললে যাত্রীকে বিনা টিকিটে ভ্রমণের দায়ে অভিযুক্ত করে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য রেলওয়েকে চেকিং পয়েন্টে বিশেষ করে ঈদসহ অন্যান্য ছুটি ও উৎসবে জনবল বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে উৎসবভিত্তিক অস্থায়ী জনবল নিয়োগ করা যেতে পারে। স্বেচ্ছাসেবী ও ছাত্রদেরও কাজে লাগানো যায় কিনা, ভেবে দেখা দরকার।
ট্রেনের টিকিট কাটার ক্ষেত্রে বড় অভিযোগ হচ্ছে, ঈদ-পার্বণ-ছুটিছাটায় কাঙ্ক্ষিত টিকিট পাওয়া যায় না। এবার ঈদযাত্রায় ১৪ মার্চ দেওয়া হবে ২৪ মার্চের টিকিট। প্রতিদিন গড়ে ৩৫ হাজার টিকিট ছাড়বে রেলওয়ে। কিন্তু যাত্রী তো কয়েক লাখ। আশু এর কোনো সমাধান রেলওয়ের হাতে আছে বলে মনে হয় না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, সেতু, সিঙ্গেল ট্রেনলাইনসহ নানা সীমাবদ্ধতায় চাইলেই ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। বিকল্প হচ্ছে ট্রেনে বাড়তি বগি জুড়ে দেওয়া। কিন্তু ট্রেনের যে ইঞ্জিন, তারও তো লিমিট আছে। ফলে চাইলেই বগির সংখ্যা বাড়ানো যায় না। কিন্তু এটাও তো সত্য, আরামদায়ক এবং ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ায় মানুষ ট্রেনে ভ্রমণ পছন্দ করেন। এই সত্যটা রেলওয়েকে অনুধাবন করতে হবে। ট্রেনকে যাত্রীবান্ধব হিসেবে সক্ষমতা বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের বিকল্প নেই।
হাসান জাকির: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
prantojakir@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস থ র লওয় শতভ গ
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে যাক
লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকটি নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, তার অবসান হবে আশা করা যায়। নির্বাচনের দিনক্ষণের বিষয়ে দুই পক্ষই নীতিগতভাবে একমত হয়েছে যে ২০২৬ সালের রোজার আগে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।
সাম্প্রতিক কালে নানা বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপি নেতৃত্বের বিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছিল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে বিএনপি–দলীয় প্রার্থী ইশরাক হোসেনের শপথ ইস্যু সেই বিরোধকে আরও বাড়িয়ে দেয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সর্বশেষ বৈঠকে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি ও আকাঙ্ক্ষা পুনর্ব্যক্ত করে।
কিন্তু ঈদুল আজহার আগের রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার ব্যাপারে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়। এর আগে বিএনপির নেতৃত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনে তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে।
এমনই একটি পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরের সময় লন্ডনে তাঁর সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বৈঠকের ঘোষিত যৌথ বিবৃতিতে নির্বাচনের দিনক্ষণের বিষয়টি সামনে এলেও দুই পক্ষের আলোচনা কেবল এর মধ্যে সীমিত ছিল না। প্রধান উপদেষ্টার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান ও সংস্কারের ধারাবাহিকতার ওপরও জোর দেন তঁারা।
বৈঠকের ফলাফলকে প্রায় সব দলই স্বাগত জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি ঘোষণার ধরন নিয়ে আপত্তি জানালেও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সরাসরি বিরোধিতা কেউ করেনি। আমরাও মনে করি, কোনো বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমেই তা সমাধান করতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ যারা সংস্কার ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে, সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। লন্ডন বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার ও বিচারকাজ দৃশ্যমান করার ওপর জোর দিয়েছেন। ভবিষ্যতে যাতে দেশে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনরাগমন না ঘটে, সে জন্য রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটি ত্বরান্বিত করা জরুরি। আবার অপরাধ করে যাতে কেউ পার না পায়, সে জন্য জুলাই-আগস্টের হত্যার বিচারও অপরিহার্য। কিন্তু এই দুটি বিষয়কে কোনোভাবে নির্বাচনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা সমীচীন হবে না।
যেসব সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে নির্বাচন ও সংবিধানের বিষয়টি জড়িত নয়, সেগুলো সরকার নির্বাহী আদেশেও বাস্তবায়ন করা যায়। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তেমন বাধা আসার কথা নয়। তবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার অর্থ এই নয় যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এখন নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করাই বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক দলগুলোর সার্বিক সহযোগিতা না থাকলে সরকার একা কাজটি করতে পারবে না।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্দলীয় ও আন্তদলীয় সংঘাতের যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে না চললে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না। আমরা আশা করি, দিন-তারিখের বিষয়ে সমঝোতার পর নির্বাচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন। রাজনীতিতে মত ও পথের পার্থক্য থাকবে; তাই বলে একে অপরকে ‘শত্রুজ্ঞান’ করার পুরোনো সংস্কৃতি থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।