পুতিন সবার সঙ্গে মিথ্যা বলছেন: জেলেনস্কি
Published: 15th, March 2025 GMT
রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চল এবং ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মিথ্যা বলছেন বলে মন্তব্য করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির পুতিন। আজ শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ কথাগুলো বলেছেন।
তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলছে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। এরই মধ্যে গত গ্রীষ্মে অনেকটা আকস্মিকভাবে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী কুরস্ক অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা দখল করে নেন ইউক্রেনের সেনারা। তবে রুশ বাহিনী ধীরে ধীরে ওই এলাকাগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে।
পুতিনের দাবি—কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনীয় সেনাদের ঘিরে ফেলেছে রুশ বাহিনী। তবে এমন কোনো ঘটনার প্রমাণ নেই বলে উল্লেখ করেছেন জেলেনস্কি। তিনি বলেছেন, যুদ্ধবিরতি কতটা জটিল হতে পারে, সে বিষয়ে মিথ্যা বলছেন পুতিন। সত্যিটা হলো, জেদ্দায় আলোচনার পর এরই মধ্যে পুতিন অযাচিতভাবে যুদ্ধটা প্রায় এক সপ্তাহ প্রলম্বিত করেছেন। তিনি এটি আরও টেনে নিয়ে যাবেন।
চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে ইউক্রেনে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ওই প্রস্তাবে সায় দিয়েছে কিয়েভ। তবে এখনো রাশিয়ার পক্ষ থেকে সম্মতি জানানো হয়নি। এ বিষয়ে জেলেনস্কি কিয়েভে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এই দেরি করার পেছনের কারণ হলো ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যেকোনো যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার আগে রাশিয়া সামরিকভাবে নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করতে চায়।
এএফপির খবরে বলা হয়, জেলেনস্কি বলেন, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি না হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যাচ্ছেন পুতিন। এই যুদ্ধ যেন শেষ না হয়, সে উপায় খোঁজার চেষ্টা করছে মস্কো।
আরও পড়ুনইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পুতিনের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে: ট্রাম্প১৮ ঘণ্টা আগে৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করেন জেলেনস্কি। তবে এমন কোনো শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে ইউক্রেনের কোনো অঞ্চল রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হবে না বলে জানান তিনি। জেলেনস্কি আবারও মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমাদের অবস্থানটা হলো কোনোভাবেই ইউক্রেনের দখলকৃত অঞ্চলগুলোকে আমরা রাশিয়া বলে স্বীকৃতি দেব না।’
আরও পড়ুনরাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: কীভাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হতে পারে১৪ মার্চ ২০২৫আরও পড়ুনপুতিন কি ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবেন১৪ মার্চ ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন য দ ধ ইউক র ন র
এছাড়াও পড়ুন:
শুধু পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস নয়, উদ্দেশ্য আরও বেশি কিছু
নব্বয়ের দশক থেকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর কৌশলগত লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। আর তা হলো, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করা। যখন ওয়াশিংটন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে অসলো শান্তিচুক্তি করেছিল, তখনও তিনি লক্ষ্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি।
তিনি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তিচুক্তির সমালোচনা করলেও ধারাবাহিকভাবে ‘ইরানি হুমকি’ তুলে ধরেছিলেন। এমনকি যখন বিষয়টি বিশ্বব্যাপী বা আঞ্চলিক অগ্রাধিকার ছিল না, তখনও নেতানিয়াহু ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে কথা বলতে একাই দাঁড়িয়েছিলেন।
নেতানিয়াহু সর্বদা চেয়েছেন ইহুদি ইতিহাসে তাঁর ছাপ রেখে যেতে। ইরানি পারমাণবিক হুমকি ধ্বংস করা নেতা হিসেবে নিজেকে তিনি স্মরণীয় করতে চেয়েছেন।
পরিকল্পনা ব্যর্থ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা পুনরুজ্জীবিত
২০১০ সালের মধ্যে নেতানিয়াহু এবং তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাক সেনাবাহিনীকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় হামলার প্রস্তুতি নিতে বলেন। পাশাপাশি তারা ইরানি বিজ্ঞানীদের হত্যা করার নির্দেশ দেন। তবে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তারা পিছু হটার কারণে সেই অভিযান স্থগিত হয়ে যায়। তৎকালীন চিফ অব স্টাফ গাবি আশকেনাজি, শিন বেট প্রধান ইউভাল ডিস্কিন ও মোসাদপ্রধান মেইর দাগান সবাই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, মার্কিন সমর্থন ছাড়া ইরানে আঘাত করার সামরিক ক্ষমতা ইসরায়েলের নেই।
এহুদ বারাকের সতর্কবার্তায় মার্কিন প্রশাসন কূটনীতির দিকে ঝুঁকে তেহরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করে। তবে এতে ক্ষুব্ধ হন নেতানিয়াহু। কিন্তু তাঁর ইরানে বোমা হামলার স্বপ্ন কখনও ম্লান হয়নি। তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে নানা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। এমনকি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদকে বোমার একটি কার্টুন দেখিয়ে তিনি সতর্ক করেছিলেন, ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে সীমারেখা অতিক্রম করছে।
সর্বশেষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে নেতানিয়াহু কিছুটা সফলতার দেখা পান। তিনি ট্রাম্পকে পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে যেতে রাজি করাতে সফল হন। রাজনৈতিক ও সামরিক গতি বজায় রাখতে তিনি সামরিক বাহিনীকে বহিরাগত সাহায্য ছাড়াই ইরানের ওপর হামলার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। এই নীতি বাক্যটি তিনি প্রায়ই পুনরাবৃত্তি করেন, ‘বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্রের ভাগ্য অপরিচিতদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যাবে না, এমনকি তারা আমাদের মিত্র হলেও।’
এর পর তেল আবিব গুপ্তহত্যা এবং সাইবার আক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। ২০২০ সালে ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিজাদেহের হত্যাকাণ্ডে একটি বার্তা ছিল, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।
প্রকৃতপক্ষে ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষ কখনও থামেনি। নেতানিয়াহু এই সংঘাতের স্থপতি হিসেবেই রয়েছেন। নাফতালি বেনেট-ইয়ার ল্যাপিড সরকারের অধীনে নেসেটে বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার পরও তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনেট নেতানিয়াহুর অবস্থানকে সমর্থন করে গেছেন। এভাবে নেতানিয়াহু ইসরায়েলের দৈনন্দিন রাজনৈতিক জীবনে ইরানবিষয়ক ফাইলটি গেঁথে দিয়েছেন। কোনো প্রধানমন্ত্রী এটি উপেক্ষা করতে পারবেন না।
গুপ্ত হামলা থেকে প্রকাশ্য যুদ্ধ
হামাসের ইসরায়েলে আক্রমণ তেল আবিবের ভয়কে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। নেতানিয়াহু সরকার একাধিক ফ্রন্টে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। গাজা, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং গোপনে ইরানে হামলা চালায় তারা।
তেল আবিব বিশ্বাস করে, ২০১০ সালে ইরানে আঘাত না করে তারা একটি কৌশলগত ভুল করেছিল। এখন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো আরও বেশি সুরক্ষিত এবং এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী। কিছু ইসরায়েলি বিশ্লেষক যুক্তি দেন, যদি তেহরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তাহলে তারা এবং তার মিত্ররা আরও সাহসী হয়ে উঠবে।
বর্তমান যুদ্ধ নেতানিয়াহুর কয়েক দশক ধরে চলা উন্মাদনার চূড়ান্ত পরিণতি। ইসরায়েলি মিডিয়া এখন স্বীকার করছে, অপারেশন ‘লায়নস কারেজ’ ইরানি বিজ্ঞানী, পারমাণবিক স্থাপনা, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) অবকাঠামো এবং সামরিক বাহিনীকে লক্ষ্যবস্তু করে চলছে। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরও গভীর।
শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের নীলনকশা
ইসরায়েলি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও কৌশলগত পরিকল্পনাকারীদের নথিভুক্ত তথ্য বলছে, ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো ইরানের শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন। দেশটির ইসলামী প্রজাতন্ত্র ভেঙে ফেলা, একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রতিরোধ অক্ষের অস্তিত্ব মুছে ফেলা। এ ছাড়া ইরানের নেতৃত্বের ওপর হামলা এবং জ্বালানি তেল অবকাঠামোর ওপর আক্রমণের মাধ্যমে দেশটির অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা উস্কে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকিগুলো বিশাল, তবে তেল আবিব এটিকে একটি ঐতিহাসিক সূচনা হিসেবে দেখছে।
এটি আর ছায়াযুদ্ধ নয়। প্রথমবারের মতো, ইসরায়েল প্রকাশ্যে ইরানি ভূখণ্ডের গভীরে আক্রমণ করেছে। তেহরানও সরাসরি হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে। পশ্চিমা শক্তিগুলো দেশটিকে রক্ষা করার জন্য ছুটে এসেছে।
ইসরায়েল বাজি ধরছে, তারা ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে ভেঙে ফেলতে পারে এবং আগামী কয়েক দশক ধরে পশ্চিম এশিয়ার শক্তির সমীকরণ নতুন করে লিখতে পারে।
তবে হিসাবটি এত সরল নয়। কারণ, ইরান এখনও বিচ্ছিন্ন নয়। নেতানিয়াহু হয়তো অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভুগছেন। প্রতিরোধ অক্ষ হিজবুল্লাহ থেকে হুতি এবং ইরাকি ছোট ভোট উপদল পর্যন্ত তেহরানের সঙ্গে একত্রিত হয়েছে। এই অঞ্চলটি আরও বিস্তৃত সংঘাতের জন্য প্রস্তুত।
নেতানিয়াহু একটি জানালা দেখতে পাচ্ছেন। তেহরান কেবল একটি নয়, বরং অনেকগুলো সীমারেখা অতিক্রম করতে দেখছে। পশ্চিম এশিয়ার বাকি অংশ এমন একটি যুদ্ধ দেখতে পাচ্ছে, যা মানচিত্রটি নতুন করে আঁকতে পারে।