ছাত্ররাজনীতি কেন বন্ধ করা গেল না
Published: 16th, March 2025 GMT
এ লেখার শুরুটা করতে চাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ফরিদ খানের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে। শেখ হাসিনা সরকারের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে ‘একাই রাস্তায়’ নেমে প্রতিবাদ করা এই অধ্যাপক ১৩ মার্চ তাঁর টাইমলাইনে লিখেছেন, ‘যেখানে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি সীমিত বা নিষিদ্ধ হচ্ছে, সেখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কর্মকাণ্ড যেন দিনে দিনে আরও ব্যাপকতা লাভ করছে। ক্যাম্পাসে, হলে সর্বত্র এর সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়! অথচ এ ক্যাম্পাস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার ছিল, যাদের অন্যতম দাবি ছিল ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা।
আমরা সেই পুরোনো চেহারা দেখতে চাই না। এ ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনগুলোর রক্তক্ষয়ী ও প্রাণঘাতী আন্তসংঘাতের ইতিহাস বড়ই হৃদয়বিদারক এবং কলঙ্কের!
একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমি কিছুটা উদ্বিগ্ন। অন্তত হলে হলে ছাত্রসংগঠনের ব্যানারে কর্মসূচি সে যে নামেই হোক, যে উদ্দেশ্য নিয়েই হোক নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিয়ে ‘লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের’ এমন জোরালো কথা অধ্যাপক ফরিদ খান ব্যতীত অন্য কোনো শিক্ষক এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে বলতে পেরেছেন বলে আমি জানি না।
তবে শুধু এই শিক্ষক নন, ৫ আগস্ট–পরবর্তী ছাত্ররাজনীতির পুরোনো খোলনলচে দেখার পর ‘বিবেকবান’ শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী ও সাধারণ অভিভাবক—সবাই উদ্বিগ্ন, হতাশ। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে যে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, তা আমাদের চব্বিশের অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে না। সংগত কারণে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বভার গ্রহণ করে অধ্যাপক ফরিদরা ‘সেকেলে ছাত্ররাজনীতি’র ভয়ার্ত চেহারা অনুধাবন করতে পেরেছেন বিধায় ‘ছাত্ররাজনীতি’ নিষিদ্ধের পক্ষে মত দিচ্ছেন।
যদিও অধ্যাপক ফরিদ খান তাঁর সেই লেখায় কেবল ছাত্ররাজনীতির কথাই বলেছেন, তবে এই ছাত্ররাজনীতির ওপিঠে থাকা ‘শিক্ষক রাজনীতি’ যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাভাবিক শিক্ষার বিকাশে পাহাড়সম বাধা, তা হয়তো তিনি বলতে পারেননি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই পেশিশক্তির রাজনীতি শেখ হাসিনা সরকারের পতনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল। এ কারণে জুলাই-আগস্ট আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীদের পক্ষে ১৯ জুলাই যে ৯ দফা দাবি নিয়ে পুরো দেশ সরব অবস্থানে গিয়েছিল, তার মধ্যে সাত নম্বর দাবিটি উঠেছিল ‘লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা’। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলগুলোতে দখলবাণিজ্য থেকে শুরু করে নানা অপকর্মে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিষিয়ে তোলা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে হাজার হাজার শিক্ষার্থী একই মোহনায় গিয়ে মিশেছিলেন। সবার দাবি ছিল, শিক্ষাঙ্গন হবে রাজনীতিমুক্ত। শিক্ষাঙ্গনে থাকবে নাকো কোনো অস্ত্রের ঝনঝনানি।
এরই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত বছরের ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ও সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ছাত্রলীগের রাজনীতি বন্ধ করা গেলেও শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা গেল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দফায় দফায় ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বৈঠক ডেকেও লাগাম টানা গেল না লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির।
আমরা বিশ্বাস করি, সরকার অচিরেই সব ক্যাম্পাস থেকে লেজুড়বৃত্তিক দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করবে, পাশাপাশি শিক্ষকদের সব ধরনের রাজনীতি থেকে মুক্ত করবে। তাহলেই আগামীর বাংলাদেশ হবে মানবিক, সুন্দর এবং মেধাবীদের প্রজ্ঞায় পরিচালিত হবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান।ফলে অল্প কিছুদিন সহাবস্থানে থাকার পর শিক্ষাঙ্গনের ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সেই ‘আধিপত্য ও দখলদারি’র পুরোনো চেহারা আমরা দেখতে পাচ্ছি। গুপ্ত-সুপ্ত তর্কে পাল্টাপাল্টি শোডাউন-হাঙ্গামা আমরা দেখলাম খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকটাই ছাত্রলীগ স্টাইলে ছাত্ররাজনীতিতে ফিরছে দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকা সংগঠনগুলো।
প্রশ্ন হলো, কেন লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা গেল না? কেন জুলাইয়ে শপথ নেওয়া ৯ দফার দাবির মধ্যে থাকা এ দাবিকে বাস্তবরূপ দেওয়া গেল না?
এর মূল কারণ হিসেবে ধারণা করছি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের’ জাতীয় রাজনীতিতে রূপান্তরের বিষয়টি। তাঁরা যখন জুলাই-আগস্ট লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিটি তুলেছিল, সম্ভবত সেই সময় তাদের চিন্তা বা কল্পনায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশে মূলধারায় জাতীয় রাজনীতিতে অবস্থানের বিষয়টা ছিল না।
ফলে তরুণদের দ্বারা গঠিত ‘রাজনৈতিক দল’টির অভিপ্রায়ের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হয়তো ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ পিছিয়ে যায়। কারণ, দলটির নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে অধিকাংশই ছাত্র। আর ছাত্রদের দ্বারা গঠিত দলটি পরিচালনা করার জন্য ‘অবশ্যই ছাত্ররাজনীতি’ জিইয়ে রাখা প্রয়োজন ছিল। এ কারণে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানার থেকে সেভাবে ‘লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি’ বন্ধের জোরালো কোনো আওয়াজ আমরা শুনতে পাইনি।
অথচ এই তরুণেরা আগের সরকারের ছাত্রসংগঠন দ্বারা একটি সীমাহীন লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে সময় পার করেছেন। তাঁদের এই পিছিয়ে আসার কারণে আমাদের উচ্চশিক্ষার যে বিকাশের সম্ভাবনার দ্বার রচিত হয়েছিল, সবার মনে যে আশার সঞ্চার ঘটেছিল, সেখানে জল ঢালা হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানে শরিক হওয়া সেসব সাধারণ শিক্ষার্থী, যাঁরা আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি পছন্দ করতেন না, সেই শিক্ষার্থীদের আরেক দফা হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলো বৈকি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার চার দিনের মাথায় গত ১২ আগস্ট আমি প্রথম আলোতে লিখেছিলাম ‘ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি’ কেন বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রাস করছে, তার বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। এ লেখায় সেগুলো পুনরাবৃত্তি করে লেখাটি দীর্ঘায়িত করতে চাই না।
শুধু এটুকু বলতে চাই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি বড় সুযোগ ছিল, আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানো। যুগের পর যুগ চলে আসা শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের মানসপটে বিশ্ববিদ্যালয়কে তার নিজস্ব রূপে ফেরানো। কিন্তু আমরা সম্ভবত সেই পথকে আলিঙ্গন করতে পারলাম না। আমাদের বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস তৈরি করতে পারলাম না।
অথচ সরকার জানে, এই লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র ও শিক্ষকরাজনীতির কারণে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। আমরা বিশ্ব পরিমণ্ডলে মানসম্মত উচ্চশিক্ষালয় গড়তে পারিনি। রাজনৈতিক দলগুলোর ‘দাসত্বের’ কাছে বলি দেওয়া শিক্ষার্থীরা আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সরব হয়ে উঠছেন। সামনের দিনগুলোতে এই মহালয়া আরও প্রকট হবে, প্রাণ যাবে, ক্যাম্পাস বন্ধ থাকবে দিনের পর দিন। শিক্ষক হওয়ার জন্য ধরনা দিতে হবে ছাত্রনেতাদের দরজায়, শিক্ষকনেতাদের বাসায়।
যাঁরা বলেন, দেশের গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি বেঁচে থাকা প্রয়োজন, কর্তৃপক্ষকে সচল রাখতে, দুর্নীতি ঠেকাতে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন; তাঁরা কেউ স্বীকার করেন না, এই দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হওয়া মানে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চর্চা বন্ধ হওয়া নয়। শিক্ষার্থীদের বড় প্ল্যাটফর্ম আছে—‘ছাত্র সংসদ’। সেখানে নেতৃত্ব চর্চার সুযোগ যেমন তৈরি থাকবে, তেমনি পছন্দের নেতাদের বাছাই করার সুযোগও থাকবে।
কিন্তু এসব না করায়, ছাত্র সংসদ উজ্জীবিত না করায় আত্মসিদ্ধির জন্য ‘দলীয় মতাদর্শিক’ রাজনীতির বিস্তার ঘটেই চলছে। অথচ দেখেন, এবারের অভ্যুত্থান কিন্তু কোনো দলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে হয়নি, করেছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যে ছেলে বা মেয়েটি জীবনে একটি স্লোগানও দেননি, তাঁরা রাস্তায় নেমেছিলেন কোটা বাতিলের দাবিতে। শিক্ষার্থীদের উপকার হয় এমন যৌক্তিক দাবিগুলো কখনোই ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে হয় না, বরং সাধারণ শিক্ষার্থীরাই বিভিন্ন সময়ে নিজেদের দাবি আদায় করেছেন।
এরপরও যদি আপনারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ও শিক্ষকরাজনীতি বন্ধ করতে না পারেন, তাহলে দয়া করে তিনটি কাজ করুন। এক.
এই তিনটি বিষয় বাস্তবায়ন করতে পারলে দেখবেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির যে ধারালো বিষাক্ত দাঁত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বসত, তা আপনাআপনি স্তিমিত হয়ে আসবে। ক্যাম্পাসগুলো অশান্ত হওয়ার হাত থেকে রেহাই পাবে।
এটা করতে না পারলে ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা সত্যিই হুমকির মুখে পড়বে। ক্রমেই মেধাশূন্য প্রজন্ম তৈরি হবে। চিন্তাশীলতায় বাগড়া আসবে, দেশের স্বপ্ন ভূলুণ্ঠিত হবে। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার অচিরেই সব ক্যাম্পাস থেকে লেজুড়বৃত্তিক দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করবে, পাশাপাশি শিক্ষকদের সব ধরনের রাজনীতি থেকে মুক্ত করবে। তাহলেই আগামীর বাংলাদেশ হবে মানবিক, সুন্দর এবং মেধাবীদের প্রজ্ঞায় পরিচালিত হবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ষ দ ধ কর স গঠনগ ল র জন ত র র র জন ত সরক র র স গঠন র ত ক দল আম দ র য় র জন র জন য আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
যে পরিকল্পনায় এগোচ্ছে ছাত্রসংগঠনগুলো, প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় যাঁরা
গণ-অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ছয় বছর আগে সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে বেশির ভাগ পদে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) প্যানেল থেকে জয় পেলেও সহসভাপতির (ভিপি) পদে জয়ী হয়েছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নূর।
সেই কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকেই গত বছর বাংলাদেশে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পতন ঘটে আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের শাসনের। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের একটি অংশ এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাঁরা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে আছেন। তাই নতুন এই বাস্তবতায় ডাকসু নির্বাচনে কোন কোন ছাত্রসংগঠনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে এবং কারা সম্ভাব্য প্রার্থী, তা নিয়ে ক্যাম্পাসের রাজনীতিসচেতন শিক্ষার্থীদের কৌতূহল রয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ১৯ আগস্ট পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে। প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে ২৫ আগস্ট। আর ভোট গ্রহণ হবে ৯ সেপ্টেম্বর।
থাকছে না বয়সের বাধা
সর্বশেষ ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালে। ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে প্রার্থীর সর্বোচ্চ বয়স ছিল ৩০ বছর। তবে আসন্ন ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থীর সর্বোচ্চ বয়সসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষার্থী হলেই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তমতে, এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না সান্ধ্যকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীরা। ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোটার ও প্রার্থী হতে হলে শিক্ষার্থীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষার্থী হতে হবে, যিনি ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা এমফিলে অধ্যয়নরত এবং কোনো আবাসিক হলে অবস্থানরত বা সংযুক্ত।
এ ছাড়া সান্ধ্যকালীন কোর্সের পাশাপাশি পেশাদার বা এক্সিকিউটিভ মাস্টার্স, ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট ও ভাষা কোর্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাও ভোটার বা প্রার্থী হওয়ার যোগ্য হবেন না। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ও সংযুক্ত কলেজ বা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
তা ছাড়া ছাত্রত্ব না থাকলে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা। আইনি জটিলতা এড়াতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডাকসু নির্বাচন আয়োজনে গঠিত নির্বাচন কমিশন।
এবারের ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে ছাত্রসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি দাবি ছিল হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র করা। সেই দাবি মেনে ডাকসু নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কেন্দ্রগুলো হলো: এক. কার্জন হল কেন্দ্র (পরীক্ষার হল); ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল, অমর একুশে হল ও ফজলুল হক হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। দুই. শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র; জগন্নাথ হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। তিন. ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি); রোকেয়া হল, শামসুন নাহার হল ও কবি সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। চার. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব কেন্দ্র; বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল ও শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। পাঁচ. সিনেট ভবন কেন্দ্র (অ্যালামনাই ফ্লোর, সেমিনার কক্ষ, ডাইনিংরুম); স্যার এ এফ রহমান হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ও বিজয় একাত্তর হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। ছয়. উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র; সূর্যসেন হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, শেখ মুজিবুর রহমান হল ও কবি জসীমউদ্দীন হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন।
যে পরিকল্পনায় এগোচ্ছে ছাত্রসংগঠনগুলো
তফসিল ঘোষণার পর ছাত্রসংগঠনগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রার্থী নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। কাকে কোন পদে প্রার্থী করলে জয় ছিনিয়ে আনা যাবে, চলছে সেসব বিশ্লেষণ। তবে অধিকাংশ ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার দলীয় প্যানেলের চেয়ে সম্মিলিত সাধারণ শিক্ষার্থী প্যানেলের কথা ভাবছে সংগঠনগুলো। নিজ সংগঠনের বাইরে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অনেক প্রার্থীকে তাঁরা নিজেদের প্যানেলে রাখতে চাচ্ছেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর হওয়া ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা অভ্যুত্থানে অবদান রাখা প্রার্থীদের কিছুটা এগিয়ে রাখবেন—এমনটা মনে করছে কিছু সংগঠন। এ ছাড়া নারী শিক্ষার্থী, বিজ্ঞান অনুষদগুলোর শিক্ষার্থী, আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট প্রার্থীদের জিতে আসার জন্য বড় ভূমিকা রাখবে বলেও মনে করা হচ্ছে।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেল কেমন হবে, তা দলীয় সিদ্ধান্তের আলোকেই ঠিক করা হবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ সম্মিলিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্যানেল করবে, এমন আলোচনা চলছে। বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর পাশাপাশি ইসলামী ছাত্রশিবিরও পৃথকভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে প্যানেল দিতে পারে এমন আলোচনা হচ্ছে।
প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় যাঁরা
ডাকসু নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস), সহসাধারণ সম্পাদকসহ (এজিএস) এবার মোট ২৮টি পদের বিপরীতে লড়বেন প্রার্থীরা। ছাত্রসংগঠনগুলোর দাবির মুখে এবার গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক; ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক; স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক এবং মানবাধিকার ও আইনবিষয়ক সম্পাদক নামে চারটি নতুন পদ তৈরি করা হয়েছে।
ছাত্রসংগঠনগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরিচিত কিছু মুখ সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত হওয়া সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার, সদস্যসচিব জাহিদ আহসান ও মুখ্য সংগঠক তাহমিদ আল মুদ্দাসির চৌধুরী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আবদুল কাদের প্রার্থী হতে পারেন। আলোচনায় রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন মুজাহিদও।
ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান ও বি এম কাওসার, কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক তানভীর বারী হামিম প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন।
বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু ও বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর জাবির আহমেদের নাম আলোচনায় রয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম ও বর্তমান সভাপতি এস এম ফরহাদ প্রার্থী হতে পারেন। এ ছাড়া ছাত্র অধিকার পরিষদের বিন ইয়ামিন মোল্লার নামও আলোচনায় রয়েছে।
কে কী বলছেন
নির্বাচন আয়োজনে কালক্ষেপণের অভিযোগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এরপরও তফসিল ঘোষণায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছুটা তড়িঘড়ি করেছে বলে মনে করছেন ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন।
নাহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছিল নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হলে এবং শিক্ষার্থী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত চিহ্নিত ছাত্রলীগ কর্মী ও ফ্যাসিবাদের দোসর শিক্ষকদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার পর তফসিল ঘোষণা করা হবে। কিন্তু আমরা সেগুলোর কিছুই দেখিনি। ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কারের বিষয়েও কোনো প্রকার অগ্রগতি দেখিনি।’
শিক্ষার্থীদের সংস্কার প্রস্তাবের বেশির ভাগই উপেক্ষা করে আগের কাঠামোর মধ্যেই ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের। সংগঠনটির একাংশের সাধারণ সম্পাদক শিমুল কুম্ভকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিদায়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিলোপের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ডাকসু সংস্কারের প্রস্তাব দেয়। অপরাপর সংগঠনগুলোও সংস্কারের দাবি জানায়। কিন্তু আমরা দেখি, শিক্ষার্থীদের সংস্কার প্রস্তাবের বেশির ভাগই উপেক্ষা করে আগের কাঠামোর মধ্যেই ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করা হলো।’
এরপরও ডাকসু নির্বাচনকে সাধুবাদ জানিয়ে শিমুল বলেন, প্রতিবছর নিয়মতান্ত্রিকভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রত্যাশা করেন তাঁরা। ছাত্র ইউনিয়ন চায়, ডাকসু নির্বাচনে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং চব্বিশের জুলাইয়ে যাঁরা গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত, সেসব সংগঠন এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচনকে বিতর্কিত না করুক।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে বলে মনে করছেন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ‘এই উচ্ছ্বাস যেন আশাহত অবস্থায় রূপ না নেয়, সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সচেষ্ট থাকতে হবে। কুচক্রী মহলের ডাকসু বানচালের পাঁয়তারায় প্রশাসনের মধ্যে যেন জুজুর ভয় সঞ্চারিত না হয়, সেটাই আমাদের আহ্বান থাকবে।’
ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব নির্বাচন করা জুলাইয়ের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা। আমাদের দাবি থাকবে, অনতিবিলম্বে প্রতিটি ক্যাম্পাসেই যেন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়।’
নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের (সবার জন্য সমান সুযোগ) ওপর প্রশাসনের জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিপুল অর্থ এবং পেশিশক্তির ব্যবহার করে যাতে কোনো গোষ্ঠী এই নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সে ব্যাপারে তাদের ভূমিকা রাখতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, একটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরেপক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁদের যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচিত করবেন।’
আরও পড়ুনডাকসু নির্বাচন ৯ সেপ্টেম্বর১৭ ঘণ্টা আগে