বিভিন্নভাবে সংস্কারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ। তিনি বলেছেন, সংস্কারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা বাইরে থেকে হচ্ছে, ভেতর থেকেও হচ্ছে।

‘রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে আলী রীয়াজ এ কথা বলেন। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আজ বৃহস্পতিবার এই বৈঠকের আয়োজন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।

এই গোলটেবিল আলোচনায় বক্তাদের কথায় উঠে আসে, দেশের শাসনব্যবস্থার বিদ্যমান কাঠামো স্বৈরাচার তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক, কাঠামোগত সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে সংস্কারের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো বিরোধ নেই। এটা একসঙ্গেই চলতে পারে। কিছু জরুরি সংস্কার করে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনতার এত বছরে প্রয়োজনীয় সংস্কার করেনি। তাই সংস্কার না করে কোনোভাবেই নির্বাচন দেওয়া যাবে না।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, বিভিন্নভাবে সংস্কারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। বাইরে থেকে হচ্ছে, ভেতর থেকেও হচ্ছে। যারা মনে করে, বর্তমান কাঠামো অব্যাহত রাখা দরকার। বিশেষ করে যারা পরাজিত শক্তি, তারা এটা মনে করে। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

আলী রীয়াজ আরও বলেন, নাগরিকদের অংশগ্রহণ, চাপ ও অন্তর্ভুক্তি ছাড়া কোনোভাবেই সংস্কারপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর পর নাগরিকদেরও মতামত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘যে অভাবনীয় রক্তপাতের মধ্য দিয়ে এ জায়গায় এসেছি, সেখান থেকে খালি হাতে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

আলী রীয়াজ বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই দুর্বল ও ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানগুলোকে গত ১৬ বছরের ব‍্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন ধ্বংস করে দিয়েছে। সংস্কারের প্রশ্ন উঠেছে সে কারণেই। বিচার বিভাগ কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার। জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করা না গেলে নির্বাচন হলেও আগের পরিস্থিতি হবে। তাই কাঠামোগত সংস্কারের আর কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান কাঠামোগত ব্যবস্থায় স্বৈরতন্ত্রের মোকাবিলা করা যাবে না।

সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবিত সুপারিশে ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দিয়ে বহুত্ববাদ ও রাষ্ট্রধর্ম রাখার মধ্যে স্ববিরোধিতা আছে, বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশে মতপার্থক্য আছে; এ নিয়ে এক বক্তার প্রশ্নের উত্তরে আলী রীয়াজ বলেন, সব কমিশন স্বাধীন সুপারিশ করেছে। রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে এটি চূড়ান্ত হবে। আর বিদ্যমান সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেও বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে। বহুত্ববাদ সবার প্রতিনিধিত্ব করবে। বিভিন্ন সময় প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলেও রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করেনি। এর একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা আছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্যরা সব বিষয়ে ঐকমত্য হলেও রাষ্ট্রধর্ম রাখার বিষয়ে সবাই একমত হননি।

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মূলত তিনটি দায়িত্ব। স্বৈরাচার যাতে আর ফিরতে না পারে, তাই গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার করা। যারা অন্যায় করেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের বিচার করা। আর নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এ তিনটা একটা আরেকটার প্রতিবন্ধকতা নয়, একসঙ্গে সমান্তরালে চলতে পারে। নির্বাচনের জন্য কিছু সংস্কার এখনই করতে হবে। কিছু নির্বাচনের পরে করলেও হবে। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও দায়বদ্ধ করতে হবে। নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকার দরকার।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ সংস্কার চায়। রাজনৈতিক দলগুলোও চায়। তারা প্রস্তাব দিচ্ছে। এটা জাতীয় দাবি। স্বৈরাচার জন্ম নেয় ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। প্রতিষ্ঠান ছাড়া গণতন্ত্র হবে না। এগুলো ঠিক করতে হবে। না হলে সংকটে থাকা রাষ্ট্র আরও গভীর সংকটে পড়বে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের অনেক দোষ আছে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ছাড়া দেশ চালানো যাবে না। দলে সংস্কার করতে হবে। তবে নির্বাচনের দিকে না গিয়ে সংস্কারের দিকে গেলে, তা হবে বিরাজনীতিকরণ। যৌক্তিক কিছু সংস্কার করে নির্বাচনের দিকে যেতে হবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক বলেন, বিচার বিভাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলো সংস্কারে কমিশনের সুপারিশে এসেছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। নাগরিকদের মতামত পেলে এটি আরও সমৃদ্ধ হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, ২০০৭-০৮ সালের পর সংস্কার শব্দটা গালিতে পরিণত হয়েছিল, এখন আর সেটা মনে করা হচ্ছে না। অনেক কমিশন করা হয়েছে, সহস্র সুপারিশ এসেছে। তবে সাংবিধানিক সংস্কারটাই আসলে মূল সংস্কার। পাকিস্তান সরকারের সময়কার নির্বাচনে বিজয়ী সদস‍্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন করে ১৯৭২ সালে সংবিধান করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের উপযোগী হয়নি। এরপর সংবিধান সংশোধন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বার্থে হয়েছে।

সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধান নিয়ে ওই সময় কোনো বিতর্ক হয়নি, শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এম এন লারমা। সংবিধানে সব জাতিগোষ্ঠীকে রাখা দরকার। সংবিধানে পরে কালাকানুন ঢুকে গেছে, এটার সংশোধন দরকার, পুনর্লিখন নয়। তিনি বলেন, লাখো শহীদের বিনিময়ে পাওয়া সংবিধান কলমের খোঁচায় কেউ বদলে দিতে পারে না। সংস্কার প্রস্তাবে ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম রেখে দেওয়া যৌক্তিক হয়নি। ধর্মনিরপেক্ষতা আওয়ামী লীগের বিষয় নয়। এটা সবার আন্দোলন ছিল। প্রজাতন্ত্রের জায়গায় নাগরিকতন্ত্র নিয়ে আসাটাও অযৌক্তিক।

রাজনৈতিক দলকে সংস্কারে বাধ্য করতে হবে

গোলটেবিলে অংশ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিক প্রতিনিধিরা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো অতীতে সংস্কার করেনি। এ কারণেই আন্দোলন হয়েছে। ঐকমত্য কমিশন রদ করে গণভোটের ব্যবস্থা করা হোক, জনগণ সিদ্ধান্ত দেবে। রাজনৈতিক দল কখনো ঐকমত্যে আসবে না, তবু সংস্কার করতে হবে। নির্বাচন হলে একদল গেছে আরেক দল আসবে, কোনো কিছু বদলাবে না। তাই দলগুলোকে বাধ্য করতে হবে সংস্কার মানতে।

২০২৩ সালে এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান বলেন, সংস্কার করেই এ সরকার গদি ছাড়ার কথা বলুক। জীবনের বিনিময়ে এ সরকার এসেছে। তবে একটি সুপারিশের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ২১ বছরে একজনের লেখাপড়া শেষ হয় না, তিনি কীভাবে সংসদ সদস্য হয়ে দেশ চালাবেন!

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত ‘রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা। সিরডাপ মিলনায়তন, ঢাকা, ২০ মার্চ.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ষ ট রধর ম স স ক র কর ব যবস থ র মন র ন র জন দরক র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ঐকমত্য কমিশনে যারা আছেন, তারা নিজেদের কাজে ফিরে যান: খসরু

ঐকমত্য কমিশনে যারা আছেন, তারা আগে যে কাজ করতেন, তাদেরকে সে কাজে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। 

শনিবার (১ নভেম্বর) দুপুরে রাজশাহী বিভাগের ব্যবসায়ীদের এক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ অনুরোধ জানান।

ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ তুলে আমীর খসরু বলেন, “জোর করে আরেকটি দলের অথবা দুটি দলের বা তিনটি দলের মতামত বাকি দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আমরা একটা রাজনৈতিক দল, তারাও একটি রাজনৈতিক দল। এখানে ঐকমত্যের বাইরে গিয়ে তাদের দাবি আমাদের ওপর চাপাতে চাচ্ছে, জনগণের ওপর চাপাতে চাচ্ছে। অথচ, ঐকমত্য কমিশন করার উদ্দেশ্য ছিল, ঐকমত্য যতটুকু হবে, সেটা নিয়ে আমরা জনগণের কাছে যাব।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, “ঐকমত্য হয়েছে, সই হয়েছে, তার বাইরে গিয়ে এখন নতুন নতুন দাবি নিয়ে আসছে। তাদের দাবি মানতে হবে, না মানলে এটা হবে, সেটা হবে...। আবার তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে ঐকমত্যের কিছু লোকজন। তাদেরও আবার মতামত আছে। রাজনীতিবিদদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে তারা তাদেরটা চাপাতে চাচ্ছে। আবার ঐকমত্য কমিশনেরও একটা নিজস্ব মতামত আছে। ঐকমত্য কমিশনের মতামতের জন্য তো তাদেরকে সেখানে রাখা হয়নি। এখন তাদেরও মতামত আছে এবং ওটা আমাদেরকে মানতে হবে।”

দেশের মানুষকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, “ঐকমত্য কমিশনে যারা আছেন, যাদের দাবি রাজনীতিবিদদের ওপর চাপাতে চান, জনগণের ওপর চাপাতে চান; তাদের প্রতি আমার অনুরোধ- আপনারা যে যেই কাজ করতেন আগে, ওই জায়গায় ফিরে যান। বাংলাদেশের মানুষকে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে দেন। আমি অনুরোধ করছি, আপনারা স্ব স্ব কাজে ফিরে যান। বাংলাদেশের মানুষকে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দয়া করে তাদের ওপরেই ছেড়ে দেন। আপনাদেরকে এই দায়িত্ব কেউ দেয় নাই।”

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ আগামী নির্বাচনে তাদের সিদ্ধান্ত দেবে। যেসব দল তাদের দাবি-দাওয়া চায়, তাদেরকে জনগণের কাছে যেতে হবে তো। জনগণের মতামত নিতে হবে তো। জনগণের ম্যান্ডেট নিতে হবে তো। মতামত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া চলবে না।”

নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা চলছে, অভিযোগ করে আমীর খসরু বলেন, “ব্যবসায়ীরা আমাকে প্রতিনিয়ত বলছেন, ফেব্রুয়ারি নয়; পারলে এখনই নির্বাচন করে আমাদেরকে একটু মুক্ত করেন। আমাদের ব্যবসা ধ্বংস হওয়ার উপক্রম। আমরা কোনো বিনিয়োগ করতে পারছি না। বিদেশিরা কোনো বিনিয়োগ করছে না। সুতরাং, এই নির্বাচনকে যারা বিলম্বিত করতে চায় তাদের স্বার্থের জন্য, এখানে ব্যবসায়ীদেরকে সোচ্চার হতে হবে। দ্রুতই নির্বাচনের দিকে যেতে হবে।”

রাজশাহী জেলা পরিষদ মিলনায়তনে এই বিভাগীয় ব্যবসায়ী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। রাজশাহী বিভাগীয় ব্যবসায়ী ফোরাম এর আয়োজন করে। এতে বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম উপদেষ্টা ও সাবেক সিটি মেয়র মিজানুর রহমান মিনুসহ রাজশাহী বিভাগের আট জেলার ব্যবসায়ীরা অংশ নেন। সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি লুৎফর রহমান।

ঢাকা/কেয়া/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলো কেন
  • সনদ বাস্তবায়নে দ্রুত সিদ্ধান্ত, আরপিওতে পরিবর্তন আসছে
  • ঐকমত্য কমিশনের কাজ সফলভাবে শেষ হওয়ায় প্রধান উপদেষ্টার অভিনন্দন
  • তড়িঘড়ি না করে সংবিধান সংস্কারে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান
  • কিছু রাজনৈতিক দল ঐকমত্য কমিশনে গিয়ে ফাঁদে পড়েছে: জাপা মহাসচিব
  • ঐকমত্য কমিশন হাজির করেছে অনৈক্যের দলিল: বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন
  • ঐকমত্য কমিশনে যারা আছেন, তারা নিজেদের কাজে ফিরে যান: খসরু
  • জুলাই সনদ নিয়ে জট খুলুন, সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে
  • সমস্যা সমাধান করে নির্বাচনের পথে এগোন: অন্তর্বর্তী সরকারকে মির্জা ফখরুল
  • অধ্যাপক আলী রীয়াজের নতুন বই প্রকাশিত