কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহের ঈদুল ফিতরের জামাতের বিশালত্ব যেন সকলেরই চিরচেনা। এবারের ঈদ জামাত যেন অতীতের সকল রেকর্ড ছাপিয়ে এক বিশাল জনসমুদ্রের রূপ নিয়েছে। এ বছর প্রায় ৬ লাখ মুসল্লি ঈদুল ফিতরে নামাজ আদায় করেন, যা গত বছরের চেয়ে প্রায় লক্ষাধিক বেশি।

ঈদের আগের দিন থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলার বহু মুসল্লি শোলাকিয়ার জামাতে নামাজ আদায়ের আকর্ষণে চলে আসতে শুরু করেন। আর আজ ঈদের দিন ভোর বেলা থেকে যেন জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ আশপাশের অন্যান্য জেলা থেকে জনস্রোত বইতে থাকে ঈদগাহ অভিমুখে। বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মুসল্লিদের ব্যাগ ও দেহ তল্লাশি করেছেন। পথে পথে অনেকেই ১০-২০ টাকা করে পলিথিনের জায়নামাজ বিক্রি করেছেন। জামাত শুরু হয় সকাল ১০টায়। এর অনেক আগেই ঈদগাহ মুসল্লিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। জামাতে ইমামতি করেন শহরের বড় বাজার জামে মসজিদের খতিব বিশিষ্ট মুফতি আবুল খায়ের মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ।

এই ঈদগাহের সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্য অনুসারে তিন দফা গুলি ফুটিয়ে শুরু হয় জামাত। জামাত শুরুর ১৫ মিনিটি আগে তিনটি, ১০ মিনিট আগে দুটি এবং ৫ মিনিট আগে একটি শর্টগানের গুলি ফুটিয়ে জামাত শুরুর সংকেত দেওয়া হয়। প্রথম গুলিটি ছোঁড়েন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী। গুলি ছুঁড়ে জামাতের সংকেত দেওয়ার এই ঐহিত্য বিশ্বের বুকে একমাত্র শোলাকিয়া ঈদগাহের বলে মনে করা হয়। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শহরকে বেশ কিছু তোরণ ও উৎসব পতাকা দিয়ে সজ্জিত করা হয়।

এবারের ১৯৮ তম জামাতে মুসল্লিদের যে বিপুল পরিমাণ ঢল নেমেছিল, তাতে মূল মাঠের আশপাশের রাস্তা, পার্শ্ববর্তী নরসুন্দা নদীর বিশাল সেতু, আশপাশের বাসাবাড়ির আঙিনা, পতিত জমিতেও মুসল্লিরা কাতার বেঁধে নামাজ আদায় করেছেন। ঈদগাহের পাশেই পর্দাঘেরা একটি জায়গায় মহিলাদের জন্যও পৃথক জামাতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।

২০১৬ সালে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর থেকেই নেওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রায় ১১শ’ পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি সেনা সদস্য, ৫ প্লাটুন বিজিবি, র‌্যাব ও আনসার-ভিডিপির সদস্যরা নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন।

পুরো এলাকা পর্যবেক্ষণের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল ৬৪টি সিসি ক্যামেরা। ছিল বেশ কয়েকটি ক্যামেরাবাহী ড্রোন। মাঠে ছিল পুলিশ ও র‌্যাবের ৬টি ওয়াচ টাওয়ার। গড়ে তোলা হয়েছিল আর্চওয়েসহ চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে মুসল্লিদের তল্লাশি করে মাঠে ঢুকতে দেওয়া হয়। মাঠের পাশেই মোতায়েন ছিল ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট ও মেডিক্যাল ক্যাম্প। পর্যাপ্ত সুপেয় পানি এবং ওজুর সুব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। দূরের মুসল্লিদের আসার জন্য সকাল পৌনে ৬টায় ময়মনসিংহ থেকে এবং সকাল ৬টায় ভৈরব থেকে দু’টি ঈদ স্পেশাল ট্রেন কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। নামাজ শেষে দু’টি ট্রেন আবার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।

জামাত শুরুর আগে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী ও ঈদগাহ কমিটির পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মিজাবে রতমত সমবেত মুসল্লিদের স্বাগত ও শুভেচ্ছা জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।

জামাত শেষে মোনাজাতে ইমাম আবুল খায়ের মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন। বাংলাদেশের উত্তরোত্তর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় যেসব ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, তাদের শহীদি মৃত্যু কবুল করার জন্যও সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করেন।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ ল ক য ঈদগ হ র ম হ ম মদ ঈদগ হ র ব যবস থ র জন য হয় ছ ল সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

বেপরোয়া বখাটে ও অসহায় বাবা

গতকাল ছিল বাবা দিবস। নিউজ ফিড থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায় কেবলই বাবাকে নিয়ে আবেগ জড়ানো কথামালা। মায়ের পরে বাবাই একমাত্র শব্দ, যার প্রতি মানুষের আজন্ম দুর্বলতা কিংবা দায়বদ্ধতা! বলা যায়, গর্বের সঙ্গেই আমরা বাবাকে লালন করি হৃদয়ের একান্ত গহিনে। আমাদের মনে সেই এইটুকুন বয়সে স্বপ্নের বীজ বপন করে দেন বাবা। যে বীজ চারাগাছ হয়ে আকাশমুখী হতে থাকে। আমরাও বাবার দেখানো স্বপ্ন ধরতে শুঁয়াপোকা থেকে প্রতিনিয়ত বর্ণিল প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হই! তবে কতটা রূপান্তর ঘটে আমাদের, সে হিসেব মেলাতে যান না বাবা। তারা কেবল জানেন নিজের সর্বস্ব সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য বিলিয়ে দিতে। 

এমনটাই চোখে পড়েছে রোববার সমকালে প্রকাশিত খবরে। বাবা দিবসেই প্রকাশিত খবরে আমরা দেখেছি, বগুড়ায় অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়েকে বিয়ের হাত থেকে বাঁচাতে প্রতিবাদ করেছেন বাবা। এই প্রতিবাদই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে রিকশাচালক বাবা শাকিল হোসেনের। মেয়েকে বিয়ে না দেওয়ায় বাবাকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। শনিবার বিকেলে বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী এলাকায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। শাকিলের বোন রেশমি আক্তার আশা বলেন, ‘আমার ভাতিজি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। জিতু কিছুদিন পরপর তাকে বিয়ে করতে চায় এবং উত্ত্যক্ত করে। আমার ভাই ১৪ বছরের মেয়েকে বিয়ে দিতে নারাজ। এ নিয়ে আমার ভাই ও জিতুর মধ্যে কয়েক দিন আগে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। ক্ষুব্ধ হয়ে জিতু ও তার লোকজন শনিবার বিকেলে ভাইকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। আমরা এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’ 
এমন ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের পরও ভুক্তভোগী মামলা করতে ভয় পাচ্ছিলেন। এক দিন পর নিহত রিকশাচালক শাকিল হোসেনের স্ত্রী মালেকা বেগম বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় মামলা করেন। মামলায় জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিতু ইসলামকে প্রধান করে ১৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। আরও ৮-১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। পরে পুলিশ জিতু ইসলাম, তার দুই সহযোগী শফিকুল হাসান ও মতিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে। এ ঘটনায় পুলিশ ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে– এ কথা বলতেই হবে। যদিও মামলা করার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তার পরও পুলিশের আন্তরিকতা উল্লেখযোগ্য। মামলার পর পুলিশ তৎপর হয়ে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। 

অবাক করার বিষয়, এ ঘটনার প্রায় দুই মাস আগে, গত ১৮ এপ্রিল রাজশাহী মহানগরীর তালাইমারী শহীদ মিনার এলাকায় মেয়েকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় বাবা আকরাম আলীকে মাথা থেঁতলে হত্যা করা হয়েছিল। সে হত্যার ঘটনায়ও মূল আসামি নান্টুসহ দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছিল র‍্যাব-৫। তার কিছুদিন আগে, ১১ মার্চ ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ায় এসএসসি পরীক্ষার্থীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় বাবা ও চাচাকে বেধড়ক পিটিয়ে জখম করার ঘটনা ঘটেছে। 

আমরা বেপরোয়া ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠছি দিন দিন– এ ঘটনাগুলো তারই প্রমাণ। একসময় বখাটেরা ভয়ে থাকত। ভয়ভীতি দেখিয়েই ক্ষান্ত হতো। তার পর মারধর; এখন পথের বাধা সরিয়ে দিতে অভিভাবকের প্রাণ নিয়েই তারা রণে ভঙ্গ দিচ্ছে! 
এসব ঘটনা কল্পনাকেও যেন হার মানায়। এমন সামাজিক অপরাধ এবং বেপরোয়া মনোভাব কোনোক্রমে বাড়তে দেওয়া যায় না। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা যতই ক্ষমতাবান হোক; সবাইকে ধরে আইনের আওতায় আনা জরুরি। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এমন অঘটন ঠেকানো কঠিন হবে। দিন দিন তা মহামারি আকার ধারণ করার আশঙ্কাও রয়েছে!

আশিক মুস্তাফা: শিশুসাহিত্যিক ও জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, সমকাল
muashique@gmail.com  

সম্পর্কিত নিবন্ধ