ভালোবাসাই ধরে রেখেছে বিষ্ণুরামের পুতুল নাচ
Published: 5th, April 2025 GMT
সেই কিশোর বেলার কথা। হাত আর আঙুলের কারুকার্যে এমন মন জয়– না দেখলে আফসোসই রয়ে যেত! তখন সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। পাশের পাড়ায় পুতুল নাচ দেখার আয়োজন হয়েছে। দারুণ কৌতূহল! দেখতে যাই। শো শেষ। কিন্তু মন তো মানে না। আরও দেখতে চায়! সে আয়োজনে যে কতবার দেখেছি! আজও সেই পুতুলের অভিনয়, ডায়ালগ, গানের অংশ, বেশ মনে পড়ে। সত্যি লোকসংস্কৃতির এক আনন্দদায়ক অংশ পুতুল নাচ। ছোটদের সঙ্গে বড়রাও দেখলে তো কম মজা পায় না!
পুতুল নাচকে জীবন চলার সঙ্গী করে চলেছেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের রামজীবন ইউনিয়নের খুঙুয়া গ্রামের বিষ্ণুরাম দাস। পূর্বজদের মাছধরা পেশা ছেড়ে বাবা বানুরামের হাত ধরে এই কলা শিখেছেন বিষ্ণুরাম। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেলেও ভালোবেসে ফেলেছেন বলে ছাড়তে পারছেন না পুতুল নাচানো। তাঁর খোঁজ পেয়ে দেখতে গেলে হাসিমুখে বলতে থাকেন কথাগুলো। বিষ্ণুরাম বলেন, ‘বাবা ভারতীয় এক দলের পুতুল নাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে শিখতে যান তাদের সঙ্গে। শিখে এসে ১৯৮৫ সালে কাজ শুরু করেন কুড়িগ্রামের মনিকা পুতুল নাচের দলে। এরপর পাশের গ্রামের আফসার উদ্দিনের নেতৃত্বে নাসিমা পুতুল নাচ নামে দল গড়েন। সেটি ১৯৯৭-৯৮ সালের কথা। এ দল কত কত জায়গায় যে শো দেখিয়েছে তার শেষ নেই।’
বাবার কাছ থেকে বিষ্ণুরাম এ কলা শিখে শো করা শুরু করেন। বলেন, ‘এখনও বিভিন্ন জায়গায় শো চালাই। মানুষ দেখে, আনন্দ পায়। তবে ছোটরা মজা পায় খুব। এই তো কিছুদিন আগে নাটোরে বকুলপুরের স্বাধীনতা পালাটি করে আসি। গাইবান্ধা শিল্পকলা একাডেমিতেও মাঝেমধ্যে শো দেখাতে ডাক পড়ে। তবে জীবনযাপনের চাহিদা যেভাবে বাড়তিছে তাতে এই কামাইয়ে কী হয়! কেননা, সব সময় তো শো চলে না।’ পাশে বসা সহযোগী তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘এমন মজি গেইছে যে, ছাড়বারও পায় না, জেবন চলাও দায়!’ বিষ্ণুরাম বলেন, ‘এটা নিয়েই থাকতে হয়। এটা এক সাধনা! নতুন পালা তৈরি, ফির দলে কেউ মারা গেলে কিংবা অন্য কাজে বা কোথাও চলে গেলে সেই প্লেয়ার তৈরি করতে সময় কী কম লাগে! গড়ি তুলতে খাটনিও লাগে তো। যেমন আগে ভোকাল অধীর দা, অনিল কাকা মারা গেলে নয়া করি বানা লাগছে।’
এক দলে কতজন লাগে; জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘পুতুল নাচানো ছাড়াও ভোকাল, বাদ্য বাজনাদার, জোগালিসহ কমপক্ষে আট-নয়জন মানুষ লাগে একটা দলে।’ ভাই কৃষ্ণরামকে দেখিয়ে বলেন, ‘এনার ছেলে আমার ছেলেকে তৈরি করছি। তবে এ শুধু ভালোবাসার টানে। এখন নেতৃত্বে আছে মতিন সর্দার। গলা দেন জাকির সর্দার। সব মিলে আট-নয়জনের একটি টিম।’ পুতুল নাচানো দেখাতে বললে, বিষ্ণুরাম দাস কোনো রকমে গড়ানো টিনের ঘরের বারান্দার বাক্সে তাংড়ানো পুতুল বের করে কালো পর্দা টাঙিয়ে হাত আর আঙুলের কারসাজি দেখালেন পুতুলকে নাচিয়ে নাচিয়ে। তবে ভোকাল না থাকায় গান-কথা শোনা হলো না। শো কখন কখন হয় জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, ‘দুর্গাপূজায় হয়, রাসে হয়, আর শীতকালে টুকটাক হয়। তবে আগের মতো ডাক আইসে না। যদি স্কুল-কলেজে দেখানোর আয়োজন হতো, তবে খারাপ হতো না কিন্তু! কেননা, এর মাধ্যমে শিক্ষামূলক, সমাজ সচেতনতামূলক, বিভিন্ন বিষয় প্রচার করা যেত। আনন্দও পেত সবাই। আর আমাদেরও শো চলত, এই শিল্পটাও বাঁচিয়ে রাখা যেত!’ বিষ্ণুরাম জানান, এই গাইবান্ধায় শুধু আমাদের দলই আছে। এখনও এটা ধরি আছি, সংসার যেমন চলে চলুক, যতদিন পারি চালামো। কেননা, মানুষ তো দেখালে দেখে, আনন্দও পায়।’ এ যেন এক মায়ার টান!
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও
রংপুরের গংগাচড়ায় ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ঘিরে সহিংসতার শিকার হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। তবে ঘটনার তিন দিন পরেও এলাকায় ফেরেনি অনেক পরিবার। আতঙ্কে এখনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে।
গত ২৭ জুলাই রাতে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার আগে এলাকায় মাইকিং করে লোকজন জড়ো করা হয়।
পুলিশ, প্রশাসন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, যারা হামলা করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন ‘বহিরাগত’। পাশের নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা থেকে লোকজন এসে হামলা চালিয়ে চলে যায়। হামলার সময় ২২টি ঘরবাড়ি তছনছ ও লুটপাট করা হয়।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প বসানো হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে পুলিশ টহল। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঢেউটিন, কাঠ, চাল-ডাল ও শুকনো খাবার বিতরণ করেছে এবং ঘরবাড়ি মেরামতের কাজও শুরু হয়েছে। তবু আতঙ্কিত পরিবারগুলো।
ক্ষতিগ্রস্তদের একজন অশ্বিনী চন্দ্র মোহান্ত বলেন, “সেদিনের ঘটনা ছিল এক ভয়াবহ। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্ম অবমাননাকারী কিশোরকে থানা হেফাজতে দিয়েছি। কিন্তু তারপরও ঘরবাড়ি রক্ষা হয়নি। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি এবং কিছু মুরুব্বি আমাদেরকে অভয় দিয়েছিলেন, কিন্তু রক্ষা হয়নি।”
তিনি আরো বলেন, “আমরা নিজেরাই অভিযুক্ত কিশোরকে থানায় সোপর্দ করেছি। তারপরও মিছিল নিয়ে এসে দুই দফায় আমাদের ২০ থেকে ২৫টি ঘরবাড়ি তছনছ করে দিয়ে লুটপাট করেছে তারা। এদের মধ্যে অধিকাংশ লোকেই অপরিচিত।”
আরেক ভুক্তভোগী দেবেন্দ্র চন্দ্র বর্মন জানান, “প্রথমে অল্পসংখ্যক কম বয়সী কিছু ছেলে আসে। পরে হাজারো লোকজন এসে আমাদের বাড়িঘরে তাণ্ডব চালায়। অনেকেই এখনো আত্মীয়দের বাড়িতে। আমরা চরম আতঙ্কে আছি।”
রবীন্দ্র চন্দ্রের স্ত্রী রুহিলা রানী বলেন, “ছোট ছেলেটা যদি ভুল করে থাকে, আমরা তাকে থানায় দিয়েছি। কিন্তু তারপরও এমন ধ্বংসযজ্ঞ কেন? আমাদের গরু, সোনা-টাকা সব লুটে নিয়েছে। শুধু চাল-ডাল আর টিনে কি জীবন চলে?”
গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রংপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ও সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকুসহ একটি প্রতিনিধি দল। তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করেন এবং পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
গংগাচড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আল এমরান বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে কিশোরটিকে গ্রেপ্তার করে থানায় আনা হয় এবং পরে আদালতের মাধ্যমে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তারপরও পুলিশ প্রশাসন সর্বাত্মক নিরাপত্তায় নিয়োজিত।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহামুদ হাসান মৃধা বলেন, “অপরাধীদের ধরতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হচ্ছে সহায়তা। পুলিশ ও সেনাবাহিনী পুরো এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে।”
উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্যমতে, হামলায় ১৫টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাতে ২২টি পরিবার বসবাস করতেন। ঘর মেরামতের পর কিছু পরিবার ফিরলেও অভিযুক্ত কিশোর ও তার চাচার পরিবারের কেউ এখনো ফিরে আসেনি।
ঢাকা/আমিরুল/ইভা