বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে শেয়ার কারসাজিতে আবারো নাম জড়ালো সাবেক সংসদ সদস্য ও বিশ্বসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবসায়িক পার্টনার ও শেয়ার ব্যবসায়ী আবুল খায়ের হিরুর সঙ্গে কারসাজিতে জড়িয়েছেন। এবার বিমা খাতে তালিকাভুক্ত ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার কারসাজিতে সাকিবের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। এ অনৈতিক কাজে সাকিবকে সহযোগিতার পাশাপাশি নেতৃত্ব দেন সমবায় অধিদপ্তরে উপ-নিবন্ধক আবুল খায়ের হিরু।

শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় সাকিব, হিরু ও তার পরিবারের সদস্য, তাদের প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক পার্টনার রয়েছেন এমন ৮ ব্যক্তি এবং ৪ প্রতিষ্ঠানকে মোট ২ কোটি ২১ লাখ টাকা জরিমানা করেছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আল-আমিন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, সোনালী পেপার বোর্ড মিলস লিমিটেড ও এনআরবিসি ব্যাংক পিএলসিকে সতর্ক করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

২০২৩ সালের ১৬ জুলাই থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কারসাজি করে ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়। শেয়ার কারসাজিতে সাকিব-হিরুরা বিভিন্ন নামে একাধিক বিও হিসাব খুলে কোম্পানির শেয়ার সিরিজ ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়িয়ে মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে বিএসইসির তদন্তে উঠে এসেছে।

পুঁজিবাজারে কয়েক বছর ধরে গুঞ্জন ছিল—ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজি চলছে। অবশেষে তদন্ত সাপেক্ষে কোম্পানিটির শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায়ে এনেছে বিএসইসি।

বিগত সরকারের আমলে আইন লঙ্ঘন করা শেয়ার কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন পুনর্গঠিত বিএসইসি যেকোনো ধরনের কারসাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজি করে আইন লঙ্ঘনের দায়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ১৭(ই)(২), সেকশন ১৭(ই)(৩), সেকশন ১৭(ই)(৫) এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শেয়ার অর্জন, অধিগ্রহণ ও কর্তৃত্ব গ্রহণ) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ৪(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার লেনদেনে কারসাজির মাধ্যমে সিকিউরিটিজ আইন ভঙ্গ করায় ইশাল কমিউনিকেশন লিমিটেডকে ৮৫ লাখ টাকা, কনিকা আফরোজকে ৪৯ লাখ টাকা, মোনার্ক এক্সপ্রেসকে ২২ লাখ টাকা, মো.

আবুল খায়ের হিরুকে ৩৭ লাখ টাকা, মোনার্ক মার্টকে ১৫ লাখ টাকা, কাজী সাদিয়া হাসানকে ১৩ লাখ টাকা, সাকিব আল হাসানকে ৩ লাখ টাকা, আবুল কালাম মাতব্বরকে ৩ লাখ টাকা, লাভা ইলেকট্রোডস ইন্ডাস্ট্রিজকে ৩ লাখ টাকা, হুমায়ন কবিরকে ৩ লাখ টাকা, মো. জাহেদ কামালকে ২ লাখ টাকা, মো. আশফাকুজ্জামানকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সে হিসেবে ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির দায়ে মোট ২ কোটি ২১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

শেয়ার কারসাজিতে জড়িতদের পরিচিতি

ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজি করে সাকিব আল হাসান, আবুল খায়ের হিরু ও তার পরিবারের সদস্য এবং সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এ কাজের মূল হোতা ছিলেন আবুল খায়ের হিরু। কারসাজিতে সহযোগী হিসেবে ছিলেন হিরুর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, বাবা আবুল কালাম মাতবর, বোন কনিকা আফরোজ, ব্যবসায়িক পার্টনার সাকিব আল হাসান, মো. জাহেদ কামাল, হুমায়ন কবির এবং হিরু-সাকিবের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মোনার্ক এক্সপ্রেস, মোনার্ক মার্ট, ইশাল কমিউনিকেশন ও লাভা ইলেকট্রোডস ইন্ডাস্ট্রিজ। এর আগে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কারসাজি করার দায়ে এদের সবাইকে বড় অঙ্কের জরিমানা করে বিএসইসি।

সর্বশেষ, সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলসের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করার অভিযোগে সাকিব, হিরু ও তার পরিবারের সদস্য, সাকিব-হিরুর প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক পার্টনার রয়েছে এমন ১০ ব্যক্তি এবং ৪ প্রতিষ্ঠানকে মোট ৩১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে সাকিব আল হাসানকে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

তার আগে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার লেনদেনে কারসাজির অভিযোগে সাকিব আল হাসানসহ ৪ ব্যক্তি এবং ৩ প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে সাকিবকে জরিমানা করা হয়েছে ৫০ লাখ টাকা।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে বিএসইসির শুভেচ্ছা দূত হিসেবে যুক্ত করেন তৎকালীন সংস্থাটির চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন। ২০২০ সালেও অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন পুনর্গঠিত বিএসইসি শুভেচ্ছা দূত হিসেবে সাকিবকে বহাল রাখে। এ সময়ে পুঁজিবাজারে আলোচিত বিনিয়োগকারী হিসেবে সাকিবের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তবে, গত বছর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত বিএসইসি গত ২৮ আগস্ট শুভেচ্ছা দূতের পদ থেকে সাকিবকে বাদ দেয়। পুঁজিবাজারের আলোচিত কারসাজিকারী আবুল খায়ের হিরুর সঙ্গে একত্রে বড় বিনিয়োগ করেন সাকিব। অভিযোগ আছে, গত চার-পাঁচ বছরে পুঁজিবাজারে যেসব শেয়ার নিয়ে আবুল খায়ের হিরু সবচেয়ে বেশি কারসাজির ঘটনা ঘটিয়েছেন, এসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ ছিল সাকিবেরও।

বিএসইসির তদন্ত কার্যক্রম

সমবায় অধিদপ্তরে উপ-নিবন্ধক ও শেয়ার ব্যবসায়ী আবুল খায়ের হিরু ও তার পরিবারের সদস্য, তাদের প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়িক পার্টনার সাকিবসহ অন্যরা যোগসাজস করে ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার লেনদেন করেন। কারসাজিকারীরা ২০২৩ সালের ১৬ জুলাই থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটি শেয়ার কারসাজি করে দাম বাড়ায়। এ সময়ের মধ্যে কোম্পানির শেয়ারের দাম ৪০.৯১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৭.৬৪ টাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। আলোচ্য সময়ে কোম্পানির শেয়ারের দাম ৩৬.৭৩ টাকা বা ৮৯.৭৮ শতাংশ বাড়ে যায়।

কারসাজির পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসির সিদ্ধান্ত

অভিযুক্তদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব থেকে ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের বিপুল সংখ্যক শেয়ার লেনদেন করা হয়। এ কর্মকাণ্ডের মাধ্যেমে তারা একটি কৃত্রিম বাজার সৃষ্টি ও পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ক্রয়ের জন্য প্রভাবিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন। এর ফলে শেয়ার মূল্য অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সিকিউরিটিজ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। শেয়ার কারসাজিতে জড়িতদের বক্তব্য এবং তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, উপস্থাপিত অভিযোগগুলো সঠিক ও ইচ্ছাকৃত এবং তাদের কর্মকাণ্ডের ফলে পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যা পুঁজিবাজার উন্নয়নের পরিপন্থী। এক্ষেত্রে অভিযুক্তদের ব্যাখ্যা কমিশনের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়নি।

অভিযুক্তদের কর্মকাণ্ড সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ১৭(ই)(৫),  সেকশন ১৭(ই)(৩) এবং সেকশন ১৭(ই)(২) লঙ্ঘন করেছে, যা সিকিউরিটিজ আইনের পরিপন্থী। সেহেতু, অভিযুক্তরা উপর্যুক্ত কর্মকাণ্ড সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ২২ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ফলে, কমিশনের বিবেচনায় সিকিউরিটিজ আইন ও বিধি-বিধান পরিপালনে ব্যর্থতার জন্য পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা এবং জনস্বার্থে আলোচ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানা করা হলো।

ঢাকা/রফিক

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ক র স ট ল ইন স য র ন স র শ য ও ত র পর ব র র সদস য ব যবস য় ক প র টন র স ক ব আল হ স ন শ য় র ক রস জ ত র শ য় র ক রস জ র ক রস জ র ব এসইস র র ল নদ ন র ব যবস র পর প স ক বক তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

নারী স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে সময় বাড়াল বিএসইসি

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিটি কোম্পানিতে এক-পঞ্চমাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে একজন নারী স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে সময় বেধে দিয়েছিল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে অনেক কোম্পানি ব্যর্থ হওয়ায় এবং ওইসব কোম্পানির আবেদনের আলোকে সময়সীমা বাড়িয়েছে বিএসইসি।

মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করা হয়েছে বলে বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের ২৯ এপ্রিল প্রকাশিত গেজেটে এক বছর সময় দিয়ে গত ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিটি তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে কমপক্ষে এক জন করে নারী স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের জন্য সময়সীমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনেক কোম্পানি এ শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ওইসব কোম্পানি থেকে সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে। যার আলোকে নারী স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিএসইসির কমিশনার হিসেবে সাইফুদ্দিনের যোগদান
  • নেগেটিভ ইক্যুইটি বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা জমা দেওয়ার সময় বাড়াল বিএসইসি
  • নারী স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে সময় বাড়াল বিএসইসি
  • সালমান, শিবলী ও সায়ান পুঁজিবাজারে ‘আজীবন অবাঞ্ছিত’
  • সালমানকে ১০০ কোটি, সায়ানকে ৫০ কোটি টাকা জরিমানা
  • বিএসইসির নতুন কমিশনার সাইফুদ্দিন
  • পুঁজিবাজারে বড়-মাঝারি বিনিয়োগকারী বেড়েছে : বিএসইসি
  • ‘পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তিতে কাজ করছি’