আজ ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। ১৯৫০ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি পালিত হয়। ১৯৪৮ সালের এই দিনে জেনেভায় প্রথম বিশ্ব স্বাস্থ্যসভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংস্থাটি যাত্রা শুরু করে। ওই সভাতেই প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত আসে।

এবারের স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান হচ্ছে, ‘মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা করে সুস্বাস্থ্যের সূচনা ও আশায় ভরপুর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করি’। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে স্বাস্থ্য বিষয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বড় বাধা হচ্ছে মাতৃমৃত্যুর উচ্চহার। এর পরপরই আরেকটি বড় বাধা হচ্ছে নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর উচ্চহার। মাতৃমৃত্যু, নবজাতকের মৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হচ্ছে প্রতিরোধযোগ্য স্বাস্থ্য সমস্যা। সরকারকে এ জনস্বাস্থ্য সমস্যাকে অগ্রাধিকার দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে।

কাজটি বেশ জটিল। সম্প্রতি প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক অনুমান হচ্ছে, সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ নারী গর্ভধারণ বা সন্তান প্রসবজনিত জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেন, ২০ লাখের বেশি নবজাতক শিশু জন্মের এক মাসের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করে এবং আরও ২০ লাখ শিশু মায়ের গর্ভেই মারা যায়। মোটাদাগে বলা যায়, প্রতি ৭ সেকেন্ডে একটি প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু ঘটে এ পৃথিবীতে।

বর্তমান প্রবণতা দেখে বলা যায়, প্রতি পাঁচটি দেশের মধ্যে চারটি (বাংলাদেশসহ) এ বিষয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অসফল। একইভাবে প্রতি তিনটি দেশের মধ্যে একটি দেশ শিশুমৃত্যু কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অসফল। বাংলাদেশ আরেকটু চেষ্টা করলে সফল হতে পারবে।

মা ও শিশুর মৃত্যু কমাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় কী বলা আছে? বিশ্বের প্রতিটি দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যুর হার ৭০–এর নিচে নামিয়ে আনবে। নবজাতক শিশুর (জন্ম থেকে ২৭ দিন পর্যন্ত) মৃত্যু প্রতি ১০০০ জীবিত জন্মে ১২–তে নামিয়ে আনা এবং ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুহার প্রতি ১০০০ জীবিত জন্মে ২৫–এ নামিয়ে আনা। 

একটি বলিষ্ঠ রাজনৈতিক অঙ্গীকার, বৈষম্য বিলোপের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও তা বাস্তবায়নে অব্যাহত দৃঢ়তা মা ও শিশুর প্রতিরোধযোগ্য অকালমৃত্যুকে থামাতে পারেবাংলাদেশের কী অবস্থা 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত সর্বসাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২০২৩ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল প্রতি ১ লাখ জীবিত জন্মে ১১৫ জন। ২০০০ সালের তুলনায় মাতৃমৃত্যুর হার ২০২৩ সালে ৭৯ শতাংশ কমেছে।

বিশ্বজুড়ে মাতৃস্বাস্থ্যের অবনতি ও মৃত্যুর সবচেয়ে বড় সরাসরি কারণ হচ্ছে রক্তপাত। অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে গর্ভধারণজনিত উচ্চ রক্তচাপ, সংক্রমণ, অনিরাপদ গর্ভপাতের জটিলতা প্রভৃতি। ধাত্রীস্বাস্থ্যবিষয়ক পরোক্ষ কারণগুলো বিশ্বব্যাপী মাতৃমৃত্যুর দ্বিতীয় বড় কারণ। পরোক্ষ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অসংক্রামক রোগ, যেমন আগে থেকে উচ্চ রক্তচাপে ভোগা, ডায়াবেটিস, অন্যান্য স্ত্রীরোগের সংক্রমণ, পরজীবী সংক্রমণ প্রভৃতি। তৃতীয় বড় কারণ হচ্ছে গর্ভধারণজনিত উচ্চ রক্তচাপ, যে রোগের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে অনেক মা ভুগে থাকেন। অন্যান্য অসংক্রামক রোগের মধ্যে রয়েছে অ্যাজমা, হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যা, মৃগীরোগ, হিমোগ্লোবিনের অস্বাভাবিকতা, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা প্রভৃতি।

শিশুমৃত্যুর বৈজ্ঞানিক অনুমানের জন্য গঠিত জাতিসংঘ আন্তসংস্থা পরিচালিত এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর মাতৃগর্ভে ৬৩ হাজার শিশু মৃত্যুবরণ করে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুবরণ করে এক লাখের বেশি। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বয়স ২৮ দিনের কম। এ পরিসংখ্যান দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। যদি আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হয়, তবে প্রতিবছর অন্তত ২৮ হাজার নবজাতকের মৃত্যু ঠেকাতে হবে। নবজাতকের এ মৃত্যু যেসব প্রতিরোধযোগ্য কারণে ঘটে, তার মধ্যে রয়েছে সময়ের আগেই জন্ম নেওয়া, বাচ্চা জন্মের সময় জটিলতা এবং সেপসিস ও নিউমোনিয়ার মতো সংক্রমণ। এটা মানুষের বেঁচে থাকার ও বেড়ে ওঠার মৌলিক চাহিদাকে লঙ্ঘন করে। যদি আমরা স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বিশেষ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করি, নিরাপদ সন্তান প্রসবের জন্য প্রশিক্ষিত ধাত্রী ও অন্যান্য স্বাস্থ্য পেশাজীবীর সংখ্যা আরও বাড়াই, তাহলে পরিস্থিতির অবশ্যই উন্নতি হবে। 

এগুলো এমন সব রোগ ও স্বাস্থ্য সমস্যা, যার প্রতিটির চিকিৎসা ও প্রতিবিধান রয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো অগোছালো স্বাস্থ্যব্যবস্থার দেশে মা ও শিশুরা এ চিকিৎসার আওতার বাইরে থেকে যায়। নানা আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণে এগুলোর ব্যবস্থা দেশে থাকলেও এক বিরাটসংখ্যক মানুষ এর নাগাল পাচ্ছে না। স্বাস্থ্যের সামাজিক নির্ধারকগুলো এর জন্য দায়ী। 

শিক্ষার সুযোগের অভাব, শ্রেণি–জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গবৈষম্য, ক্ষতিকর ও বৈষম্যপূর্ণ সামাজিক রীতি-অভ্যাস-আচরণ, যেগুলো নারীদের বঞ্চিত করে, এ ধরনের কারণগুলো উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী ও শিশুকে চিকিৎসা নিতে বাধা দেয়। একটি বলিষ্ঠ রাজনৈতিক অঙ্গীকার, বৈষম্য বিলোপের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও তা বাস্তবায়নে অব্যাহত দৃঢ়তা মা ও শিশুর প্রতিরোধযোগ্য অকালমৃত্যুকে থামাতে পারে।

মুশতাক হোসেন বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য সমিতির নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ব স থ য সমস য জ ব ত জন ম র জন ত ক ব যবস থ স ক রমণ ক রণগ ল

এছাড়াও পড়ুন:

ইসরায়েলে ইরানের নতুন হামলায় নিহত বেড়ে ৫, আহত ২৯

ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলে অন্তত চার জায়গায় হামলা চালিয়েছে ইরান। এ হামলায় তিনজন নিহত হয় বলে জানায় জেরুজালেম পোস্ট। বিবিসি আরও দুইজন নিহতের খবর দেয়। এরপর আরেকজনের ফলে নতুন হামলায় ইসরায়েলে নিহত বেড়ে পাঁচজনে পৌঁছাল।

আজ সোমবার আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের অ্যাম্বুলেন্স ও ব্লাড ব্যাংক সংস্থাগুলো বলছে, এসব হামলায় ২৯ জন আহত হয়েছেন।

বিবিসির খবরে বলা হয়, ইসরায়েলের জাতীয় জরুরি পরিষেবার প্রধান ম্যাগেন ডেভিড অ্যাডম জানান, মধ্য ইসরায়েলজুড়ে ইরানের হামলায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুইজন নারী, একজন পুরুষ। 

এর আগে সিএনএন ইসরায়েলের ১৫ জন নিহত হওয়ার খবর দেয়। ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম কানের খবর বলছে, ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলে হামলায় একজন গুরুতর আহত হয়েছেন। এছাড়াও বন্দরনগরী হাইফায় অন্তত দুইজন আহত হয়েছেন। এছাড়াও সেখান আরও তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন।

এর আগে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছিল, ইরান থেকে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হয়েছে। একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করেছে ইসরায়েল। বর্তমানে হামলা প্রতিহত করার কাজ চলছে বলে জানিয়েছে আইডিএফ।

আজ সিএনএনের এক খবরে বলা হয়েছে, তেল আবিব ও জেরুজালেমসহ ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে জরুরি সতর্ক সংকেত (সাইরেন) বাজতে শুরু করেছে। আইডিএফ সতর্ক করে বলেছে, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি অভেদ্য নয়।

সিএনএনের একজন প্রযোজক জেরুজালেমে সাইরেন এবং একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। তার তোলা ভিডিওতে আকাশে বহু ক্ষেপণাস্ত্র ছুটে যেতে দেখা গেছে।

ইসরায়েলের জরুরি পরিষেবা সংস্থা ম্যাগেন ডেভিড আদোম জানিয়েছে, তাদের দলগুলো আক্রান্ত এলাকার দিকে রওনা দিয়েছে।

সারা দেশের নাগরিকদের আশ্রয়কেন্দ্রে ঢুকতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকার আহ্বান জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক্সে দেওয়া এক পোস্টে বলেছে, বর্তমানে বিমানবাহিনী হামলা প্রতিহত করার পাশাপাশি পাল্টা হামলা চালানোর কাজ করছে।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট নিউজ জানিয়েছে, মধ্য ইসরায়েলের পেতাহ টিকভা শহরের একটি ভবনে একটি ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হেনেছে। হামলার ফলে ওই স্থানে আগুন ধরে যায়। তবে এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

এদিকে মধ্য ইরানে একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির সেনাবাহিনী এ তথ্য জানিয়েছে। আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর দাবি, বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়েছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েলি বিমানবাহিনী সফলভাবে মধ্য ইরানে অবস্থিত একাধিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। আমাদের গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এসব স্থাপনা থেকে ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হচ্ছিল।’

তবে ইসরায়েলের এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান এখনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।

এদিকে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় রোববার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২২৪ জনে পৌঁছেছে।

বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক। হামলায় ১ হাজার ২৭০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।

এপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ১৩ জুন ইরানে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ওই হামলায় ইরানের নাতাঞ্জ ও ইসফাহান অঞ্চলের পারমাণবিক স্থাপনা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। ইরানে বর্তমানে মসজিদ ও মেট্রো স্টেশনগুলোকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের তিন শিশুসহ অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন। রোববার ইসরায়েল সরকারের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন।

ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ বলেছে, এছাড়া ইরানের হামলায় কমপক্ষে ৩৮৫ জন আহত হয়েছেন, যার মধ্যে সাত জনের অবস্থা গুরুতর।

এদিকে ইসরায়েলি পুলিশের বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, তেল আবিবের দক্ষিণে অবস্থিত বাত ইয়াম শহরে ৬ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। এছাড়া সাতজন এখনও নিখোঁজ। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন জরুরি সেবাদানকারীরা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ