বিশ্ব অর্থনীতিতে বয়ে যাচ্ছে ‘শুল্কঝড়’। বিশ্ব বাণিজ্যে চলছে উত্তেজনার ঘূর্ণি। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চমাত্রার শুল্ক আরোপে তৈরি হয়েছে এ পরিস্থিতি। যদিও চীন ছাড়া বাকি দেশগুলোর জন্য বাড়তি এ শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘রিসিপ্রোকাল’ বা ‘পাল্টা’ শুল্ক নিয়ে এখনও তোলপাড় চলছে বিশ্বজুড়ে।
এর আগেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের একতরফা শুল্ক আরোপের ঘটনায় তৈরি হয় ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ পরিস্থিতি। আরও বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রচলিত রীতিনীতি বা নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে শুল্ক বাড়ানোসহ নানা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। গত এক দশক ধরে প্রায়ই এমনটা দেখা গেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) যেন হয়ে গেছে এক ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’। মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য আলোচনা ও দরকষাকষির পর সিদ্ধান্ত হয়। সেই অনুসারে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন হয়। শেষ পর্যন্ত মানে না অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো। এ অবস্থায় ‘নড়বড়ে’ এই ডব্লিউটিওর ভবিষ্যৎ আসলে কোন পথে, সেটা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
ডব্লিউটিও প্রতিষ্ঠার ইতিহাস : বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৪৪ সালে। তখন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বিশ্বের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করার লক্ষ্যে ব্রেটন উডস চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তিতে তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়। সেগুলো হচ্ছে– আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যাংক তথা বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা। ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও শুল্কবিষয়ক সম্মেলনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা গঠন করার প্রস্তাব অনুমোদন হয়। তবে অস্থায়ীভাবে চুক্তিরূপে আবির্ভাব ঘটে ‘জেনারেল এগ্রিম্যান্ট অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেড’ বা গ্যাটের। গ্যাটের অধীনে চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোর পারস্পরিক বাণিজ্য সম্পর্কিত বিষয়ে মোট আটটি পর্বে আলোচনা হয়। সর্বশেষ আলোচনা হয় উরুগুয়েতে। এতে শতাধিক দেশ অংশ নেয়। মূল আলোচনার বিষয় ছিল শুল্ক ও অশুল্ক বাধা কমানো। সাত বছর ধরে চলা উরুগুয়ে রাউন্ডের আলোচনা শেষে ১৯৯৪ সালে সদস্য দেশগুলো স্বাক্ষর করে মারাকেশ চুক্তি। মূলত গ্যাট ১৯৯৪ একটি পূর্ণাঙ্গ ও ব্যাপকভিত্তিক বাণিজ্য চুক্তির পথ প্রশস্ত করে, যা থেকে হয় ১৯৯৫ সালে ডব্লিউটিও নামে পরিপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার উৎপত্তি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কার্যপ্রণালি মূলত ‘রুলস বেইজড’ বা নীতিভিত্তিক। সদস্য দেশগুলোর আলোচনার ভিত্তিতে সম্মত চুক্তিই মূলত ডব্লিউটিও নীতিমালা। এ সংস্থার উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হচ্ছে বাণিজ্য চুক্তির ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য আলোচনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি, বাণিজ্য সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তি, কারিগরি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বজায় রাখা ইত্যাদি।
সাম্প্রতিক বাস্তবতা : ডব্লিউটিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি ন্যায্য ও নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্যে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ অনেক দেশ নিজেদের স্বার্থে একতরফা শুল্ক আরোপ করছে, যা ডব্লিউটিও নীতিমালার পরিপন্থি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল সব সদস্য দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক বিরোধ মীমাংসা, শুল্ক ও অন্যান্য বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা কমিয়ে একটি উন্মুক্ত ও ন্যায্য বাজার নিশ্চিত করা। বিগত এক দশকে এ সংস্থার ‘ডিসপিউট সেটেলমেন্ট বডি’ কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ডব্লিউটিওর নিষ্ক্রিয়তা ও সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে অনেক দেশ আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির দিকে ঝুঁকছে। বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে ডব্লিউটিও যেন একটি ‘কাগুজে বাঘ’ হয়ে পড়েছে। দিন দিন কার্যকারিতা হারাচ্ছে সংস্থাটির। বিশ্বব্যাংক ও ওইসিডির এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, বহুপক্ষীয় বাণিজ্য কাঠামো অকার্যকর হয়ে পড়লে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি প্রতিবছর ১ থেকে ১ দশমিক ৫ শতাংশ কমে যেতে পারে।
ভবিষ্যৎ কোন পথে : বিশেষজ্ঞদের মতে, ডব্লিউটিও যদি দ্রুত তার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার না আনে, তবে এটি ধীরে ধীরে প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। এর পরিবর্তে শক্তিধর দেশগুলোর শাসনাধীন একটি ‘পাওয়ার বেইজড ট্রেড অর্ডার’ গড়ে উঠবে, যেখানে দুর্বল দেশগুলো বাণিজ্যিকভাবে আরও পেছনে পড়বে। অন্যদিকে কেউ কেউ বলছেন, বৈশ্বিক সংকট যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তা বা অতিমারি ইত্যাদি মোকাবিলায় সমন্বিত বাণিজ্য কাঠামোর প্রয়োজন হবে, যা আবার ডব্লিউটিওর মতো একটি নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা সামনে আনবে।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড.
তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় ডব্লিউটিওর উচিত নিজেদের অবস্থানটি জানান দেওয়া। জোরালোভাবে বলা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিষয়টি ঠিকভাবে চলছে না। বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বিশ্ব বাণিজ্য, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু শক্তভাবে তারা তা বলতে পারছে না। বাণিজ্য উন্নয়ন, বিরোধ নিষ্পত্তি, বাণিজ্য ব্যবধান কমানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে ডব্লিউটিওর ভূমিকা যেন ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশ ডব্লিউটিওর কারণে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে। তাদের সবার এখন উচিত জোরালোভাবে এ বিষয়ে কথা বলা।
ডব্লিউটিওর মতো বৈশ্বিক সংস্থাগুলো দুর্বল হওয়ার পেছনে বড় কারণ মূল বা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর ভূমিকা। তারা ঠিকভাবে সবকিছু পরিপালন করছে না। এতে বৈশ্বিক বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় অন্য দেশগুলো সবাই মিলে বলতে হবে ডব্লিউটিওর কার্যকারিতা দরকার। তারা এক হয়ে কাজ করলে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে সংকট দেখা দিয়েছে, সেখান থেকে হয়তো নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর বা নতুনভাবে সাজানোর একটা সুযোগ তৈরি হবে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলায় চট্টগ্রামে প্রথম অভিযোগপত্র দাখিল
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে চট্টগ্রাম মহানগরীর চান্দগাঁওয়ে শহিদুল ইসলাম শহিদকে হত্যার মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ। এ মামলায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ ২৩১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চান্দগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুরুল হক গত বুধবার (৩০ জুলাই) আদালতের প্রসিকিউশন শাখায় অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন।
শনিবার (২ আগস্ট) চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব আহমেদ অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার তথ্য সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন।
আরো পড়ুন:
সিলেটে স্কুলছাত্র সুমেল হত্যা: ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৭ জনের যাবজ্জীবন
চবি ছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
পুলিশ জানিয়েছে, গত বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলার সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা কোনো মামলায় চট্টগ্রামে প্রথম অভিযোগপত্র দাখিল করা হলো।
২০২৪ সালের ৩ আগস্ট সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাটে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় একাধিক পিস্তল, শটগানসহ ভারী অস্ত্র দিয়ে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা।
এর আগে নিউ মার্কেট মোড়ে সমাবেশ করে ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে ষোলশহর মেয়র গলিতে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বাসভবনে হামলা চালায়। এর পর বহদ্দারহাট মোড়-সংলগ্ন সাবেক সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসভবনে হামলা হয়। ওই সময় গুলিবিদ্ধ হন অটোরিকশাচালক শহিদ। তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শহিদের ভাই শফিকুল ইসলাম চান্দগাঁও থানায় মামলা করেন।
আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি আইনের ৩০২ ধারায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য অপর আসামিরা হলেন— চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীন, সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, এম এ লতিফ, আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দীন নদভী, মহিউদ্দিন বাচ্চু, আবদুচ ছালাম, দিদারুল আলম দিদার, এস এম আল মামুন ও নোমান আল মাহমুদ, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, চসিকের সাবেক কাউন্সিলর এসরারুল হক, নুর মোস্তফা টিনু, সলিমুল্লাহ বাচ্চু, জিয়াউল হক সুমন ও নুরুল আজিম রনিসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
আগামী ২৫ আগস্ট বাদীর উপস্থিতিতে অভিযোগপত্রের ওপর শুনানি হবে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। অভিযোগপত্রে ১২৮ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৮ জন সাধারণ মানুষ, ৯৯ জন পুলিশ ও ১ জন চিকিৎসক।
ঢাকা/রেজাউল/রফিক