প্রতিবেশীর অধিকার ইমানের মানদণ্ড
Published: 14th, April 2025 GMT
ইসলাম প্রত্যেক মানুষকে তার প্রতিবেশীর উপকার করা এবং তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছে। এ-ক্ষেত্রে ইসলামের পরিভাষা হলো ‘ইহসান’। ইহসান একটি ব্যাপকার্থক শব্দ, যা বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিককে শামিল করে।
প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার জন্য রাসুল (সা.) পরস্পরকে উপহার প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রত্যেকেই তার প্রতিবেশীকে উপহার দেওয়ার চেষ্টা করবে, চাই সামান্য খাবার হোক। এখানে কম-বেশি কোনো বিচার্য বিষয় নয়। বরং এতটুকু ভাববিনিময় করা, যার মাধ্যমে আন্তরিকতা প্রকাশ পায়।
আবু যর (রা.
উপহার আদান-প্রদানের বিষয়টি তিনি শুধু পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং নারীদেরও আদেশ করেছেন। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) নারীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘মুসলিম নারীগণ, তোমাদের কোনো প্রতিবেশী যেন অপর প্রতিবেশীর উপহারকে তুচ্ছ মনে না করে, যদিও তা বকরীর ক্ষুর হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৫৬৬)
আরও পড়ুনজান্নাতে আল্লাহর প্রতিবেশী হতে চেয়েছেন যে নারী১৯ জানুয়ারি ২০২৫আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত, একবার তার জন্য একটি বকরি জবাই করা হলো। তিনি তার খাদেমকে বললেন, আমাদের ইহুদি প্রতিবেশীর জন্য এর কিছু হাদিয়া পাঠিয়েছ? আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, জিবরাঈল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীর সম্পর্কে আমাকে এত বেশি বলতে থেকেছেন যে আমার ধারণা হলো, প্রতিবেশীকে হয়তো ওয়ারিশ বানিয়ে দেওয়া হবে। (আল-আদাবুল মুফরাদ, ইমাম বুখারি, হাদিস: ১০৫)
যদি কোনো ব্যক্তি অধিক প্রতিবেশীকে উপহার দিতে সক্ষম না হয়, তাহলে অন্তত তার দরজার সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীকে দেবে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি বললাম, আল্লাহর রাসুল, আমার তো দুজন প্রতিবেশী। দুজনের কাকে উপহার দেব?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘যে দরজার দিক থেকে তোমার বেশি কাছের।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,২৫৯)
ইবনে জুবায়ের (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘সেই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে পেট ভরে খায়, আর তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ, ইমাম বুখারি, হাদিস: ১১২)
আরও পড়ুনদুঃস্থ-অভাবীদের অভাব মোচনে দান-সদকা নিয়ে এগিয়ে আসা একটি গুণ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘আমাদের ওপর এমন একটি সময় অতিবাহিত হয়েছে, যখন অর্থকড়িকে কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিত না। আর এখন অর্থ আমাদের অনেকের কাছে তার মুসলিম ভাইয়ের চেয়েও বেশি প্রিয় হয়ে গেছে। আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কেয়ামতের দিন অনেক প্রতিবেশী তার কাছের প্রতিবেশী সম্পর্কে বলবে, হে আমার প্রতিপালক, আমার সামনে সে আমার জন্য দরজা বন্ধ করে রেখেছে। তার উপকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ, ইমাম বুখারি, হাদিস: ১১১)
এখানে উপকার থেকে বঞ্চিত করার অর্থ হলো, প্রয়োজনের মুহূর্তে প্রতিবেশীকে ধার চাইলে তাকে নিত্য ব্যবহার্য বস্তু না দেওয়া। কোরআনে এ-ধরনের কাজের নিন্দা করা হয়েছে। (সুরা মাঊন)
আরও পড়ুনঅনাথ ও দরিদ্রের প্রতি কোমলতা ১৮ জানুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিদিন কেন মৃত্যুকে স্মরণ করতে হবে
মৃত্যু জীবনের একটি অবশ্যম্ভাবী সত্য, যা প্রত্যেকটি মানুষের জন্য নির্ধারিত। ইসলামে মৃত্যুকে ভয়ের বিষয় হিসেবে নয়; বরং আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার একটি স্বাভাবিক ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫)
মৃত্যুর স্মরণ মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক অনুশীলন, যা জীবনের উদ্দেশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আমাদের পার্থিব লোভ-লালসা থেকে দূরে রাখে।
মৃত্যু: মুমিনের জন্য স্বস্তিপৃথিবী একটি পরীক্ষার ক্ষেত্র, যেখানে মানুষ নানা দুঃখ-কষ্ট, অভাব, প্রিয়জনের মৃত্যু, দারিদ্র্য ও অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। মুসলিমদের জন্য এ পরীক্ষা হলো আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার মাধ্যমে জীবন যাপন করা।
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘(আল্লাহ) যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করেন, তোমাদের মধ্যে কে উত্তম কাজ করে।’ (সুরা মুলক, আয়াত: ২)
আনন্দের ধ্বংসকারীকে (মৃত্যুকে) বেশি বেশি স্মরণ করো। তিরমিজি, হাদিস: ২৩০৭মৃত্যু মুমিনের জন্য একটি স্বস্তি। এটি পার্থিব পরীক্ষা ও কষ্ট থেকে মুক্তি দেয় এবং আল্লাহর রহমতের আলিঙ্গনে নিয়ে যায়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন মৃত্যুর মাধ্যমে স্বস্তি পায়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৫০৭)।
এমনকি নবীজি (সা.)-এর জীবনেও এ সত্য প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর সময় মৃত্যুর ফেরেশতা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে মৃত্যু বিলম্বিত করার সুযোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার পথ বেছে নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুনমৃত্যু থেকে পালানোর পথ নেই১৮ মার্চ ২০২৫মৃত্যুকে স্মরণ করার গুরুত্বমৃত্যু স্মরণ একটি গভীর আধ্যাত্মিক অনুশীলন। যখন আমরা কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু দেখি, তখন পার্থিব বিষয়গুলো তুচ্ছ মনে হয়। আমরা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে পুনর্বিবেচনা করি।
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘হৃদয় মরিচার মতো মলিন হয়।’ লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, ‘কীভাবে তা পরিষ্কার করা যায়?’ তিনি বললেন, ‘মৃত্যু স্মরণ ও কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে।’ (নাহজুল ফাসাহা)।
এ ছাড়া তিনি বলেছেন, ‘আনন্দের ধ্বংসকারীকে (মৃত্যুকে) বেশি বেশি স্মরণ করো।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৩০৭)
হজরত আলী (রা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রায়ই মৃত্যুকে স্মরণ করে, সে অল্প সম্পদেও সন্তুষ্ট থাকে। সে কখনো লোভী বা কৃপণ হয় না।’ (বিহারুল আনওয়ার)
মৃত্যুর জন্য কী কামনা করা যায়ইসলামে আত্মহত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তাই কোনো বিপদ বা কষ্টের কারণে মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করা অনুমোদিত নয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন বিপদের কারণে মৃত্যু কামনা না করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৫১)।
তবে শহীদ হওয়ার জন্য দোয়া করা, অর্থাৎ আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণের জন্য প্রার্থনা করা ইসলামে অনুমোদিত।
ইসলামের দৃষ্টিকোণে মৃত্যু জীবনের সমাপ্তি নয়; বরং এটি পার্থিব জীবন থেকে চিরস্থায়ী জীবনের দিকে একটি সেতু। মৃত্যু মুমিনের জন্য এটি আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটি সুযোগ।মৃত্যুই শেষ কথা নয়ইসলামের দৃষ্টিকোণে মৃত্যু জীবনের সমাপ্তি নয়; বরং এটি পার্থিব জীবন থেকে চিরস্থায়ী জীবনের দিকে একটি সেতু। এটি ভয় বা দুঃখের বিষয় হলেও মুমিনের জন্য এটি আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটি সুযোগ। মৃত্যু স্মরণ ও এর জন্য প্রস্তুতি আমাদের জীবনকে আরও অর্থবহ করে।
বিপদে পড়লে মৃত্যু স্মরণের দোয়া আমাদের ধৈর্য ধরতে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে সাহায্য করে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা বিপদে পড়ে বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন (আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাব।)’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৬)
এ আয়াত মৃত্যুর সংবাদ শোনার সময়ও পাঠ করা হয়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বিপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে এবং তিনি আমাদের সামর্থ্যের বাইরে পরীক্ষা দেন না। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬)।
প্রতিটি বিপদের মধ্যে আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এ বিপদ ক্ষণস্থায়ী। কারণ, আমরা আল্লাহর কাছে ফিরে যাব।
আরও পড়ুনসন্তান জন্মের আগে মৃত্যু কামনা করেন নবীর মা৩১ মে ২০২৫কয়েকটি দোয়ামৃত্যু ভাবাপন্ন বিপদ হলে: কঠিন বিপদের সময় পাঠ করা যায়, তা হলো নবীজি (সা.)-এর শেখানো: ‘হে আল্লাহ, যতক্ষণ জীবন আমার জন্য কল্যাণকর, ততক্ষণ আমাকে জীবিত রাখো এবং যখন মৃত্যু আমার জন্য উত্তম, তখন আমাকে মৃত্যু দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৫১)
মৃত্যু নিকটবর্তী হলে: মৃত্যুর সময় শুধু আল্লাহই জানেন। তবে আমরা বা আমাদের প্রিয়জন মৃত্যুর কাছাকাছি থাকি এবং ভয় বা উদ্বেগ অনুভব করি, তবে এই দোয়া পাঠ করা যায়: ‘হে আল্লাহ, মৃত্যুর যন্ত্রণা ও কষ্ট থেকে আমাকে সাহায্য করো।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৯৭৮)।
নবীজি (সা.) নিজেও তাঁর মৃত্যুর সময় এই দোয়া পাঠ করেছিলেন।
হে আল্লাহ, যতক্ষণ জীবন আমার জন্য কল্যাণকর, ততক্ষণ আমাকে জীবিত রাখো এবং যখন মৃত্যু আমার জন্য উত্তম, তখন আমাকে মৃত্যু দাও।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৫১সহজ মৃত্যুর জন্য দোয়া: নবীজি (সা.) একটি দীর্ঘ দোয়ার শেষে বলেছেন, ‘এবং আমার মৃত্যুকে আমার জন্য স্বস্তির উৎস করো, যা আমাকে সব অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৮৮)
এখানে সহজ মৃত্যু বলতে পার্থিব অর্থে আরামদায়ক মৃত্যু (যেমন ঘুমের মধ্যে মৃত্যু) বোঝায় না; বরং এটি বোঝায় মৃত্যুর ফেরেশতার আগমন থেকে শুরু করে পরকালে স্থানান্তর পর্যন্ত একটি সহজ প্রক্রিয়া।
মৃত্যুর কঠিন পরীক্ষা থেকে আশ্রয়: একটি দোয়ায় নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে অলসতা, বার্ধক্য, কাপুরুষতা, অক্ষমতা এবং জীবন ও মৃত্যুর পরীক্ষা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।’ (সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ৫৪৯১)
মৃত্যুর সময় শয়তান থেকে বাঁচতে: নবীজি (সা.) এ–সময় দোয়া করেছেন, ‘আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি যেন শয়তান আমার মৃত্যুর সময় আমাকে ক্ষতি করতে না পারে।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ১৫৫২)
ইসলামে মৃত্যুকে ভয়ের বিষয় হিসেবে নয়; বরং আল্লাহর সঙ্গে পুনর্মিলনের একটি সুযোগ হিসেবে দেখা হয়। নিয়মিত মৃত্যু স্মরণ আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়, লোভ-লালসা থেকে দূরে রাখে এবং আমাদের ভালো কাজের পথে রাখে।
আরও পড়ুনমৃত্যু কি শেষ, মৃত্যু আসলে কী৩১ জুলাই ২০২৩