বাজার থেকে বেরিয়ে সামান্য একটু হাঁটতেই অন্ধকার গাঢ় হয়ে ওঠে। কিংস্টর্ক সিগ্রেটে শেষ টানটি দিয়ে মোহিত ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। মুদি-মনিহারির বড়সড় দোকানটিতে ঝোলানো পেট্রোম্যাক্সে তীব্র রোশনি এখান থেকেও দেখা যাচ্ছে। না, কেউ দূরত্ব রেখে তার পেছন পেছন হেঁটে আসছে না। সে পা চালায়। বিকেল থেকে বারবার খিদে জানান দিচ্ছে। কাঁধের সস্তা ব্যাগটিও বেশ ভারী। তাতে দুটি শার্ট-প্যান্ট, গেঞ্জি, লুঙ্গি, হাফ হাতা সোয়েটার, এগারোটি বই ও একগাদা পত্রিকার কাটিং এবং পার্টি লিটারেচারের বান্ডিলে পোরা আছে তার চলমান দিনযাপনের যথাসর্বস্ব। রাজসড়কটি পিচ ঢালা, তবে সারাইয়ের অভাবে এখানে-ওখানে খাল-বাকলা উঠে এমন হালত হয়েছে যে, মোহিত বারবার হোঁচট খায়। ব্যাগে একটি টর্চ-বাতিও আছে। রাতবিরাতে তাকে এক গ্রাম থেকে হেঁটে যেতে হয় অন্য গ্রামে। বর্ষায় সাপখোপও সমস্যা বিশেষ। টর্চটি তাকে এক পার্টি-সমর্থক কিনে দিয়েছিলেন। মাসে-দুই মাসে আড়ালে-আবডালে তার বাড়িতে গেলে মাছ-ভাতটা জুটত, ব্যাটারিও কিনে দিতেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রার পুরোনো সংখ্যাগুলোও তার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে মোহিত পড়তে পারত। কিন্তু গ্রামে রক্ষীবাহিনী এমন ধরপাকড় শুরু করল যে, ওই দিকে যাওয়ার আর কোনো কুদরত থাকল না।
পায়ে স্পঞ্জের ল্যাতপেতে স্যান্ডেলটি পরে থাকায় এবার এবড়োখেবড়ো সড়কে উষ্টাটি বেশ জোরেশোরে আঘাত দেয়। ধকল সামলাতে গিয়ে মোহিত খেয়াল করে, উল্টা দিক থেকে জারকিংয়ে হেলেদুলে এগিয়ে আসছে দুটি হেডলাইট। আন্দাজ করে, মহকুমা শহর থেকে রাতের লাস্ট বাসটি মেইল ট্রেনের প্যাসেঞ্জার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে জংশনের দিকে।
মাত্র আড়াই বছর আগে, ওই মফস্বল শহরে সে ছিল– রাজনৈতিকভাবে বামপন্থার পথিক একটি ছাত্র সংগঠনের মার্কামারা নেতা। নানা কারণে তার মুখখানা ওখানকার বাসিন্দাদের সকলেরই চেনা। আন্ডারগ্রাউন্ডে বছর দুয়েক গা ঢাকা দিয়ে তার চুল-দাড়িতে চেহারায় বেশ বিবর্তন হয়েছিল বটে, কিন্তু আজ সন্ধ্যায় বাজারের একটি সেলুনে শেভ করে খানিকটা পরিচ্ছন্ন হয়েছে। হেডলাইটের আলো সরাসরি এসে পড়বে চোখেমুখে। প্যাসেঞ্জারদের কেউ না কেউ তাকে চিনতে পারলে খবরটা রটবে মুখে মুখে। মোহিত কোনো রিস্ক নিতে চায় না। সে রাজসড়ক থেকে নেমে দ্রুত পা চালিয়ে কেয়াকাঁটার ঝোপের আড়ালে উবু হয়ে বসে। বাসটি জক্করমক্কর শব্দ তুলে অতিক্রম করে গেলে, আস্তে-ধীরে ফের আলপথে সে হাঁটা শুরু করে।
জলকাদায় রাজআইলটি বেজায় স্যাঁতসেঁতে, হাঁটতে হয় সাবধানে। ডান পা-টা খুব ভোগাচ্ছে, তুমুলভাবে টনটনাচ্ছে। রেলওয়ে স্টেশনগুলোতে চেকপয়েন্ট বসেছে, সাদা পোশাকের নজরদারিও বেড়েছে। তাই স্টেশন এভোয়েড করার কড়া নির্দেশ আছে। মাস চারেক আগে, আউটার সিগন্যালের কাছে, রেলগাড়িটি স্লো হলে, লাফিয়ে নামতে গিয়ে পায়ে এ বিপত্তি ঘটল। কিছুতেই সারছে না। আজ অবশ্য মোহিত ট্রেনফেন ধরেনি। রেললাইন ধরে তেরো-চৌদ্দ মাইল হেঁটে সে বাজারটিতে এসেছে।
খানিক দূরের গ্রামে খালার বাড়ি। আত্মীয়কুটুমের বাড়ি কালেভদ্রে যাওয়াতেও জোর নিষেধ জারি হয়েছে। কিন্তু মোহিত ঝুঁকি নিয়ে পার্টি-ডিসিপ্লিন ভাঙছে। খালাম্মা প্যারালাইসিসে শয্যাশায়ী। তবে আকর্ষণ তিনি নন। খালাতো বোন চামেলির বিয়ে ঠিক হয়েছে। ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার আগে সে তাকে এক নজর চাক্ষুষ করতে চায়। একজন পেশাদার বিপ্লবীর জন্য এ ধরনের আবেগরঞ্জিত আচরণ গর্হিত। নিজের চরিত্রের দুর্বলতার ব্যাপারে মোহিত সচেতন। আত্মসমালোচনার দাবানলে পুড়েছে সে বিস্তর, কিন্তু আত্মশুদ্ধি ঘটেও ঘটছে না। সশস্ত্র বিপ্লবের শপথ সে নিয়েছে, পার্টির বিধানপত্রানুযায়ী ভাবনাচিন্তায়– যেসব তৎপরতার সঙ্গে তার হামেশা সম্পৃক্তি আছে, তা নিয়ে প্রতিফলন করতে হয়। স্যান্ডেলটি হাতে নিয়ে প্যাচপেচে কাদা-প্যাক অতিক্রম করতে সে পেছন ফিরে তাকায়। মহকুমা শহরের কলেজটিতে কীভাবে যেন তার জুটেছিল ছাত্রনেতার তকমা। কিন্তু আদতে সে তো একজন কবি, বিপ্লবের চেয়েও লিটল ম্যাগাজিন বের করতেই সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সবচেয়ে বেশি। তার ছোট্ট কাগজটিতে পার্টির মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটাতে গিয়েছিল। আত্রাই এলাকার কৃষক সম্প্রদায়ের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ওপর বিবরণ লিখে সংকলনটি সে ছাপাখানায় দেয়। গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন মুদ্রিত কাগজের বান্ডিলগুলো শুধু বাজেয়াপ্তই করেনি, গ্রেপ্তারের জন্য তাকে খোঁজাখুঁজিও শুরু করে। তাই মোহিতকে গা ঢাকা দিয়ে যেতে হলো আন্ডারগ্রাউন্ডের অনিশ্চিত পরিসরে। গুপ্তজীবনে সে ক্রমাগত এলাকা বদল করেছে, কোনো বাড়িতে সপ্তাহখানেকের জন্য থিতু হলে রাত জেগে লিখেছে কবিতা, আর ‘পলাশ রায়’ ছদ্মনামে পার্টি লিটারেচারে প্রবন্ধ-নিবন্ধও ছাপিয়েছে। এখন পর্যন্ত শ্রেণিশত্রু খতম করে উঠতে পারেনি, ছিনতাই করতেও সমর্থ হয়নি কোনো রাইফেল কিংবা কাটা বন্দুক। তাই পার্টিতে তার অবস্থান হয়ে উঠছে, দিন-কে-দিন কমজোর।
বাজারে থামাটা ঝুঁকিপূর্ণ, এর পরও তাকে থামতে হয়েছে। কারণ, গোঁফ-দাড়িতে এ ভাবসাব চেহারা নিয়ে চামেলির সামনে দাঁড়াতে মন থেকে সায় পায়নি। তাই সেলুনে ঢুকতে হয়েছিল। এবং আরেকটি ব্যাপার, মাস তিনেক হলো সে পত্রিকা পড়ার সুযোগ পায়নি। সন্ধ্যার ট্রেনে বাজারে এসে পৌঁছায় ডেইলি পেপার। তা কিনতে কিনতে সাড়ে সাতটার মতো বেজে গেল। টি-স্টলে বসলে বিবিসি শুনতে পারত, কিন্তু চা-ফা কেনার মতো কড়িপাতি পকেটে নেই, আর নিজেকে এভাবে হাটবাজারে এক্সপোজ করাতে কড়া নিষেধও আছে।
চেষ্টা করে জোরকদমে পা চালাতে। চামেলির টিপ পরা মুখটা ভাবে, কিন্তু ফোকাস করতে পারে না। দৈনিক বাংলার হেডলাইনটি জ্বলজ্বল করে ওঠে, “সংবাদপত্র ডিক্লারেশন বাতিল অধ্যাদেশ জারি”। বাকশালি শাসনে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত চারটি পত্রিকা জারি রেখে বাদবাকি পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খালাদের বাড়ির পুকুরপাড়ে উঠতে উঠতে ভাবে, দুটি দিন এখানে একটু দম ফেলার ফুরসত পেলে, এ ঘটনার একটি জুৎসই জবাব তৈরি করা যায়।
সম্পর্কে ভাগনে, এগারো বছরের নাহির তাকে পা ধোয়ার জন্য বদনায় পানি এনে দেয়। খালু– অবসরপ্রাপ্ত সাব-রেজিস্ট্রার তার সালামের জবাবে বিরসমুখে হু-হাঁ করেন, নির্দিষ্টভাবে কিছু বলেন না। মোহিত ঠিক বুঝতে পারে না, রাতবিরাতে এসে পড়াতে তিনি খুশি না বেজার হয়েছেন। নাখোশ মুখে খালু কাঁচি সিগ্রেট ধরালে, সে ভেতরের কামরায় চলে আসে। নাহিরের প্রশ্ন বেশ কয়েকটি, ফিক করে হেসে সে জানতে চায়, ‘তুমি নাকি বিপ্লবী, হুলিয়া হয়েছে.
ডুরে শাড়ি পরায় তাকে কেমন যেন বড়সড় মেয়েদের মতো দেখায়। চোখে একটু কাজলও পরেছে। ভারী একটি পাথর যেন মোহিতের অবচেতনের গভীর গহন এক পাতকুয়াতে খুপ করে পড়ে। চামেলি নীরবে টেবিলে লেবুর শরবত রেখে ফিরে যায় পর্দার আড়ালে। নাহিরও হাওয়া হয়ে গেছে। একা বসে থাকতে বড্ড অস্বস্তি হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে– পার্টি তাকে ভারতে না গিয়ে দেশে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নির্দেশ দিয়েছিল। তখন পুরো ছয় মাস সে খালার বাড়িতে কাটিয়েছে। গোর্কির ‘মা’ বইটি চামেলিকে পড়ে শোনাতে হতো। সন্ধ্যাবেলা তারা চুপিসারে বাইরের কাচারিঘরে গিয়ে, ভলিউম কমিয়ে দিয়ে শুনত স্বাধীন বাংলা বেতার। চামেলি ফিরে এসে তাকে ইশারায় ভেতরে আসতে ডাকে। শয্যাশায়ী খালাম্মার ঠোঁটমুখ কেমন যেন বাঁকা হয়ে গেছে। অস্পষ্টভাবে তিনি শুধু ‘মোহিত’ শব্দটি উচ্চারণ করে কেঁদে ফেলেন। নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনে মোহিত হিচকিচিয়ে ওঠে! আজ প্রায় দুই বছর হয়, সে হিন্দুপাড়ায় সুভাস, মুসলমানদের বস্তিতে রফিক এবং পার্টিতে কমরেড পলাশ নামে পরিচিত হচ্ছে।
নাহির টেবিলে খাবারের তদারক করে। রান্নাবান্না মনে হয় আজকাল চামেলিই করছে। আশপাশে তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। চকিতে একবার চিড়বিড়ে বেগুনভাজার পিরিচ টেবিলে রেখে যায়। খেতে খেতে তার দিকে ভালো করে তাকানোর কোনো সুযোগ পায় না। তবে চুড়ির মৃদু শব্দ মোহিতের যেন কানে লেগে থাকে।
বাইরের কাচারিঘরে এসে মোহিতের কেমন যেন ঘুম পায়। বেশ কয়েক দিন পর ভরপেট ভাত খাওয়াতে ভীষণ আলসে লাগে। দেশ থেকে দুর্ভিক্ষের টানাটানিটা এখনও কাটেনি। গ্রামের যে বাড়িতে সে শেল্টার নিয়েছে, ওখানে দুই– কখনও তিন বেলা রুটি খেতে হয়। তার কেবলই একটু ধূমপান করতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু সেলুনে বসা ও পত্রিকা কেনার পর, সামান্য যে ভাংতি পয়সা হাতে ছিল তা দিয়ে মাত্র দুই শলা কিংস্টর্ক সিগ্রেট সে কিনতে পেরেছে, তাও আসার পথে ফুঁকে দিয়েছে।
আধশোয়া হয়ে মোহিত প্রতীক্ষা করে। তন্দ্রায় চোখ জড়িয়ে আসছিল, শুকনা পাতায় পায়ের শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসে সে।
না, চামেলি আসেনি। দরজা ঠেলে ঢুকে নাহির। সে কিছু না বলে একটি প্যাকেট ও জলের গ্লাসটি টেবিলে রেখে চুপচাপ ফিরে যায়। বিরক্ত হয়ে মোহিত প্যাকেটটি খোলে। বেরিয়ে আসে তিনটি বই: এ পুস্তকগুলো সে চামেলিকে উপহার দিয়েছিল। ‘ভলগা থেকে গঙ্গা’ নামক বইটি হাতে নিতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে, চামেলিকে নিয়ে লেখা তার কয়েকটি কবিতা। মেজাজ খারাপ হয়ে যায় মোহিতের। ঘোড়ার ডিমের এই মেয়েটির কোনো ধারণাই নেই, কত বড় রিস্ক নিয়ে সে তাকে আজ দেখতে এসেছে? জানাজানি হলে পার্টির দাদা-কমরেডরা ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেবে না!
ছন্নের মতো মোহিত প্যাকেটটি ঝাড়ে, ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে কাঁচি সিগ্রেটের একটি প্যাকেট, তাতে একশলা সিগ্রেটও পাওয়া যায়! চোখে জল এসে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সিগ্রেটের জন্য মেজাজ খারাপ হলে, চামেলি বাবার প্যাকেট থেকে একশলা চুরি করে এনে তার টেবিলে রেখে যেত। মোহিত প্যাকেটটি তন্নতন্ন করে খোঁজে, কিন্তু চেনা হস্তাক্ষরে লেখা চিরকুটটি পায় না সে।
অনেকক্ষণ ঝিম ধরে বসে ছিল মোহিত। সিগ্রেটটি ছিঁড়ে তামাক ছিটিয়ে দিতে দিতে ভাবে, সে বিপ্লবী, আবেগে উপদ্রুত হলে তার উচিত আত্মসমালোচনা। আত্মসংশোধনের প্রক্রিয়া হচ্ছে, বিচ্যুতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে তৎক্ষণাৎ সঠিক পথে ফিরে আসা, এবং স্বদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে বিপ্লবী অ্যাকশনকে আত্মসংশোধনের কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা। মোহিত পত্রিকার হেডলাইনে ‘সংবাদপত্র ডিক্লারেশন বাতিল অধ্যাদেশে’র দিকে তাকায়। এ ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ করা হতে পারে এ মুহূর্তে একজন বিপ্লবীর প্রধান অ্যাকশন। সে মনে মনে ‘রণকৌশল’ হিসেবে একটি প্রতিবাদী-বুলেটিন প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। মুদ্রণের জন্য যদি ছাপাখানা পাওয়া না যায়, তাহলে সাইক্লোস্টাইল করা যায়, অথবা হাতে লিখে দেয়ালপত্রিকা হিসেবে কলেজের নোটিশ বোর্ডে টাঙানো যাবে।
সে একটুকরা কাগজে সম্ভাব্য বুলেটিনের ডামি করতে বসে, এবং বড় বড় হরফে লিখে ‘ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা/ রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা ...।’ ‘পল্টনের ছড়া’ নামে আবু সালেহ রচিত ছড়ার দুটি ছত্র ব্যবহার করতে পেরে তার মন খুশি হয়ে ওঠে।
কী একটা শব্দে ঘুম ভেঙে যায় মোহিতের। চোখ কচলে সে জানালা ফাঁক করে। মনে হয়, খানিক দূরে একটি গাড়ি প্যাচপেচে কাদা-প্যাকে আটকে গেছে। ইঞ্জিন ফের গর্জে উঠলে মোহিতের স্নায়ু শজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে যায়। হাতে ব্যাগফ্যাগ গোছানোর মতো সময় নেই। সে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে আকন্দ ঝোপের ওপর।
বার-বাড়ির পুকুরপাড় ধরে দ্রুত নেমে যেতে যেতে দেখতে পায়, কয়েকটি টর্চের আলো। তার আন্দাজ সম্পূর্ণ সঠিক। রেইড করতে এসে পুলিশের পিকআপ কাদা-প্যাকে আটকে গেছে। গাড়ি ফেলে রেখে পুলিশের দলটি এগিয়ে যাচ্ছে খালার বাড়ির দিকে।
ধেনো-জমি অতিক্রম করে সে ঢুকে পড়ে সুনসান আম-বাগানে। তার প্রান্তিকে গ্রামের মক্তব ও দোচালা মসজিদ। মিম্বরের সামনে পাতা শীতলপাটি। মোহিত শুয়ে পড়ে দম ফেরায়। কেউ না কেউ অবশ্যই পুলিশকে ইনফর্ম করেছে। সেলুনে চশমা-পরা এক লোক তার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল, আর চোখাচোখি হলেই ফিরিয়ে নিচ্ছিল দৃষ্টি। সে কি ফাঁড়িতে খবর দিয়েছে? মানুষটি তাকে চিনে থাকলেও, সে যে খালার বাড়িতে রাত কাটবে, তা বুঝল কীভাবে?
তবে কি সহযোদ্ধা কমরেড সেলিম? সে তো এ গ্রামেরই ছেলে, স্কুলে চামেলির ক্লাসমেট ছিল। আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার পর সেলিমের মাধ্যমে তার ও চামেলির মধ্যে দু-চারটি চিঠিপত্র বিনিময় হয়েছে। সেলিম অবগত যে, মোহিত শুধু একবার চামেলিকে চাক্ষুষ করতে আজ এখানে আসবে।
বিরাট একটি ঝুঁকি, পার্টির দাদা-কমরেডরা যদি কোনোভাবে জেনে যান, সে ডিসিপ্লিন ভেঙে আত্মীয়বাড়িতে গিয়ে রেইডে পড়েছে ... তাহলে? উদ্বেগ কিছুতেই মোহিত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। রেইডে গিয়ে পুলিশরা হালফিল শেল্টারের লোকজনকে মারপিট করছে, থানা পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়ে হেনস্তা করছে। কে জানে খালার পরিবারের সঙ্গে তারা এখন কী আচরণ করছে?
মোহিত চোখ বন্ধ করে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করে। ফজরের আজানের বেশ আগে তাকে মসজিদটি ছাড়তে হবে। তার পাঁজরের গহন-গভীরে অদৃশ্য পাতকুয়াটিতে ধুপ ধুপ করে পড়ে কয়েকটি ভারী পাথর। সে ফের চোখ বন্ধ করে, আর দেখতে পায়, চামেলি আলগোছে খালুর প্যাকেট থেকে তুলে নিচ্ছে একশলা কাঁচি সিগ্রেট। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
কুবিতে নতুন ১৮ বিভাগ ও ৪ ইনস্টিটিউট চালুর সুপারিশ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ৮৯তম একাডেমিক কাউন্সিল মিটিংয়ে সার্বিকভাবে আসন সংখ্যা কমানোসহ অর্গানোগ্রামে আরো ১৮টি নতুন বিভাগের অন্তর্ভুক্তি, চারটি ইনস্টিটিউট চালু এবং ১২টি বিভাগে পিএইচডি ডিগ্রি চালুর সুপারিশ করা হয়েছে।
সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ল্যাবভিত্তিক বিভাগগুলোতে আসন সংখ্যা ৪০টি এবং ল্যাববিহীন বিভাগগুলোতে ৫০টি আসন রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। নতুন ১৮টি বিভাগ অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত বিভাগগুলো হলো—পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, জৈব রসায়ন ও আণবিক জীববিজ্ঞান বিভাগ এবং জৈবপ্রযুক্তি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত বিভাগগুলো হলো—সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ। কলা ও মানবিক অনুষদভুক্ত গুলো হলো—ইসলামিক স্টাডিজ ও সংস্কৃতি বিভাগ, ইতিহাস বিভাগ এবং দর্শন বিভাগ। ব্যবসায় অনুষদভুক্ত বিভাগগুলো হলো— পর্যটন ও আতিথেয়তা ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ব্যবসায়িক তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ, আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিভাগ এবং লজিস্টিক ও মার্চেন্ডাইজিং বিভাগ। প্রকৌশল অনুষদভুক্ত বিভাগগুলো হলো— বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগ, রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগ, পুরকৌশল বিভাগ এবং যন্ত্রকৌশল বিভাগ। আইন অনুষদভুক্ত বিভাগটি হলো— অপরাধবিদ্যা বিভাগ।
পাশাপাশি চারটি ইনস্টিটিউট গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো হলো—আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় উন্নত গবেষণা কেন্দ্র এবং একাডেমিক মান বৃদ্ধি কেন্দ্র। এগুলোর গঠন কাঠামোও সুপারিশ করা হয়েছে।
এর মধ্যে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের জন্য পরিচালক হিসেবে একজন অধ্যাপক, নিয়মিত অধ্যাপক দুইজন, তিনজন সহযোগী অধ্যাপক, সেকশন অফিসার বা ম্যানেজার একজন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা একজন, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার টাইপিস্ট একজন, অফিস সহায়ক দুইজন এবং একজন ক্লিনার।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় উন্নত গবেষণা কেন্দ্র এবং একাডেমিক মান বৃদ্ধি কেন্দ্রের জন্য পরিচালক হিসেবে একজন অধ্যাপক, একজন অতিথি অধ্যাপক, অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে একজন অধ্যাপক অথবা সহযোগী অধ্যাপক, সেকশন অফিসার অথবা ম্যানেজার হিসেবে একজন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা একজন, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার টাইপিস্ট একজন, অফিস সহায়ক দুইজন এবং ক্লিনার একজন।
১২টি বিভাগে পিএইচডি ডিগ্রি চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিটি বিভাগে ন্যূনতম ২৬ জন করে শিক্ষক রাখার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেছেন, “আমরা মিটিংয়ে এগুলো সুপারিশ করেছি। অর্গানোগ্রাম অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় ডিপার্টমেন্টের জন্য ছাড়পত্র চায়, তারপর কমিশন (ইউজিসি) যদি অনুমোদন দেয়, তখন সেটা অর্গানাগ্রামে যুক্ত হয়। অর্গানোগ্রামে থাকলেই যে বিভাগ হয়ে যাবে, এমন না। একটা অনুমোদন দিয়ে রাখে। এই অনুমোদনের আলোকে আবার যখন দরখাস্ত দেওয়া হয়, তখন কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেবে।”
তিনি আরো বলেন, “ইউজিসি আমাদের নির্দেশনা দিয়েছে আসন সংখ্যা কমাতে, যাতে কোয়ালিটি এডুকেশনের নিশ্চিত হয়। তারা ল্যাববেজড বিভাগের জন্য ৪০টি আসন এবং ল্যাববিহীন বিভাগের জন্য ৫০টি আসন বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।”
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বলেছেন, “অনেকগুলো সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছে। তবে, এখনই না দেখে বলা যাচ্ছে না। রেজ্যুলেশন পাস হলে বিস্তারিত বলতে পারব।”
ঢাকা/এমদাদুল/রফিক