আ’লীগের রাজত্বে যুবদল স্বেচ্ছাসেবক দলের হানা
Published: 18th, April 2025 GMT
বজলুর রহমান ওরফে বজলু মেম্বার মারা যান ২০২৩ সালের মার্চে। দীর্ঘ ১৪ বছর পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের (চনপাড়া বস্তি) অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ নেন কায়েতপাড়া ইউপি সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সমশের আলী খান। গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পালিয়ে যান সমশের। এর পর আত্মগোপন থেকে ফেরেন চনপাড়া বিএনপি, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা। তাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও মাদক কারবার নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নেন যুবদল এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা। ইতোমধ্যে দু’পক্ষ একাধিকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে; হয়েছে প্রাণহানিও। এতে আবারও আতঙ্কিত বস্তির সাধারণ বাসিন্দারা।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রূপগঞ্জ থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক (সদ্য বহিষ্কৃত) শামীম হোসেন চনপাড়া বস্তির নিয়ন্ত্রণ নেন। তার সহযোগী চনপাড়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মনির দেওয়ান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব আলী, দপ্তর সম্পাদক মো.
মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য নিয়ে সর্বশেষ গত ১৮ মার্চ রাতে সংঘর্ষ হয় দু’পক্ষের। ভোর পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষ, গোলাগুলি এবং বাসাবাড়িতে চলে লুটপাট। গুলিতে ইউনিয়ন যুবদল নেতা মো. বাবু ওরফে দারোয়ান বাবুর ভাই মো. হাসিব নিহত হন। পরে রাব্বানী, শাকিল, করিমসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় মামলা করেন তার ভাই যুবদল নেতা দারোয়ান বাবু। তার অভিযোগ, ‘চনপাড়ায় মাদকের অন্তত ২০০ স্পট রয়েছে। ৫ আগস্টের পর শামীম হোসেনসহ যুবদল নেতারা মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। কিন্তু স্বেচ্ছাসেবক দলের রাব্বানি, শাকিল ও করিম মাদক কারবার করায় শামীমের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।’
রূপগঞ্জ থানা যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আমিনুল ইসলাম জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শামীম হোসেনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
জানা যায়, ৫ আগস্টের পর থেকে যুবদল নেতা শামীম হোসেনের একক নিয়ন্ত্রণ চলছিল চনপাড়ায়। যুবদলের কমিটিতে থাকা রাব্বানি, করিম, শাকিলসহ তাদের লোকজন ছিল শামীমের ডান হাত। তবে মাস তিনেক আগে তারা শামীমকে ছেড়ে স্বেচ্ছাসেবক দলে নাম লেখান। এর পরই শামীম হোসেনের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন রাব্বানি-করিমের গ্রুপ। বস্তি নিয়ন্ত্রণে দু’পক্ষই শক্তি প্রদর্শন করতে থাকে। অবাধে দখল, চাঁদাবাজি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, মাদক কারবারসহ নানা অপরাধ করে আসছে।
স্থানীয়রা জানান, গত সেপ্টেম্বরে ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কর্মী মনির হোসেন এবং চনপাড়া ইউনিট স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শফিকুলের মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেন লিটন হাওলাদার ও তার ভাগনে আব্দুল করিম। গত ফেব্রুয়ারিতে স্বামীর অনুপস্থিতিতে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক নারীর বাসায় জোর করে ঢুকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে লিটন। তার চিৎকারে লোকজন জড়ো হলে লিটন পালিয়ে যান। আগস্টের শেষ দিকে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের এক নারীর বাসায় ঢুকলে লোকজন ধরে লিটনকে গণধোলাই দেন। ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের পলাতক আনিসুর রহমানের দুটি দোকান দখল করে স্বেচ্ছাসেবক দলের ক্লাব বানিয়েছেন রাব্বানি ও করিম। একই ওয়ার্ডের দুটি সমিতির অফিস দখল করে ব্যবসা করছেন গ্যাস সিলিন্ডারের। চনপাড়ায় প্লট বা ঘর বেচাকেনা হলে লিটনকে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। টাকা না দিলে লুটপাট চালানো হয় বাসায়। মার্চের শুরুতে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাসুম একই ওয়ার্ডে একটি প্লট কেনেন সাড়ে ৫ লাখ টাকায়। মাসুমের কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন লিটন। চাঁদা না দেওয়ায় তার বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় লিটনের লোকজন। ভয়ে মাসুম আইনের আশ্রয় নেননি।
অন্যদিকে, নিরীহ মানুষের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তালা মেরে চাঁদা আদায় করছেন শামীম ও তার অনুসারীরা। আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের ঘরবাড়িতে লুটপাট চালায় তারা। গত সেপ্টেম্বরে চনপাড়ার একটি প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায় শামীম ও তার লোকজন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের মারধর করে ১ লাখ টাকা চাঁদা নেন।
অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করেও লিটন হাওলাদার, আব্দুল করিম, রাব্বানি ও শাকিলের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। শামীম হোসেনের ফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়নি।
রূপগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘চনপাড়ার আধিপত্য নিয়ে স্থানীয় যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। করিম, রাব্বানি, শাকিলসহ অপরাধ কার্যক্রমে জড়িতদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
রূপগঞ্জ থানার ওসি লিয়াকত আলী সমকালকে বলেন, ‘চনপাড়ায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে একাধিক গ্রুপ সক্রিয়। গুরুত্ব বিবেচনায় চনপাড়ায় মাঝেমধ্যে ব্লক রেইড হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘শামীম, করিম, রাব্বানিসহ অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত র পগঞ জ থ ন য বদল ন ত চনপ ড় য় য বদল র ল টপ ট স ঘর ষ ল কজন আওয় ম আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
২২ ক্যাডার নিয়ে চলতেন স্বেচ্ছাসেবক দলের জিতু
বগুড়ায় মেয়েকে উত্ত্যক্ত ও বাবাকে খুনে অভিযুক্ত জিতু ইসলাম দলীয় প্রভাবে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কথায় কথায় যাকে-তাকে অহেতুক মারধর করতেন। চলতেন ২২ জনের ক্যাডার বাহিনী নিয়ে। তারা সবাই নানা অপকর্মে জড়িত এবং একাধিক মামলার আসামি। তাঁর আয় চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা থেকে। গতকাল রোববার এলাকায় গিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, জিতু ফুলবাড়ী কারিগরপাড়ার মৃত সেকেন্দার আলীর ছেলে। ২০০৩ সালে এলাকায় বালু ব্যবসা নিয়ে প্রতিপক্ষ রবিউল ইসলামকে খুন করেন। সেই মামলায় তাঁর ১৪ বছর সাজা হয়। সাজা খেটে তিন বছর আগে বের হন। এর পর এলাকায় গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। তাঁর বাহিনীতে যে ২২ জন সদস্য, তারা কেউ রাজনৈতিক দলের পদ-পদবিতে নেই। হত্যা মামলা ছাড়াও জিতুর বিরুদ্ধে একটি মাদক ও একটি ডাকাতির মামলা রয়েছে।
ফুলবাড়ীর এক মুদি দোকানি বলেন, জিতু মাঝেমধ্যে তাঁর দোকান থেকে বাকি নিতেন। দু’বছরে বাকির পরিমাণ প্রায় ৪৮ হাজার টাকা হয়। তখন একদিন টাকা চান। এ কারণে জিতু তাঁকে মারধর করে নাকে খত নেন।
বৃন্দাবন এলাকার আরেক ব্যবসায়ী বলেন, মাঝেমধ্যে জিতু তাঁর বাহিনী নিয়ে হাজির হতেন। মোটা অঙ্কের চাঁদা চাইতেন। চাঁদার কমপক্ষে অর্ধেক দিয়ে তবে নিস্তার পাওয়া যেত। এ ছাড়া ঈদে সেলামির নামে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হতো তাঁকে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী জানান, তাঁর কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা চান জিতু। না দেওয়ায় দোকানে ককটেল হামলা করেন। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় আগস্টের পর জিতু বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এলাকার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নিয়ে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। ছোট ভাই মিতুলও তাঁর বাহিনীর সদস্য।
জিতু গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের ১০১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সহসাধারণ সম্পাদকের পদ পান। সন্ত্রাসী হয়ে দলের পদ পাওয়ায় এলাকায় তাঁকে নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পদ পেয়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
এলাকার এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘জিতুর কারণে আমরা মুখ খুলতে পারি না। সে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার মাধ্যমে এলাকা অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি পেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তার নির্যাতনের শিকার অর্ধশতের কম হবে না। তার বখাটেপনার কারণে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হতো না।’
এক বছর আগে থেকে ফুলবাড়ির পাশেই শহরের শিববাটি এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকেন জিতু। সেই এলাকার বাসিন্দা রিকশাচালক শাকিল হোসেন। শাকিলের মেয়ে স্থানীয় ভান্ডারী সিটি বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। এক মাস আগে ৫২ বছর বয়সী জিতু বিয়ের প্রস্তাব দেন শাকিলের মেয়েকে। বিষয়টি শাকিল জেনে রাগ করেন। জিতুর ওপর চড়াও হন। কিছুতে রাজি না হলে নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকেন জিতু। তাঁর মেয়েকেও উত্ত্যক্ত করতেন। এরই এক পর্যায়ে শনিবার বিকেলে শাকিলকে পিটিয়ে খুন করেন জিতু ও তাঁর বাহিনী।
এ হত্যার ঘটনায় জিতুকে এক নম্বর আসামি করে ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে গতকাল রোববার বগুড়া সদর থানায় হত্যা মামলা করেছেন শাকিলের স্ত্রী মালেকা খাতুন। পুলিশ শনিবার রাতেই জিতু ও তাঁর সহযোগী মতি এবং বিপ্লবকে আটক করে।
সন্ত্রাসীকে দলের পদ দেওয়ার বিষয়ে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সরকার মুকুল বলেন, ‘আমি জানতাম না, সে দলের নাম ভাঙিয়ে এসব অপকর্ম করছে। আমরা তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছি।’ শনিবার রাতে স্বেচ্ছাসেবক দল কেন্দ্রীয় সভাপতি এস এম জিলানী ও সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসানের সই করা বিবৃতিতে জিতু ইসলামকে বহিষ্কার করা হয়। সেই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ জানানো হয়।
বগুড়া সদর থানার ওসি হাসান বাসির বলেন, ‘এ মামলার অন্য আসামিদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ফুলবাড়ী পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক জোবায়ের খান জানান, গতকাল জিতুসহ তিন আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মেহেদী হাসান পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে হত্যার প্রতিবাদ ও দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম জেলা শাখা। গতকাল বিকেলে শহরের সাতমাথায় সংগঠনের সভাপতি অ্যাডভোকেট দিলরুবা নূরী এতে সভাপতিত্ব করেন।