ওয়াসার পানিতে লাল কেঁচো, সাদা পোকা!
Published: 24th, April 2025 GMT
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়া এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। সপ্তাহ দুই হয়ে গেল তাঁর বাসায় ওয়াসার সরবরাহ করা পানির সঙ্গে লাল কেঁচো ও সাদা পোকা আসছে। এর মধ্যে দুবার বাসার ট্যাঙ্কি পরিষ্কার করলও সমস্যার কিনারা হয়নি। ঝুঁকি না নিয়ে বাধ্য হয়ে এখন পানি কিনে খাচ্ছেন।
শান্তিবাগের বাসিন্দা মনির হোসেনের কাছে পানির কষ্ট আরও বিরক্তিকর। বললেন, ওয়াসার পানি দেখে গা ঘিনঘিন করে। দুর্গন্ধ তো আছেই, সঙ্গে পানিতে কিলবিল করে ছোট ছোট কেঁচো। ফুটিয়ে যে খাব, সেটারও রুচি হয় না।
কল্যাণপুর মসজিদ গলিতেও ওয়াসার পানির একই হাল। সেখানকার বাসিন্দারা জানান, মার্চের শুরু থেকেই পানির এমন দুরবস্থা। ওয়াসায় অভিযোগ দিয়েও ফল আসেনি। উল্টো তারা ট্যাপের মুখে পাতলা কাপড়ের ছাকনি ব্যবহার ও ট্যাঙ্কি পরিষ্কারের পরামর্শ দেয়।
কয়েক মাস ধরেই রাজধানীর তেজগাঁও, মালিবাগ, মগবাজার, মধুবাগ, বাসাবো, মানিকনগরসহ বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে ওয়াসার পানির সঙ্গে পোকা আসার অভিযোগ মিলেছে। ঢাকা ওয়াসা ব্যাপারটি আমলেই নিচ্ছে না। সরকারি সংস্থাটি বলছে, উৎস পর্যায়ে পানির মান সঠিক আছে। গ্রাহকের রিজার্ভ ট্যাঙ্ক ও ওভারহেড ট্যাঙ্ক ঠিকমতো পরিষ্কার না করায় সেখানে এসব ছোট ছোট প্রাণীর অস্তিত্ব তৈরি হচ্ছে। গ্রাহকরা ট্যাঙ্কগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করলে এ ধরনের জীবাণু তৈরির কোনো সুযোগ নেই। এই দায় ওয়াসার নয়, গ্রাহকের।
গ্রাহকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ঢাকা ওয়াসা কয়েকটি এলাকার পানির নমুনা নিয়ে তাদের নিজস্ব গবেষণাগারে পরীক্ষা করে। এ ধরনের একটি নমুনার প্রতিবেদন সমকালের হাতে এসেছে। সেখানে ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিকর কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব মেলে।
ওয়াসার গবেষণাগারের প্রতিবেদনটি দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শাকিলা নারগিস খান সমকালকে বলেন, ‘বাসাবাড়ির ট্যাপের পানি সংগ্রহ করে ওয়াসা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে ১২টি কলিফর্মের অস্তিত্ব মিলেছে। পানির পানযোগ্যতার মান পরীক্ষার ক্ষেত্রে আরও যেসব নিরীক্ষা লাগে, তা ওয়াসা করেনি।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকার অনেক স্থানে ওয়াসার পাইপলাইনের সঙ্গে স্যুয়ারেজ লাইনের সংযোগের অভিযোগ আছে, যে কারণে পানিতে অনেক সময় মলমূত্রের দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। মলমূত্রে ফিকল কলিফর্ম নামে মারাত্মক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থাকে। গবেষণায় হয়তো ফিকল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। কাজেই এই রিপোর্ট দিয়ে বোঝা যাবে না ওয়াসার পাইপলাইনের পানি মানবস্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর। সাধারণ যে কলিফর্মের অস্তিত্ব তারা পেয়েছে, সেটাও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর– এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা.
ওয়সার গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, বাসাবাড়ির পানিতে প্রতি লিটারের পিএইচ পাওয়া গেছে ৬ দশমিক থেকে ৮ দশমিক ৫। ট্রিবিউডিটি মিলেছে ১ দশমিক ৫৭, যার মাত্রা হওয়া প্রয়োজন ৫। বেসিনে সলিড ওয়াটার পাওয়া গেছে ৪১৯ মিলিগ্রাম, অ্যামোনিক্যাল মিলেছে ১ দশমিক ৫-এর স্থলে দশমিক ০৩। ক্লোরিন মিলেছে শূন্য দশমিক ১। কলিফর্ম মিলেছে ১২।
এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার ল্যাবরেটরির ডেপুটি চিফ মাইক্রোবায়োলজিস্ট ড. মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমরা ফিকল কলিফর্মের বিষয়ও অনেক সময় প্রতিবেদনে উল্লেখ করি। হয়তো এ ক্ষেত্রে সেটা উল্লেখ করা হয়নি। কলিফর্মের যে চিত্র রিপোর্টে এসেছে, সেটা ওয়াসার পানির উৎস পর্যায় বা সরবরাহ পর্যায়ে মেলেনি। সেটা মিলেছে গ্রাহকের ট্যাপের পানিতে। অর্থাৎ সেটা তৈরি হয়েছে গ্রাহকের ট্যাঙ্কিতে। আর কোনো স্থানে ভালো পানিও কিছু দিন থাকলে ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।’
রাজধানীর বেশ কিছু এলাকার পানিতে পোকা আসার বিষয়টি স্বীকার করেন ঢাকা ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা। মূলত সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার থেকে সরবরাহ করা পানিতে পোকা পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, ওই শোধনাগার থেকে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গ র হক র পর ষ ক র এল ক র দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
৭৭ মেট্রিক টন চাল তুলে নিয়েছেন ডিলার, উপকারভোগীরা জানেন ‘বরাদ্দ হয়নি’
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় গত জুলাই মাসে ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশের (টিসিবি) উপকারভোগীদের জন্য ৭৭ দশমিক ৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছিল। প্রক্রিয়া অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এ চাল খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস) একজন ডিলার (পরিবেশক) তুলেও নেন। তবে ওই মাসে টিসিবির অন্য পণ্য পেলেও চাল পাননি বলে অভিযোগ করেছেন উপকারভোগীরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মহম্মদপুরের ৮ ইউনিয়নে টিসিবির উপকারভোগী কার্ডধারী আছেন ১৫ হাজার ৫৬৭ জন। এসব উপকারভোগী নিজেদের কার্ড দেখিয়ে প্রতি মাসে একবার ইউনিয়নের টিসিবির নিয়োগ করা ডিলারের কাছ থেকে বাজারের চেয়ে কম মূল্যে তেল, চিনি, ডাল ও চাল কিনতে পারেন। গত জুলাইয়ে ডিলারদের কাছ থেকে তেল, চিনি ও ডালের একটি প্যাকেজ কিনতে পেরেছেন তাঁরা। ওই মাসে চালের বরাদ্দ আসেনি বলে জানানো হয় কার্ডধারীদের।
মহম্মদপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে পাওয়া নথিতে দেখা গেছে, গত ৩০ জুলাই উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মজনুর রহমান স্বাক্ষরিত দুইটি বিলি আদেশে (ডিও) উপজেলার হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে একজন ওএমএস ডিলারের অনুকূলে ৭৭ দশমিক ৮৩৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই দিনই মহম্মদপুর ও বিনোদপুর খাদ্যগুদাম থেকে এ চাল তুলেও নেওয়া হয়।
সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।শরিফা, টিসিবির কার্ডধারী, রাজাপুর ইউনিয়নটিসিবি ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন টিসিবি উপকারভোগীদের চাল ছাড়া অন্য পণ্য সরাসরি তাঁদের নিয়োগ করা ডিলারদের কাছে সরবরাহ করে। চালের বরাদ্দ দেওয়া হয় খাদ্য বিভাগ থেকে। এ অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে প্রথমে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ করা ওএমএস বা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলারদের অনুকূলে ২৬ টাকা কেজি দরে চাল বরাদ্দ দেয়। সেই চাল ওই ডিলারদের কাছ থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে নেন টিসিবির ডিলাররা। এরপর তাঁরা ৩০ টাকা কেজি দরে ওই চাল উপকারভোগীদের কাছে বিক্রি করেন।
উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের পারুল নামে টিসিবির এক উপকারভোগী ১ সেপ্টেম্বর জানান, আগস্ট মাসে চাল, ডাল, তেল ও চিনির প্যাকেজ পেলেও জুলাই মাসে তাঁদের চাল ছাড়া অন্য তিন ধরনের পণ্যের প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল। জুলাই মাসে তাঁদের জানানো হয় চাল বরাদ্দ হয়নি।
বিষয়টি জানতে উপজেলার ৮ ইউনিয়নে টিসিবির নিয়োগ করা ৮ জন ডিলারের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মধ্যে মহম্মদপুর সদর, নহাটা, পলাশবাড়ীয়া, বালিদিয়া, রাজাপুর ও বাবুখালী ইউনিয়নের ডিলার জানিয়েছেন, জুলাই মাসে তাঁদেরকে চাল দেওয়া হয়নি। নহাটা ও রাজাপুর ইউনিয়নের ডিলার মিলন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মিলন ঘোষ ৪ সেপ্টেম্বর বলেন, ‘জুলাই মাসে আমাদের বলা হইছিল চাল বরাদ্দ নেই। এ কারণে চাল ছাড়া অন্য পণ্যগুলো বিক্রি করেছি। তবে অ্যাপে দেখাইছিল চাল। কিন্তু আমরা পাইনি।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পানঅবশ্য বিনোদপুর ও দীঘা ইউনিয়নের দুই ডিলার দাবি করেছেন তাঁরা অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে চালও কার্ডধারীদের কাছে বিক্রি করেছেন। তবে দুই ইউনিয়নের অন্তত ১০ জন উপকারভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাঁরা কেউই চাল পাননি। এর মধ্যে বিনোদপুর বাজারের একজন ফল ব্যাবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জুলাই মাসে ডিলার জানাইছিল চাল ফুরায় গেছে।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পান বলে খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে হোসেনিয়া কান্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে সরবরাহ করা তাঁর মুঠোফোনে সোমবার যোগাযোগ করা হলে একজন ধরে জানান, ওই নম্বর হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে কেউ ব্যবহার করেন না।
জানতে চাইলে টিসিবির ঝিনাইদহ ক্যাম্প অফিসের উপপরিচালক আকরাম হোসেন সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিসিবির চাল খাদ্য বিভাগ থেকে সরবরাহ করা হয়। আর বিতরণ কার্যক্রম তদারকির জন্য প্রতিটি উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। যেখানে প্রতি ইউনিয়নে একজন ট্যাগ অফিসার আছেন, যিনি এগুলো তদারকি করেন।’
জেলার কয়েকজন চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৬ টাকা কেজি দরে কেনা এসব চাল বাজারে প্রায় ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। উপকারভোগীদের কাছে তা ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করার কথা। এ হিসাবে উপকারভোগীদের ফাঁকি দিয়ে এ চাল বাজারে বিক্রি করতে পারলে কেজিতে ২২ থেকে ২৪ টাকা লাভ হয়।
চাল না পাওয়ার বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি বলে জানিয়েছেন মহম্মদপুরের ইউএনও শাহীনুর আক্তার। সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাল দেওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত এমন অভিযোগ কেউ দেয়নি। খাদ্য অফিস থেকে আমি যত দূর জানতে পেরেছি তাতে সবকিছু দেওয়া হয়ে গেছে। বরাদ্দ থাকলে তা আটকে রাখার সুযোগ নেই। তারপরও কোনো অভিযোগ থাকলে খতিয়ে দেখব।’
হঠাৎ এক মাসে চাল না পাওয়ায় বিপাকে পড়েন উপকারভোগীরা। রাজাপুর ইউনিয়নের শরিফা নামের টিসিবি কার্ডধারী এক নারী বলেন, ‘সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।’