নীতির স্বাধীনতা নাকি প্রশাসনিক বিভাজন
Published: 25th, April 2025 GMT
বাংলাদেশের রাজস্ব প্রশাসনে একটি ঐতিহাসিক রূপান্তরের সূচনা হতে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে সরকার সম্প্রতি একটি অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এ সংস্কারের মূল প্রতিপাদ্য হলো নীতি প্রণয়ন বিভাগকে কর আদায় ও প্রশাসনিক কাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করা। সরকারি মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে, এ পরিবর্তন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ার পাশাপাশি রাজস্বনীতি ব্যবসাবান্ধব হবে।
তাত্ত্বিকভাবে এ উদ্যোগকে অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রগতিশীল পদক্ষেপ হিসেবে মূল্যায়ন করা যায়। যখন কোনো প্রতিষ্ঠান একই সঙ্গে নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও ফলাফল মূল্যায়নের দায়িত্ব একই হাতে পরিচালনা করে রাখে, তখন স্বাভাবিকভাবে স্বচ্ছতার ঘাটতি ও জবাবদিহিতার সংকট দেখা দেয়। একটি স্বতন্ত্রনীতি বিভাগ গঠনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমের ওপর একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এ সংস্কারের সুফল কতটা বাস্তবে প্রতিফলিত হবে, তা নির্ভর করবে কিছু মৌলিক প্রশ্নের সঠিক সমাধানের ওপর।
নেতৃত্বের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা : সরকারি অধ্যাদেশ অনুযায়ী, নবগঠিত নীতি বিভাগ পরিচালনায় নীতিনির্ধারক হিসেবে সচিব বা জ্যেষ্ঠ সচিব পর্যায়ের একজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো– এই ‘অভিজ্ঞতা’ কিসে পরিমাপ করা হবে? কেবল প্রশাসনিক দক্ষতা নয়, রাজস্বনীতির তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান, আন্তর্জাতিক কর কাঠামোর উপলব্ধি এবং দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে গভীর ধারণা থাকা অপরিহার্য। রাজস্ব প্রশাসনের ক্ষেত্রে যেমন মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা অপরিহার্য, তেমনি নীতি বিভাগের নেতৃত্বের জন্য গবেষণায় পারদর্শিতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও দূরদর্শিতা জরুরি।
জনবল কাঠামো ও স্থায়িত্ব : নীতিনির্ধারণ একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া, যার জন্য প্রয়োজন সুসংহত গবেষণা ও ধারাবাহিক চিন্তার ধারা। খসড়া অধ্যাদেশে নীতি বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে ‘অভিজ্ঞ’ হওয়ার কথা বলা হলেও, এই অভিজ্ঞতার সময়সীমা বা ধরন স্পষ্ট নয়। রাজস্বনীতি বুঝতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবশ্যই অন্তত ১০ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তদুপরি, তাদের কমপক্ষে ৪ থেকে ৮ বছর একই বিভাগে কাজ করার নিশ্চয়তা থাকতে হবে, যেন জ্ঞানের ধারাবাহিকতা ও নীতির স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। চুক্তিভিত্তিক বা অস্থায়ী নিয়োগ হলে তা এ ধারাকে ব্যাহত করবে। নীতি বিভাগে কাজ শেষে আবার যদি কর্মকর্তারা রাজস্ব প্রশাসনে ফিরে যান, তাহলে স্বার্থের সংঘাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। তাই জনবল গঠনে স্বচ্ছ ও টেকসই নীতিমালা জরুরি।
গবেষণা ও উন্নয়ন ইউনিটের অবস্থান : আধুনিক রাজস্বনীতিতে গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রশ্ন হলো– গবেষণা ও উন্নয়ন ইউনিটটি কি নীতি বিভাগের অধীনে থাকবে? যদি না থাকে, তাহলে নীতি প্রণয়ন তথ্য ও বিশ্লেষণ থেকে বঞ্চিত হবে। এ ইউনিট অবশ্যই নীতি বিভাগের অংশ হওয়া উচিত, যাতে তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত হয়।
তথ্য বিনিময় ও সমন্বয় কাঠামো : নীতিমালা বাস্তবায়নে প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত ও সুষ্ঠু তথ্য বিনিময় অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ– কর আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো বাধার সম্মুখীন হলে তা অবিলম্বে নীতি প্রণয়নকারীদের নজরে আসতে হবে। একইভাবে নতুন কোনো নীতি প্রণয়নের আগে সংশ্লিষ্ট খাতের বাস্তবতা ও প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতাগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। রাজস্ব প্রশাসনের হাতে আদায়ের তথ্য থাকবে, কিন্তু সেসব তথ্য নীতি বিভাগে পৌঁছাবে কীভাবে? একটি আধুনিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরের মাধ্যমে দুই বিভাগের মধ্যে নিয়মিত ও দ্বিমুখী যোগাযোগ স্থাপন জরুরি।
উপদেষ্টা কমিটি ও অংশগ্রহণ : কার্যকর নীতিনির্ধারণে খাতভিত্তিক বাস্তবতা বোঝা জরুরি। যেমন– শিল্প খাতের জন্য প্রযোজ্য কর কাঠামো এবং সেবা খাতের কর নীতিমালা একই রকম হবে না। একটি কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা কমিটির পাশাপাশি শিল্প, সেবা, কৃষি ইত্যাদি বিভিন্ন খাতভিত্তিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করলে, নীতিমালা আরও বাস্তবভিত্তিক ও গ্রহণযোগ্য হবে। এতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে এবং নীতির বৈচিত্র্য বজায় থাকবে।
চূড়ান্ত ভাবনা : নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের পৃথক কাঠামো একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ হলেও, এটি কতটা কার্যকর হবে তা নির্ভর করবে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর। দক্ষ ও অভিজ্ঞ নেতৃত্ব, স্থায়ী ও অভিজ্ঞ জনবল, গবেষণা কাঠামোর সংযুক্তি, তথ্যপ্রবাহের স্বচ্ছতা এবং অংশগ্রহণমূলক ও খাতভিত্তিক উপদেষ্টা কাঠামো।
যদি এ উপাদানগুলোকে সুদৃঢ় করা যায়, তাহলে নীতির স্বাধীনতা কেবল কাগজে নয়, বাস্তবেও প্রতিফলিত হবে। অন্যথায়, এটি কেবল একটি প্রশাসনিক বিভাজন হিসেবে থেকে যাবে, যা কাঠামো বদলাবে, ফল আনবে না। সরকারের দায়িত্ব হবে এই সংস্কারকে একটি কার্যকর, স্বচ্ছ ও টেকসই রূপ দেওয়া, যাতে সত্যিকারের অর্থে জনগণ এর সুফল ভোগ করতে পারে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুনজর কখন পড়বে
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নে দ্বিতল ভবনবিশিষ্ট একটি মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রে ওষুধ নেই, চিকিৎসক নেই, বিদ্যুৎ–সংযোগ নেই। ফলে তেমন একটা রোগীও নেই। এই ‘নাই নাই’ হাসপাতালটির নাম মাস্টারদা সূর্য সেন মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র। এভাবে কি একটা হাসপাতাল চলতে পারে? প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যাওয়ার এমন নমুনা আমাদের হতাশ করে। দেশজুড়ে এ রকম আরও চিত্র আমরা দেখতে পাই, যা আমাদের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে ইতিবাচক কোনো বার্তা দেয় না।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং ২০০৩ সালে চালু হওয়া এই ১০ শয্যার হাসপাতালটির মূল সমস্যা জনবলসংকট। ১৬টি পদের ১টিতেও স্থায়ী জনবল পদায়ন করা হয়নি। অন্য হাসপাতাল থেকে প্রেষণে এসে মাত্র তিনজন কর্মচারী (একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, একজন মিডওয়াইফ ও একজন আয়া) সপ্তাহে কয়েক দিন করে দায়িত্ব পালন করেন। এটি একটি জরুরি প্রসূতিসেবাকেন্দ্র, যা ২৪ ঘণ্টা চালু থাকার কথা। কিন্তু বিদ্যুৎ নেই, ডাক্তার নেই এবং প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে এর কার্যক্রম এখন প্রায় স্থবির।
হাসপাতালের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় প্রায় তিন মাস ধরে বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন। ফলে পানীয় জলের ব্যবস্থাও নেই। বিনা মূল্যের ওষুধ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে প্রায় ছয় মাস ধরে। এ পরিস্থিতিতে একজন রোগী কীভাবে এখানে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসবেন? যেখানে হাসপাতালের বাইরের সাইনবোর্ডে জরুরি প্রসূতিসেবার জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার কথা লেখা, সেখানে মূল ফটকে তালা ঝোলানো। এটি জনগণের সঙ্গে একধরনের প্রতারণা। হাসপাতালটি চালু না থাকায় মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতাল বা চট্টগ্রাম শহরে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। এতে সময় ও অর্থ—দুটোরই অপচয় তো বটেই, চরম ভোগান্তিরও শিকার হতে হয় মানুষকে।
যে মিডওয়াইফরা এখানে কাজ করছেন, তাঁরা জানান, এখন মাসে মাত্র চার-পাঁচজন প্রসূতি সেবা নিতে আসেন, যেখানে আগে শতাধিক প্রসূতি সেবা পেতেন। নিরাপত্তা প্রহরীরা দুই বছর ধরে বেতন পাচ্ছেন না। তবু নিয়মিত বেতন পাওয়ার আশায় তাঁরা এখনো কাজ করে যাচ্ছেন। এ অসহনীয় দুর্ভোগের কারণ হলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানান, তাঁরা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জনবলসংকটের কথা জানিয়েছেন, কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।
একটি মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে কেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার ধরনা দিতে হবে? জনবল নিয়োগ, কর্মচারীদের বকেয়া বেতন পরিশোধ, বিদ্যুতের ব্যবস্থা কার্যকর করা—সব ধরনের সংকট দূর করতে হাসপাতালটির দিকে আন্তরিক মনোযোগ দেওয়া হবে, সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।