Prothomalo:
2025-07-31@12:40:40 GMT

বাঁধভাঙা বন্যার গল্প

Published: 30th, April 2025 GMT

ইয়েমেনের রাজধানী সানআ থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে মাআরিব শহর। মাআরিবে ছিল সাবা সম্প্রদায়ের বসতি। কোরআনে একটি সুরা আছে, সুরা সাবা। রানি বিলকিস ছিলেন সাবা সম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী। তারা ছিল বণিক জাতি। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ১১০০ সাল থেকে ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ-অঞ্চলে তাদের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের শহরের অবস্থান ছিল দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকায়। নদী-নালা, খাল-বিল কিছুই ছিল না। বাগান ও কৃষিজমিগুলো বড় আকালে পড়ে যেত সময়ে অসময়ে। বৃষ্টির পানি কিংবা পাহাড়ি ঝর্নার ওপর ভরসা করতে হতো। কিন্তু অনেক পানি মরুভূমিতে মিশে গিয়ে নষ্ট হয়ে যেত। কখনো উভয় পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি বন্যার মতো নেমে শহর ভাসিয়ে দিত। দেশের সম্রাটরা উত্তরণের পথ খুঁজতে লাগলেন। আল্লাহ তাদের সহায় হলেন। ইয়েমেনের আশপাশের শহর ও বসতিগুলোতে নির্মাণ তারা করলেন একশোটির বেশি বাঁধ। মাআরিব শহরের দক্ষিণ পাশে ডানে ও বাঁয়ের পাহাড়ের মাঝখানে উজাইনাহ উপত্যকায় প্রায় ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নির্মাণ করলেন এই বাঁধের একটি; যাকে সাদ্দে মাআরিব বা মাআরিব বাঁধ বলা হতো। কেউ বলেছেন এ বাঁধটি ছিল দুই বর্গমাইল, আবার কেউ বলেছেন, বাঁধটি ছিল মূলত ১৫০ ফুট লম্বা ও ৫০ ফুট প্রশস্ত একটি প্রাচীর। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ২/১৫৯)

পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল ও বৃষ্টির পানি জমা হতো বাঁধে। বাঁধের ওপরে-নিচে ও মাঝখানে পানি বের করার তিনটি দরজা ছিল। দরজা দিয়ে সঞ্চিত পানি সুশৃঙ্খলভাবে শহরের লোকজন ও তাদের খেত-খামার এবং পৌঁছানো হতো। প্রথমে ওপরের দরজা, এরপরে মাঝখানের এবং সর্বশেষ নিচের তৃতীয় দরজা খুলে দিয়ে বছরব্যাপী পানির সঙ্কট কাটানো হতো। পরের বছর পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টির পানিতে ভরে উঠত বাঁধ। বাঁধের নীচে পানির আধার নির্মাণ করে বিরাট বিরাট খালের মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন দিকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা ছিল। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃ ১,১০৯)

আরও পড়ুনপৃথিবীর বাদশাহ২১ এপ্রিল ২০২৫

এই বিশাল বাঁধ অন্যান্য বাঁধ থেকে পুরো দেশকে এমনভাবে জলতৃপ্ত করত, চতুর্দিকে শুধু বাগান আর বাগান দেখা যেত। মাইলের পর মাইল সবুজ শ্যামলিমায় ছেয়ে থাকত। চারপাশের খেজুরের বাগানগুলো খেজুরের কাঁদিতে নুইয়ে পড়ত। নানা ধরনের ফলফলাদিতে ভরে উঠত গাছগুলো। সুগন্ধ দ্রব্যসমূহের খেত, তৃণভূমি, দারুচিনি, আগর ও অন্যান্য সুগন্ধযুক্ত বৃক্ষের ঘন উদ্যান এত বেশি সৃষ্টি হয়েছিল যে গোটা এলাকাটি পুষ্পোদ্যান ও স্বর্গে পরিণত হয়েছিল। কাতাদাহ (রা.

) বলেন, কেউ মাথায় খালি ঝুড়ি নিয়ে পথ ধরে গেলে গাছ থেকে পতিত ফলে ঝুড়ি ভরে যেত। (তাফসিরে ইবনে কাসির)। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘সাবার অধিবাসীদের জন্য তো তাদের বাসভূমিতে ছিল নিদর্শন: দুটি উদ্যান, একটি ডানদিকে, অপরটি বামদিকে। (তাদের বলা হয়েছিল, হে সাবার অধিবাসীরা) তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রদত্ত রিজিক ভোগ করো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। উত্তম নগরী ও ক্ষমাশীল প্রতিপালক।’ (সুরা সাবা, আয়াত: ১৫)

সাবা ছিল শান্তিকামী, নিরাপদ ও সুখী রাজ্য। তাদের বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় হতো প্রাসাদ ও অট্টালিকা নির্মাণে। পথঘাট সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল। আরাম-আয়েশ, উন্নতি ও সভ্যতার সব উপকরণ পূর্ণমাত্রাই বিদ্যমান ছিল। শহরে পোকামাকড়, মশা-মাছি ও সাপ-বিচ্ছুর মতো ইতর প্রাণীর নামগন্ধও ছিল না। বাইরে থেকে কোনো ব্যক্তি শরীরে বা কাপড়ে উকুন ইত্যাদি নিয়ে এ শহরে এলেও সেগুলো আপনাই মারা যেত। সাবা থেকে শাম দেশ পর্যন্ত সাত শ গ্রাম আবাদ ছিল। সকাল বেলা এক জনপদ থেকে রওনা হলে দুপুরে আরেক জনপদে পৌঁছা যেত। সেখানে থেকে খেয়েধেয়ে অনায়াসেই অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিল। কোরআনের ভাষায় ‘উত্তম নগরী’ হয়ে উঠেছিল সাবা।

আরও পড়ুনশীতল অগ্নি১৬ এপ্রিল ২০২৫

এত নেয়ামত, সমৃদ্ধি এবং সুখী জীবনের পরও সাবা বাসী আল্লাহর নাফরমানি করল। আল্লাহ তাদের কাছে পথপ্রদর্শক পাঠালেন; যিনি তাদের আল্লাহর ইবাদত করার আদেশ দিলেন এবং কৃতজ্ঞতা আদায় করতে বললেন। তারা মুখ ফিরিয়ে নিল। বাঁধ ভাঙার ভয় দেখানো হলো তাদের। ইবনে কাসির ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহের সূত্রে বলেন, তাদের ধর্মগ্রন্থে লেখা ছিল, বাঁধটি ইঁদুরের মাধ্যমে ধ্বংস হবে। ফলে তারা ইঁদুর নিধনের জন্য বিড়াল পুষতে লাগল। তবে আল্লাহর ইচ্ছাকে রোখার সাধ্য কার? সেই বাঁধে এতই ইঁদুর এলো যে বিড়ালেরা হার মানল। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ইঁদুরগুলো বেশ বড় বড় ছিল এবং বাঁধের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত মাটি নষ্ট করে ফেলেছিল। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃ ১,১০৯)

বিশাল বাঁধ একদিন ভেঙে পড়ল। সেই জলাধার থেকে বেরিয়ে আসা প্রচণ্ড স্রোত, পথিমধ্যে যতগুলো বাঁধ পেয়েছিল সবগুলো ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল। মাআরিব ও আশপাশের ভূভাগকে প্লাবিত করলো। সুশোভিত ও মনোরম উদ্যানগুলোকে ডুবিয়ে দিয়ে নষ্ট করে ফেলল। ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হলো। মানুষ মারা পড়ল। যারা শহর ছেড়ে আগে চলে গিয়েছিল তারা বেঁচে রইল। বন্যার পানি ধীরে ধীরে শুকিয়ে এলো। তখন ওই স্বর্গসম উদ্যানগুলোর জায়গায় পাহাড়ের দুই পাশের উপত্যকার উভয় পাশে ঝাউ গাছের ঝাড়, জংলি বরইয়ের ঝোঁপ ও সারি সারি পিলু গাছ উৎপন্ন হলো। আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু তারা (আল্লাহ্‌র কাছ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিল। কাজেই আমি তাদের বিরুদ্ধে পাঠালাম বাঁধ-ভাঙ্গা বন্যা, আর আমি তাদের বাগান দুটিকে পরিবর্তিত করে দিলাম এমন দুটি বাগানে যাতে জন্মিত বিস্বাদ ফল, ঝাউগাছ আর কিছু কুল গাছ। অকৃতজ্ঞতাভরে তাদের সত্য প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমি তাদের এ শাস্তি দিয়েছিলাম। আমি অকৃতজ্ঞদের ছাড়া এমন শাস্তি কাউকে দিই না। তাদের এবং যেসব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ বর্ষণ করেছিলাম সেগুলোর মাঝে অনেক দৃশ্যমান জনপদ স্থাপন করে দিয়েছিলাম এবং ওগুলোর মাঝে সমান সমান দূরত্বে সফর মনজিল করে দিয়েছিলাম। (আর তাদের বলেছিলাম) তোমরা এ সব জনপদে রাতে আর দিনে নিরাপদে ভ্রমণ করো। কিন্তু তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের সফর-মঞ্জিলগুলোর মাঝে ব্যবধান বাড়িয়ে দাও। তারা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছিল। কাজেই আমি তাদের কাহিনি বানিয়ে ছাড়লাম (যে কাহিনি শোনানো হয়) আর তাদের ছিন্ন ভিন্ন করে দিলাম। এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা সাবা, আয়াত: ১৬-১৯)

আরও পড়ুনস্বজাতিকে বাঁচাতে চাইল যে কাঠমিস্ত্রি১৬ এপ্রিল ২০২৫

বাঁধটি বর্তমান সানআর মাআরিব প্রদেশের বালাখ হিলস এলাকার ওয়াদি আল-আজানায় অবস্থিত। বাঁধের কিছু ধ্বংসাবশেষ এখনো সেখানে আছে বলে ধারণা করা হয়। (দেশ-দেশান্তর, ৩/৩০৯)

রাজ্য হিসেবে সাবার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় দাউদ (আ.)-এর জাবুরে। এ থেকে প্রমাণিত হয় সাবার সমৃদ্ধির যুগের সূচনা হয়েছিল ১ হাজার খ্রিস্টাপূর্বাব্দ। (আজ-জাবুর, ৭২/১০)। সাইয়েদ সুলাইমান নদভির মতে, সাবার উন্নতি ও সমৃদ্ধির সূচনাকাল কিছুতেই ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে নয়। (আল-কুরআনের ভৌগোলিক ইতিহাস, সাইয়েদ সুলাইমান নদভি, অনুবাদ: আবদুস সাত্তার আইনী, খণ্ড: ১, পৃ ৩০৬)

রোমান ইতিহাসবিদদের মতে, সাবার শাসনকাল দুই স্তরে বিভক্ত। প্রত্যেক স্তরের শাসনকাল দুটি ভিন্ন ভিন্ন যুগে বিভক্ত। প্রথম স্তরের প্রথম যুগ খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১১০০ সাল থেকে শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালে এসে শেষ হয়েছে। ধারণা করা হয়, এটা ছিল সাবার শাসনকালের উৎকর্ষের যুগ। সুলাইমান (আ.)-এর যুগের সাবার রানি বিলকিস এই যুগের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। প্রথম স্তরের দ্বিতীয় যুগ খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সাল থেকে শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ সালে এসে শেষ হয়েছে। বাঁধ ভাঙা বন্যা এবং সাবা জাতির বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়া এই যুগের ঘটনা। দ্বিতীয় স্তরের প্রথম যুগ খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ সালে শুরু হয়ে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে এসে সমাপ্ত হয়েছে। দ্বিতীয় স্তরের দ্বিতীয় যুগ ৩০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে শুরু হয়ে ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে এসে শেষ হয়েছে। (কাসাসুল কোরআন, মাওলানা হিফজুর রহমান, অনুবাদ: আবদুস সাত্তার আইনী, খণ্ড: ৯, পৃ ৭২)

লেখক: আলেম

আরও পড়ুনএরা কথা বলতে পারে না১৫ এপ্রিল ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: খ র স টপ র ব ল ক রআন র জন য আল ল হ ম আর ব অন ব দ হয় ছ ল প রথম শহর র

এছাড়াও পড়ুন:

ম্যাস র‍্যাপিড ট্রানজিটের ভূমি অধিগ্রহণে জালিয়াতি, মামলার অনুমোদন

প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণের ৪ কোটি ৭১ লাখ ৭৬ হাজার ৪১৮ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মো. রিয়াজ উদ্দীন নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) দুদকের ডেপুটি ডিরেক্টর আকতারুল ইসলাম (জনসংযোগ) এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঢাকা ম্যাস র‍্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (লাইন-১) অধীন রূপগঞ্জ উপজেলার পিতলগঞ্জ মৌজায় ডিপো এক্সেস করিডোর নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। জালিয়াতির মাধ্যমে মো. রিয়াজ উদ্দীন নামে এক ব্যক্তি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তার ভূমি অধিগ্রহণের নামে সরকারি কোষাগার থেকে ৪ কোটি ৭১ লাখ ৭৬ হাজার ৪১৮ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।

আরো পড়ুন:

ফেনীতে ছাত্র হত্যা: শেখ হাসিনাসহ ২২১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট

নূরের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা, ১২ বছর পর তোলা হলো আবু বকরের দেহাবশেষ

দুদক জানায়, অভিযুক্ত ব্যক্তি রিয়াজ সংশ্লিষ্ট জমির মূল দলিল হারিয়ে গেছে মর্মে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানায় পাঁচটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরবর্তীতে তিনি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে ওই দলিলগুলোর সার্টিফায়েড কপি উত্তোলন করে ভূমি অধিগ্রহণ অফিসে জমা দেন এবং ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলন করেন।

শুধু তাই নয়, ওই রিয়াজের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতারণার প্রমাণও পেয়েছে দুদক। সে তার জমি ইতোপূর্বে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (সোনালী ব্যাংক) কাছে বন্ধক রাখে এবং বন্ধকী দলিল এখনো কার্যকর রয়েছে।

প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করায় মো. রিয়াজ উদ্দীনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১ ধারায় মামলার অনুমোদন করা হয় বলে দুদক জানায়।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ