ইয়েমেনের রাজধানী সানআ থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে মাআরিব শহর। মাআরিবে ছিল সাবা সম্প্রদায়ের বসতি। কোরআনে একটি সুরা আছে, সুরা সাবা। রানি বিলকিস ছিলেন সাবা সম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী। তারা ছিল বণিক জাতি। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ১১০০ সাল থেকে ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ-অঞ্চলে তাদের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের শহরের অবস্থান ছিল দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকায়। নদী-নালা, খাল-বিল কিছুই ছিল না। বাগান ও কৃষিজমিগুলো বড় আকালে পড়ে যেত সময়ে অসময়ে। বৃষ্টির পানি কিংবা পাহাড়ি ঝর্নার ওপর ভরসা করতে হতো। কিন্তু অনেক পানি মরুভূমিতে মিশে গিয়ে নষ্ট হয়ে যেত। কখনো উভয় পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি বন্যার মতো নেমে শহর ভাসিয়ে দিত। দেশের সম্রাটরা উত্তরণের পথ খুঁজতে লাগলেন। আল্লাহ তাদের সহায় হলেন। ইয়েমেনের আশপাশের শহর ও বসতিগুলোতে নির্মাণ তারা করলেন একশোটির বেশি বাঁধ। মাআরিব শহরের দক্ষিণ পাশে ডানে ও বাঁয়ের পাহাড়ের মাঝখানে উজাইনাহ উপত্যকায় প্রায় ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নির্মাণ করলেন এই বাঁধের একটি; যাকে সাদ্দে মাআরিব বা মাআরিব বাঁধ বলা হতো। কেউ বলেছেন এ বাঁধটি ছিল দুই বর্গমাইল, আবার কেউ বলেছেন, বাঁধটি ছিল মূলত ১৫০ ফুট লম্বা ও ৫০ ফুট প্রশস্ত একটি প্রাচীর। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ২/১৫৯)
পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল ও বৃষ্টির পানি জমা হতো বাঁধে। বাঁধের ওপরে-নিচে ও মাঝখানে পানি বের করার তিনটি দরজা ছিল। দরজা দিয়ে সঞ্চিত পানি সুশৃঙ্খলভাবে শহরের লোকজন ও তাদের খেত-খামার এবং পৌঁছানো হতো। প্রথমে ওপরের দরজা, এরপরে মাঝখানের এবং সর্বশেষ নিচের তৃতীয় দরজা খুলে দিয়ে বছরব্যাপী পানির সঙ্কট কাটানো হতো। পরের বছর পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টির পানিতে ভরে উঠত বাঁধ। বাঁধের নীচে পানির আধার নির্মাণ করে বিরাট বিরাট খালের মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন দিকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা ছিল। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃ ১,১০৯)
আরও পড়ুনপৃথিবীর বাদশাহ২১ এপ্রিল ২০২৫এই বিশাল বাঁধ অন্যান্য বাঁধ থেকে পুরো দেশকে এমনভাবে জলতৃপ্ত করত, চতুর্দিকে শুধু বাগান আর বাগান দেখা যেত। মাইলের পর মাইল সবুজ শ্যামলিমায় ছেয়ে থাকত। চারপাশের খেজুরের বাগানগুলো খেজুরের কাঁদিতে নুইয়ে পড়ত। নানা ধরনের ফলফলাদিতে ভরে উঠত গাছগুলো। সুগন্ধ দ্রব্যসমূহের খেত, তৃণভূমি, দারুচিনি, আগর ও অন্যান্য সুগন্ধযুক্ত বৃক্ষের ঘন উদ্যান এত বেশি সৃষ্টি হয়েছিল যে গোটা এলাকাটি পুষ্পোদ্যান ও স্বর্গে পরিণত হয়েছিল। কাতাদাহ (রা.
সাবা ছিল শান্তিকামী, নিরাপদ ও সুখী রাজ্য। তাদের বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় হতো প্রাসাদ ও অট্টালিকা নির্মাণে। পথঘাট সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল। আরাম-আয়েশ, উন্নতি ও সভ্যতার সব উপকরণ পূর্ণমাত্রাই বিদ্যমান ছিল। শহরে পোকামাকড়, মশা-মাছি ও সাপ-বিচ্ছুর মতো ইতর প্রাণীর নামগন্ধও ছিল না। বাইরে থেকে কোনো ব্যক্তি শরীরে বা কাপড়ে উকুন ইত্যাদি নিয়ে এ শহরে এলেও সেগুলো আপনাই মারা যেত। সাবা থেকে শাম দেশ পর্যন্ত সাত শ গ্রাম আবাদ ছিল। সকাল বেলা এক জনপদ থেকে রওনা হলে দুপুরে আরেক জনপদে পৌঁছা যেত। সেখানে থেকে খেয়েধেয়ে অনায়াসেই অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিল। কোরআনের ভাষায় ‘উত্তম নগরী’ হয়ে উঠেছিল সাবা।
আরও পড়ুনশীতল অগ্নি১৬ এপ্রিল ২০২৫এত নেয়ামত, সমৃদ্ধি এবং সুখী জীবনের পরও সাবা বাসী আল্লাহর নাফরমানি করল। আল্লাহ তাদের কাছে পথপ্রদর্শক পাঠালেন; যিনি তাদের আল্লাহর ইবাদত করার আদেশ দিলেন এবং কৃতজ্ঞতা আদায় করতে বললেন। তারা মুখ ফিরিয়ে নিল। বাঁধ ভাঙার ভয় দেখানো হলো তাদের। ইবনে কাসির ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহের সূত্রে বলেন, তাদের ধর্মগ্রন্থে লেখা ছিল, বাঁধটি ইঁদুরের মাধ্যমে ধ্বংস হবে। ফলে তারা ইঁদুর নিধনের জন্য বিড়াল পুষতে লাগল। তবে আল্লাহর ইচ্ছাকে রোখার সাধ্য কার? সেই বাঁধে এতই ইঁদুর এলো যে বিড়ালেরা হার মানল। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ইঁদুরগুলো বেশ বড় বড় ছিল এবং বাঁধের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত মাটি নষ্ট করে ফেলেছিল। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃ ১,১০৯)
বিশাল বাঁধ একদিন ভেঙে পড়ল। সেই জলাধার থেকে বেরিয়ে আসা প্রচণ্ড স্রোত, পথিমধ্যে যতগুলো বাঁধ পেয়েছিল সবগুলো ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল। মাআরিব ও আশপাশের ভূভাগকে প্লাবিত করলো। সুশোভিত ও মনোরম উদ্যানগুলোকে ডুবিয়ে দিয়ে নষ্ট করে ফেলল। ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হলো। মানুষ মারা পড়ল। যারা শহর ছেড়ে আগে চলে গিয়েছিল তারা বেঁচে রইল। বন্যার পানি ধীরে ধীরে শুকিয়ে এলো। তখন ওই স্বর্গসম উদ্যানগুলোর জায়গায় পাহাড়ের দুই পাশের উপত্যকার উভয় পাশে ঝাউ গাছের ঝাড়, জংলি বরইয়ের ঝোঁপ ও সারি সারি পিলু গাছ উৎপন্ন হলো। আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু তারা (আল্লাহ্র কাছ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিল। কাজেই আমি তাদের বিরুদ্ধে পাঠালাম বাঁধ-ভাঙ্গা বন্যা, আর আমি তাদের বাগান দুটিকে পরিবর্তিত করে দিলাম এমন দুটি বাগানে যাতে জন্মিত বিস্বাদ ফল, ঝাউগাছ আর কিছু কুল গাছ। অকৃতজ্ঞতাভরে তাদের সত্য প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমি তাদের এ শাস্তি দিয়েছিলাম। আমি অকৃতজ্ঞদের ছাড়া এমন শাস্তি কাউকে দিই না। তাদের এবং যেসব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ বর্ষণ করেছিলাম সেগুলোর মাঝে অনেক দৃশ্যমান জনপদ স্থাপন করে দিয়েছিলাম এবং ওগুলোর মাঝে সমান সমান দূরত্বে সফর মনজিল করে দিয়েছিলাম। (আর তাদের বলেছিলাম) তোমরা এ সব জনপদে রাতে আর দিনে নিরাপদে ভ্রমণ করো। কিন্তু তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের সফর-মঞ্জিলগুলোর মাঝে ব্যবধান বাড়িয়ে দাও। তারা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছিল। কাজেই আমি তাদের কাহিনি বানিয়ে ছাড়লাম (যে কাহিনি শোনানো হয়) আর তাদের ছিন্ন ভিন্ন করে দিলাম। এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা সাবা, আয়াত: ১৬-১৯)
আরও পড়ুনস্বজাতিকে বাঁচাতে চাইল যে কাঠমিস্ত্রি১৬ এপ্রিল ২০২৫বাঁধটি বর্তমান সানআর মাআরিব প্রদেশের বালাখ হিলস এলাকার ওয়াদি আল-আজানায় অবস্থিত। বাঁধের কিছু ধ্বংসাবশেষ এখনো সেখানে আছে বলে ধারণা করা হয়। (দেশ-দেশান্তর, ৩/৩০৯)
রাজ্য হিসেবে সাবার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় দাউদ (আ.)-এর জাবুরে। এ থেকে প্রমাণিত হয় সাবার সমৃদ্ধির যুগের সূচনা হয়েছিল ১ হাজার খ্রিস্টাপূর্বাব্দ। (আজ-জাবুর, ৭২/১০)। সাইয়েদ সুলাইমান নদভির মতে, সাবার উন্নতি ও সমৃদ্ধির সূচনাকাল কিছুতেই ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে নয়। (আল-কুরআনের ভৌগোলিক ইতিহাস, সাইয়েদ সুলাইমান নদভি, অনুবাদ: আবদুস সাত্তার আইনী, খণ্ড: ১, পৃ ৩০৬)
রোমান ইতিহাসবিদদের মতে, সাবার শাসনকাল দুই স্তরে বিভক্ত। প্রত্যেক স্তরের শাসনকাল দুটি ভিন্ন ভিন্ন যুগে বিভক্ত। প্রথম স্তরের প্রথম যুগ খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১১০০ সাল থেকে শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালে এসে শেষ হয়েছে। ধারণা করা হয়, এটা ছিল সাবার শাসনকালের উৎকর্ষের যুগ। সুলাইমান (আ.)-এর যুগের সাবার রানি বিলকিস এই যুগের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। প্রথম স্তরের দ্বিতীয় যুগ খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সাল থেকে শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ সালে এসে শেষ হয়েছে। বাঁধ ভাঙা বন্যা এবং সাবা জাতির বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়া এই যুগের ঘটনা। দ্বিতীয় স্তরের প্রথম যুগ খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ সালে শুরু হয়ে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে এসে সমাপ্ত হয়েছে। দ্বিতীয় স্তরের দ্বিতীয় যুগ ৩০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে শুরু হয়ে ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে এসে শেষ হয়েছে। (কাসাসুল কোরআন, মাওলানা হিফজুর রহমান, অনুবাদ: আবদুস সাত্তার আইনী, খণ্ড: ৯, পৃ ৭২)
লেখক: আলেম
আরও পড়ুনএরা কথা বলতে পারে না১৫ এপ্রিল ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: খ র স টপ র ব ল ক রআন র জন য আল ল হ ম আর ব অন ব দ হয় ছ ল প রথম শহর র
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা বিভিন্ন দলের
ইরানে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন দল। অবিলম্বে এই হামলা ও গাজায় গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়ে এ বিষয়ে দুনিয়ার শান্তিকামী দেশ ও বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে তারা। গতকাল রোববার পৃথক বিবৃতিতে এসব দলের নেতারা এই দাবি জানান। তারা ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ঘোষণা এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-ইহুদিবাদী ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ ও ইরানের জনগণের পাশে দাঁড়াতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহমুদুল হাসান মানিক ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নুর আহমদ বকুল এক বিবৃতিতে বলেন, বর্তমান সময়ের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তার নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলকে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংকট সৃষ্টি করে রেখেছে। একতরফা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ইরানের রাজনৈতিক সামরিক অগ্রযাত্রাকে রুখতে চেষ্টা করছে। যুদ্ধবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলকে এখনই থামতে হবে। অন্যায়ভাবে ইরানের শিশু-নারী ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর বোমা ও মিসাইল হামলা বন্ধ করতে হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক পৃথক বিবৃতিতে বলেন, ইরানের পরমাণু স্থাপনাসহ গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অঞ্চল লক্ষ্য করে ইসরায়েলের বেপরোয়া ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা রাষ্ট্রীয় ভয়ানক সন্ত্রাসী তৎপরতা। পরিকল্পিত এই হামলা আন্তর্জাতিক সব ধরনের বিধিবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শামিল। জাতিসংঘকেও এরা পুরোপুরি ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করেছে।