বছর দুয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সদ্য প্রাক্তন ছাত্রের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বুঝতে চাইছিলাম, সাড়ে তিন দশক আগের আমার ছাত্রত্বের সময় থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি কতটুকু এগিয়েছে। বুঝলাম, দালান-কোঠায়, টেবিলে টেবিলে ফ্ল্যাটস্ক্রিন এলসিডি কম্পিউটার, এয়ারকন্ডিশন, প্রশস্ত কক্ষ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন, স্বাস্থ্য, বিমা, পরিবহন, সুযোগ-সুবিধা—সবকিছুতে প্রতিষ্ঠানটি দারুণভাবে এগিয়েছে।

প্রশ্ন করেছিলাম, ‘রেজিস্ট্রার ভবনে ছাত্রসেবার মান কতটা উন্নত হয়েছে?’ উত্তরদাতা মন্তব্য করেছিলেন, ‘রেজিস্ট্রার ভবনের নাম পাল্টে “লাঞ্চের পর আসুন ভবন” করা দরকার।’ নানা রকম ছাত্র-হেনস্তা আর দীর্ঘসূত্রতার বয়ান শুনে বুঝলাম, তিন দশকেও ছাত্রসেবার গুণগত উন্নয়ন তেমন একটা হয়নি। বাধ্য হয়ে খুবই সংক্ষেপে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা করছি।

মাস্টার্স শেষ করেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে চেষ্টা করেছিলাম। বৃত্তিসহ নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতে তিনটি নিশ্চিত ভর্তি বাতিল হয়েছে রেজিস্ট্রার ভবনের ‘কল্যাণে’। সে যুগে ই-মেইল ছিল না। বিদেশে ডাকযোগে আবেদন ও যোগাযোগ ছিল দারুণ খরচের। তিনবারের প্রতিবারই সপ্তাহখানেকের সীমাহীন ভোগান্তি। ‘কাল আসুন’, ‘লাঞ্চের পর’, ‘এটা লাগবে, ওটা নেই কেন’ শুনতে থাকলাম।

নীলক্ষেত, নিজের ডিপার্টমেন্ট, ব্যাংক, রেজিস্ট্রার ভবনের এই তলা ওই তলা, এই অফিসার, ওই ডেস্ক। সময়, অর্থ, বোধ-বুদ্ধি ক্ষয়; ভিনদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাখ্যা-কৈফিয়ত আর সময় চাওয়া—সবই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। বন্ধু, স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষীরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘অমুককে ধরো’, ‘তমুককে বলো’, ‘তোমার অমুক শিক্ষক তো শিক্ষকনেতা! উনি বলে দিলে সব ফটাফট হয়ে যাবে’, ‘অমুক ছাত্রনেতা তোমার বন্ধু’। একজন এমনও বলেছিলেন, ‘এসবের মধ্য দিয়েই তো হাজার হাজার ছেলেমেয়ে মাস্টার্স-পিএইচডি করছে! সিস্টেম বুঝলে এক দিনেই সব হবে, না বুঝলে ভুগবে!’ আমার তখন প্রচণ্ড জেদ ও আত্মসম্মানবোধ। না হলে না হবে, ধরাধরি
কখনো করিনি, করবও না। ছাত্রত্ব শেষে একটি এনজিওর গবেষণা শাখায় যোগ দিয়েছি। ফিল্ডওয়ার্কের প্রয়োজনে উত্তরবঙ্গে ছিলাম।

আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ও বিভাগেরই ছাত্রী, আমার পক্ষ হয়ে আরও কয়েক দিন নিষ্ফল গলদঘর্ম হলেন। মূল আলাপ এখানেই। অসংখ্য প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা নিজের কাজটি নিজেই করবেন। জানপ্রাণ দিয়ে একা একাই শেষ চেষ্টাটি করে যাবেন। এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই চোখে পড়ে বিভিন্নজনের ট্রান্সক্রিপ্ট নেওয়ার দুর্বহ অভিজ্ঞতার কথা।

তথ্যপ্রযুক্তির এমনই অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলে ডিজিটাইজেশন ও অটোমেশন কোনো সমস্যাই হওয়ার কথা নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি সেটা চায় না? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কি কখনোই বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেনি? পরিবর্তন আনা হলে এখনো কেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে লিখেই চলেছেন ট্রান্সক্রিপ্ট জোগাড়জনিত বিড়ম্বনার কথা?

তিন দশক আগের আরেকটি অভিজ্ঞতা উল্লেখ করাও দরকার। তখনো গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হয়নি। মার্কসকে গ্রেডিংয়ের সমমান করে দেখাতে হতো। কোর্স নম্বর লেখা থাকত, শিরোনাম নয়। বিদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সমমান দেখিয়ে আবেদনের পর নির্দেশনা পেলাম কোর্সের নাম এবং রেজিস্ট্রার অফিস থেকে প্রত্যয়িত মার্কসের জিপিএ সমমান লাগবে। রেজিস্ট্রার অফিসে গেলাম। ঘুরেফিরে সবার দুটিই ভাষ্য। এক, এভাবেই সবাই নিচ্ছে। দুই, নিজেই যেন ব্যাখ্যা দিয়ে দিই। বললাম, সেটিই করেছি, বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করছে না। উত্তর পেলাম, তাহলে তাদের কিছু করার নেই।

অতীতের ভীতিকর অভিজ্ঞতার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনই করিনি। অন্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে আবেদনসহ নির্ধারিত ফি ও ডাক খরচ পাঠানোর পর আমার ঠিকানাতেই পাঠানো হয়েছে ট্রান্সক্রিপ্টগুলো। বিষয়টি চাকরি-সংক্রান্ত হওয়ায় পিএইচডির ট্রান্সক্রিপ্টই যথেষ্ট বিবেচিত হয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের সুযোগ নেই। যেভাবে চাওয়া হবে, সেভাবেই দলিলপত্র দিতে হবে।

ওই ঘটনার কয়েক বছর পর একদিন নীলক্ষেতে কয়েকটি বই ফটোকপি করাচ্ছিলাম। আমার দুর্গতির গল্প শুনে একজন হেসে কুটিকুটি। তিনি জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের ‘হেনস্তাসেবার’ সুযোগে দুটি বিশাল ‘সেবাগোষ্ঠীর’ জন্ম হয়েছে। এক, নীলক্ষেতের সেবা চক্র। টাকা দিলেই তারা সব করে দেয়—অনুবাদ, সমমান নির্ণয়; চাই কি ফলাফলে এদিক-সেদিক, হুবহু সিল-ছাপ্পড় ইত্যাদি। দুই, রেজিস্ট্রার ভবনের দালাল চক্র। তারা সত্যি সত্যিই সব ঠিকঠাক যে রকম লাগবে, সে রকমটিই করে দেয়, তবে টাকাপয়সা লাগে। বুদ্ধিমানেরা কেউ রেজিস্ট্রার অফিসের ঝক্কিতে যান না। 

বক্তা জানালেন, তিনি অনেককেই চেনেন-জানেন, যাঁরা নীলক্ষেতের সেবা নিয়েই মাস্টার্স-পিএইচডি করে এসেছেন। সন্দেহ হতে লাগল, এই দুই ধরনের দুর্নীতি চক্রের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের ছাত্রসেবার সংস্কার আটকে নেই তো! না হলে অতশত সিন্ডিকেট-সিনেট, সমিতি মিটিং, শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে কীভাবে? খানিকটা ভীতসন্ত্রস্ত হলাম অনেকের ঝুঁকি নেওয়ার কথা শুনে।

ট্রান্সক্রিপ্ট জালের কারণে কানাডা থেকে প্রতিবছর অসংখ্য ছাত্রের ছাত্রত্ব বাতিল হয়, যাঁদের অনেকেই বাংলাদেশি। অ্যাসোসিয়েশন অব রেজিস্ট্রারস অব দ্য ইউনিভার্সিটিজ অ্যান্ড কলেজেস অব কানাডা (এআরইউসিসি) ছাত্রদের ব্যক্তিগত সম্মান ও গোপনীয়তার স্বার্থে নামধাম গোপন রাখলেও বাংলাদেশের ট্রান্সক্রিপ্টকে সন্দেহের তালিকায় রাখে।

আরও পড়ুনহার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বনাম আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত২৯ এপ্রিল ২০২৫

প্রশাসনিক ভবনের অন্যায্যতা দেখেছি আমার ভূতপূর্ব কর্মস্থল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিদেশে দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি করতে হয় ২২ মাসে, ২৪ মাসে নয়। মাস্টার্স শেষে ফেরার পর প্রাপ্য ইনক্রিমেন্টের জন্য আবেদন করলে এই অজুহাতে আমাকে বঞ্চিত করা হয় যে ২৪ মাসে নয়, ২২ মাসে সম্পন্ন করায় এটি পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রি হয়নি।

সম্মানের বদলে অপমান! রেজিস্ট্রার ছিলেন অফিসার থেকে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ব্যক্তি। চিঠিটি পেয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে ভুল ভাঙানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। তাঁর কূপমণ্ডূকতা ও অনড় অবস্থান দেখে এতটাই বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম, আর একটি কথা বলতেও রুচিতে বেধেছে। বুঝলাম, এই জগদ্দল সরবার নয়। আমার পর একই প্রতিষ্ঠান থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও অনেক শিক্ষক একই দৈর্ঘ্যের, একই ফ্যাকাল্টির, একই ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তাঁদের কেউই বঞ্চিত হননি। তাঁদের বঞ্চিত না হওয়ার যোগ্যতা, তাঁরা রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট, ‘সিস্টেম’বান্ধব।

এখন বিশ্বের সব বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে উচ্চশিক্ষার আবেদন নেয়। সাধারণত দুটি বিষয়ে আবেদনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়নির্ভর। এক, বিশ্ববিদ্যালয় আবেদনকারীর পক্ষ হয়ে মূল ট্রান্সক্রিপ্টগুলো (পাঠক্রম-মূল্যায়ন) সরাসরি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়। সিংহভাগ ক্ষেত্রেই আদান-প্রদানটি অনলাইনভিত্তিক। ব্যতিক্রম সামান্য। নিজেরই একটি অভিজ্ঞতা আছে। যুক্তরাষ্ট্রে আমার বর্তমান কর্মস্থলে আবেদনপত্রের শর্তে বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ, রেজিস্ট্রার অফিসের স্বাক্ষর-সিলমোহরসহ সম্প্রতি উত্তোলন করা মূল কপিগুলো (ফটোকপি বা ডিজিটাল কপি) নিজেই সংগ্রহ করে পাঠানোর নির্দেশনা ছিল।

অতীতের ভীতিকর অভিজ্ঞতার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনই করিনি। অন্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে আবেদনসহ নির্ধারিত ফি ও ডাক খরচ পাঠানোর পর আমার ঠিকানাতেই পাঠানো হয়েছে ট্রান্সক্রিপ্টগুলো। বিষয়টি চাকরি-সংক্রান্ত হওয়ায় পিএইচডির ট্রান্সক্রিপ্টই যথেষ্ট বিবেচিত হয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের সুযোগ নেই। যেভাবে চাওয়া হবে, সেভাবেই দলিলপত্র দিতে হবে।

প্রতিবেশী ভারতও এখন শতভাগ অনলাইন পদ্ধতিতে ছাত্রদের সব একাডেমিক তথ্যসহ ট্রান্সক্রিপ্টের আবেদন, যাচাই-বাছাই, সত্যায়ন ও সরবরাহ করে। পদ্ধতিটির নাম ‘ট্রুকপি’। কানাডায় ‘মাইক্রেডস’। এআরইউসিসির মাধ্যমে সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ এই নেটওয়ার্কে যুক্ত। অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় দেশগুলোর নেটওয়ার্ক ‘ডিজিটারি’। যুক্তরাষ্ট্রের প্ল্যাটফর্ম একাধিক—‘ব্যানার’, ‘অ্যালুসিয়ান’, ‘পিপলসফট’, ‘পার্চমেন্ট’। সম্প্রতি এগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও যুক্ত হয়েছে, যা খুব সহজে জাল-ভেজাল শনাক্ত করতে পারে। সমন্বিত প্ল্যাটফর্মটির পরিচিতি এসআইএস বা ‘স্টুডেন্টস ইনফরমেশন সিস্টেম’।

বাংলাদেশের প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র পরিষেবাও প্ল্যাটফর্মনির্ভর। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈশ্বিক নিয়মকানুনের সঙ্গে মিল রেখে ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরি করছে। ফলে গ্র্যাজুয়েটরা এক-দুই দিনের মধ্যে বিদেশে উচ্চশিক্ষার আবেদন করতে পারছেন; নির্ঝঞ্ঝাটে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। তবু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভোগান্তি-বিড়ম্বনা টিকিয়ে রাখছে কেন? 

হেলাল মহিউদ্দীন, ভিজিটিং প্রফেসর, মন্টক্লেয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জ স ট র র ভবন র র জ স ট র র অফ স ন লক ষ ত প এইচড ত হয় ছ অফ স র সমম ন

এছাড়াও পড়ুন:

পরিবেশ-প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারে এখনই যা দরকার

খুব সাধারণ চোখে তাকালেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের বাস্তুতন্ত্র কী পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপকূলীয় ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র, নদী-হ্রদ-বিল ও জলাভূমির মতো স্বাদুপানির বাস্তুতন্ত্র, শালবন, চিরসবুজ বন এবং পার্বত্য এলাকার বনভূমি, অর্থাৎ স্থলজ বাস্তুতন্ত্র, পাহাড়ি অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র এবং মনুষ্যসৃষ্ট বাসস্থান, যেমন গ্রাম, শহর ও কৃষিজমি—সবই এখন প্রাকৃতিক পরিবর্তনের চেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়েছে মানুষের আচরণের কারণে।

অতিরিক্ত মাছ ধরা, প্লাস্টিক ও পলিথিনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার অভাব, রাসায়নিক ও তেলের দূষণ, বন ধ্বংস, অব্যবস্থাপনায় বনজ সম্পদের অপচয়, পাহাড় কাটা, প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস, গাছ-মাছ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বহিরাগত প্রজাতির আগমন, পর্যটন ও উন্নয়নের নামে ব্যয়বহুল প্রকল্প—এসব মিলেই বাস্তুতন্ত্রে নেতিবাচক পরিবর্তন আসছে। এটি এখন প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবর্তনের চেয়েও ভয়াবহ।

এ ধরনের ক্ষয় ঠেকাতে এখনই শক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি, গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্ষতির ধরন বুঝে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। আমাদের যা হারিয়েছি, তা আর হারাতে দেওয়া যাবে না। এটা হওয়া উচিত জাতিগতভাবে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না বাস্তুতন্ত্রের জীব ও জড় উপাদান একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। শক্তিপ্রবাহ, পুষ্টিচক্র, প্রজাতিগুলোর আন্তসম্পর্ক বাস্তুতন্ত্রকে কার্যকর রাখে। সুতরাং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা না করা মানেই আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের ঝুঁকিতে ফেলা। প্রাকৃতিক উপায়ে খাদ্যনিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার (ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন) একটি কার্যকর পথ। তবে এটি সহজ কিংবা তাৎক্ষণিক কোনো কাজ নয়, এটি সম্পন্ন করতে হলে আমাদের অর্থনীতি, কৃষি, খাদ্যাভ্যাসসহ জীবনযাত্রার নানা দিকেই পরিবর্তন আনতে হবে। এর সৌন্দর্য হলো এটি যেকোনো স্কেলে ঘটতে পারে এবং এতে সবারই ভূমিকা রয়েছে।

পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার মানে শুধুই গাছ লাগানো নয়। আমরা অনেকেই ভাবি, গাছ লাগানো মানেই পরিবেশ বাঁচানো। বাস্তবে শুধু গাছ লাগানোই যথেষ্ট নয়, কী গাছ লাগানো হচ্ছে, সেটা দেশি কি না, কোথায় লাগানো হচ্ছে, গাছের উপযুক্ত যত্ন হচ্ছে কি না—এসব বিবেচনাও গুরুত্বপূর্ণ। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো বাস্তুতন্ত্র কীভাবে কাজ করে তা বোঝা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।

সব সময় একটি পরিবেশকে তার অতীত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বা উচিতও নয়। যেমন আগে যেসব অঞ্চল বনভূমি ছিল, এখন সেগুলোর একটি বড় অংশ কৃষিজমি বা বসতিতে পরিণত হয়েছে। পরিবেশকে বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে, ঠিক যেমন সমাজ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াচ্ছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউনেপ) তথ্যমতে, ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে যদি ৩৫ কোটি হেক্টর ভূমি ও জলজ বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা যায়, তবে বিশ্ব প্রায় ৯ ট্রিলিয়ন ডলারের পরিবেশগত সেবা পেতে পারে এবং ১৩ থেকে ২৬ গিগাটন গ্রিনহাউস গ্যাস কমাতে পারে। এ অর্থনৈতিক লাভ বিনিয়োগের তুলনায় ৯ গুণ বেশি। অন্যদিকে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার ক্ষতি তিন গুণ বেশি।

বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা সম্ভব সব ক্ষেত্রেই—বন, কৃষিজমি, শহর, জলাভূমি ও সাগর পর্যন্ত। উদ্যোগ নিতে পারে সরকার, উন্নয়ন সংস্থা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, স্থানীয় কমিউনিটি এমনকি ব্যক্তিপর্যায়ের মানুষও। কারণ, ক্ষতির ধরন বহুমাত্রিক এবং এর উৎসও বিভিন্ন। বস্তুত পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার মানে একটি সার্বিক পরিবর্তন—শুধু প্রকৃতির নয়, আমাদের আচরণেরও। এটা রোগনিয়ন্ত্রণ, জীবিকা রক্ষা, দুর্যোগ মোকাবিলা, এমনকি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজিস) অর্জনের সঙ্গেও সরাসরি জড়িত।

জাতিসংঘ ঘোষিত ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের দশক (ইউএন ডকেড অন ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন) আমাদের আহ্বান জানায়, যাতে আমরা ইকোসিস্টেমের, অর্থাৎ পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষয় রোধ করি, ধ্বংস থামাই ও পুনরুদ্ধারে সক্রিয় হই। এত দিন ধরে আমরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ আমাদের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে পরিবেশ ও প্রতিবেশের যে ক্ষতি করেছি, তা পুনরুদ্ধারের জন্য বিশ্বের সব কটি রাষ্ট্র আগামী এক দশক (২০২১-২০৩০) ধরে চেষ্টা করবে। এটি একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক জলবায়ু সমাধান (ন্যাচারাল ক্লাইমেট সলিউশন), যা অভিযোজন ও প্রশমনে সহায়তা করে এবং আমাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই পথ তৈরি করবে।

প্যারিস চুক্তি ও জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার (ন্যাপস) আওতায়, দেশগুলো তাদের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানে পরিবেশ পুনরুদ্ধার অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এ ছাড়া আরইডিডি+, অর্থাৎ ‘রেড’ হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বন ধ্বংস ও বন নষ্ট হওয়া থেকে কার্বন নিঃসরণ কমানো। আর ‘+’ চিহ্নটি বোঝায় অতিরিক্ত কিছু বন-সম্পর্কিত কাজ, যেমন বনের ভালোভাবে দেখাশোনা করা, আর বনের কার্বন ধরে রাখা ও বাড়ানো, যেগুলো জলবায়ু রক্ষা করতে সাহায্য করে। ফলে রেড‍+ এর আওতায় বন সংরক্ষণ ও কার্বন মজুতের উন্নয়ন সম্ভব। তবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থায়ন, যা এখনো সীমিত। এ ক্ষেত্রে ‘ব্লেন্ডেড ফাইন্যান্স’ (সরকারি-বেসরকারি যৌথ অর্থায়ন) নিয়ে আলোচনা হলেও বাস্তবে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে আমরা অনেক সময় ধরে একটা চক্রেই যেন আটকে আছি—পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারের সমস্যার সমাধান শুধু গাছ লাগানোর মধ্যেই যেন আমরা খুঁজে পাচ্ছি! তা–ও বলা বাহুল্য যে যথোপযুক্ত উপায়ে নয়।

যা হোক, আমরা যদি বাস্তুতন্ত্রকে সত্যিকার অর্থে পুনরুদ্ধার করতে চাই, তবে শুধু গাছ লাগানো নয়, পুরো বাস্তুতন্ত্রের প্রেক্ষাপট বুঝে কাজ করতে হবে। সময় খুব কম। এখনই উদ্যোগ না নিলে ক্ষতির মাত্রা এমন জায়গায় পৌঁছাবে, যেখান থেকে ফেরা আর সম্ভব হবে না।

সম্প্রতি জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) সহায়ক সংস্থার ৬২তম অধিবেশনে (এসবি–৬২) অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। জার্মানির বন এ অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে কপ–৩০ (২০২৫) সম্মেলনের আগে অভিযোজন ও অর্থায়ন ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট তুলে ধরার ও এ দৃষ্টিকোণও তুলে ধরা সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের অভিজ্ঞতা ও যৌক্তিক দাবিগুলো তুলে ধরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে শুধু আন্তর্জাতিক ফোরামে কথা বললেই চলবে না। এখন দরকার বাস্তবায়ন, অর্থায়ন ও আমূল আচরণগত পরিবর্তন। পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারের ঘোষিত দশকের (২০২১-২০৩০) মধ্যভাগে এসে আমাদের নিজেদের জিজ্ঞাসা করা উচিত, আমরা কি সত্যিই এগোচ্ছি? পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারকে যদি আমরা সত্যিকার অর্থে গুরুত্ব না দিই, তাহলে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা রেখে যাব এক অস্থির, বিপন্ন ও অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ।

বিধান চন্দ্র পাল প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রভা অরোরা, ন্যাশনাল অপারেটর, ফাউন্ডেশন ফর এনভায়রনমেন্টাল এডুকেশন (এফইই), বাংলাদেশ এবং চেয়ার, মেইক এ ডিফারেন্স উইক সেলিব্রেশন গ্লোবাল কমিটি, সোসাইটি ফর ইকোলজিক্যাল রেস্টোরেশন (এসইআর)।

[email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পরিবেশ-প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারে এখনই যা দরকার