‘মানবিক করিডরের’ কারণে আধিপত্যবাদী শক্তির চক্রান্তের শিকার হতে পারে বাংলাদেশ: বাম গণতান্ত্রিক জোট
Published: 30th, April 2025 GMT
মিয়ানমারের রাখাইনে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্পর্শকাতর বিষয় বলে মনে করে বাম গণতান্ত্রিক জোট। এর ফলে বাংলাদেশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদসহ সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী শক্তিগুলোর যুদ্ধ–চক্রান্তের শিকার হতে পারে। অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত বাতিল করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা।
আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনে বাম গণতান্ত্রিক জোটের অস্থায়ী কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এ আহ্বান জানানো হয়। পরে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
সভার এক প্রস্তাবে বলা হয়, আরাকানে মানবিক করিডর দেওয়ার সিদ্ধান্ত একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এ ধরনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দেশের নিরাপত্তা, সামরিক ঝুঁকি, সার্বভৌমত্ব, ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অবস্থান যুক্ত। প্রতিটি বিষয় গভীর পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে ঐকমত্য ছাড়া এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে সরকার একক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না
সভায় চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল হ্যান্ডলিংয়ের কাজ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। এর সঙ্গে শুধু বাণিজ্যিক লেনদেন নয়, দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন যুক্ত। বন্দরের তত্ত্বাবধানে টার্মিনালটি গত ১৭ বছর লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। তাই এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান জোটের নেতারা।
এ ছাড়া সভায় কাতারের বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলে সমরাস্ত্রের যন্ত্রাংশ তৈরির খাতে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানানোর বিরোধিতা করা হয়। এ বিষয়ে জোটের নেতারা বলেন, সরকারের এ ধরনের ব্যবসায়ী উদ্যোগ বাংলাদেশকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলবে। বিদেশি কোনো দেশের সমরাস্ত্রের যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা বাংলাদেশে হতে পারে না।
মে দিবসের চেতনা ধারণ করে শ্রমিকদের মজুরি, মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বেগবান করতে সারা দেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রতি আহ্বান জানানো হয় সভায়। একই সঙ্গে নিবর্তনমূলক বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ করে শ্রমিকনেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ এবং অবিলম্বে বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে সভা থেকে।
বাম জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদের সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, বাসদের (মার্ক্সবাদী) কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মাসুদ রানা, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টির নির্বাহী সভাপতি আবদুল আলী, বাসদের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নিখিল দাস, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য শহীদুল ইসলাম প্রমুখ।
আরও পড়ুনচট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালে সবই আছে, তবু কেন বিদেশির হাতে যাচ্ছে ২৬ এপ্রিল ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
শ্রম অধিকার ও সুস্থ কর্মপরিবেশ
আজ মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারী মেহনতি মানুষদের স্মরণ করিবার দিন। তৎসহিত সকল শ্রমজীবী মানুষের জন্য মর্যাদাকর জীবন নিশ্চিতকরণের সংগ্রামে নূতন শপথ গ্রহণের দিন।
মে দিবস বিশ্বের শ্রমিকদের সংহতি যদ্রূপ বৃদ্ধি করিয়াছে, তদ্রূপ তাহাদিগকে অধিকার সচেতনও করিয়াছে; প্রেরণা জোগাইয়া চলিয়াছে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে। মে দিবস বাংলাদেশসহ বিশ্বের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়া স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশসমূহের জন্য বিপুল প্রেরণার উৎসরূপে কাজ করিয়াছে।
তাহারই প্রতিফলনস্বরূপ এই সকল দেশে ছুটিসহকারে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হয়। উন্নত দেশসমূহ এই দিবসে পৃথক ছুটির ব্যবস্থা না করিলেও উহার প্রভাব উপেক্ষা করিতে পারে নাই। তাই ভিন্ন প্রকারে সেই সকল দেশেও দিবসটি পালিত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে আজিকে শ্রমমান লইয়া যে আলোচনা হয়, জাতীয় ন্যূনতম মজুরিসহ শ্রমিকের বহু অধিকার আজিকে যে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বহু দেশে কার্যকর হইয়াছে, উহারও পশ্চাতে রহিয়াছে মে দিবসের চেতনা। তবে ইহা সত্য, বাংলাদেশে ঘটা করিয়া দিবসটি পালিত হইলেও মজুরি ও কর্মপরিবেশ প্রশ্নে খামতি সীমাহীন। প্রাতিষ্ঠানিক খাতসমূহে শ্রমিকদের জন্য এক প্রকার আইনি আশ্রয় থাকিলেও বিশাল অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে উহার লেশমাত্র নাই। শেষোক্ত খাতে কোটি কোটি শ্রমিক উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও অন্যান্য অধিকার হইতে বঞ্চিত।
এই বৎসর শ্রমিক দিবস এমন সময়ে উপস্থিত, যখন গণঅভ্যুত্থানের ফসলস্বরূপ দেশে নূতন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছে। সেই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসাবে শ্রম খাতের সংস্কারেও উদ্যোগী। তাহাদের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে প্রতিবেদনও দাখিল করিয়াছে, যথায় দেশের সাড়ে সাত কোটি শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক অধিকার-সংক্রান্ত একগুচ্ছ সুপারিশ রহিয়াছে। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক, সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নিয়োজিত সকল শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ ন্যূনতম মানদণ্ডরূপে বিবেচিত হইবে– কমিশনের এই সুপারিশ যুগান্তকারী বলিয়া আমরা মনে করি। উপরন্তু কমিশন ইহাও বলিয়াছে, কোনো খাতের মজুরি কাঠামো নির্ধারণে পরিবারে একক উপার্জনকারী হিসাবে বিবেচনায় লইয়া এমন পরিমাণ নির্ধারণ করিতে হইবে, যাহাতে শ্রমিক তাঁহার পরিবারের প্রয়োজন মিটাইতে পারেন।
বিভিন্ন খাতের শ্রমিকের মজুরি তিন বৎসর অন্তর মূল্যায়ন ও পুনর্নির্ধারণ, মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য আপৎকালীন তহবিল, ট্রেড ইউনিয়ন করিবার শর্ত শিথিল, স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ, নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস এবং স্থায়ী শ্রম কমিশন প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত সুপারিশসমূহও প্রণিধানযোগ্য। একটা সময় ছিল যখন শ্রমিক আন্দোলন বলিতে কারখানা ভাঙচুর ও সম্পদ ধ্বংস বোঝাইত। পরিণামে নিজের রুটি-রুজি লইয়া শ্রমিকদেরই টানাপোড়েনে পড়িতে হইত। ইহার সমাধান দিয়াছিল ট্রেড ইউনিয়ন প্রথা। দুর্ভাগ্যবশত এই দেশে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার বিগত দশকসমূহে ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করে। উহার সহিত সুস্থ ধারার শ্রমিক আন্দোলনও বিরল হইয়া পড়ে।
আমাদের বিশ্বাস, শ্রম সংস্কার কমিশনের ট্রেড ইউনিয়ন-সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ আলোর মুখ দেখিলে শ্রমিক-মালিক উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা হইবে। সর্বোপরি দেশের বিকাশমান শিল্প খাত হইবে লাভবান। উৎপাদন ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তিরূপে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে উদ্যোক্তার যদ্রূপ অবদান, তদ্রূপ শ্রমিকেরও অবদান ব্যাপক। তাই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণে আর কোনো অবহেলা নহে। এইবারের মে দিবসে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করিবে– ইহাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা সমকালের পক্ষ হইতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শ্রমজীবী মানুষকে মে দিবসের অভিনন্দন জানাই।