প্রতিদিন মাত্র একটি ডুমুর খেলেই যে ৭ উপকার পাবেন
Published: 9th, May 2025 GMT
ছবি: প্রথম আলো
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ভ্যানওয়ালা, বাইকার আর ব্যাটারি রিকশা: সমস্যা না সম্ভাবনা?
ইদানীং ঢাকা শহরে বাইকার, ব্যাটারি রিকশাচালক ও ফেরিওয়ালার আধিক্য অনেকেরই চোখে ধরা পড়ে। এই তিন ধরনের কর্মজীবী মানুষের অধিকাংশই ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন। একটু বাড়তি আয়ের আশায়, নদীভাঙনে ভিটেহারা, ভূমিহীন, মৌসুমি বেকার, উচ্চশিক্ষিত বেকার ইত্যাদি নানা কারণে, নানা ধরনের মানুষ মহানগরে ভিড় বাড়াচ্ছেন। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে এখন ঢাকা মহানগরের পরিবেশ বিপন্ন। ২০২৪ সালের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, পরিবেশদূষণে ঢাকার অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়।
ভাড়ায়চালিত সংখ্যাতিরিক্ত মোটরবাইকের উপস্থিতি নগরীর যানজট প্রকট করে তুলছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনা। দুই কোটি নগরবাসীর গণপরিবহনের চাহিদা মেটাতে বড় বাস ও মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের সুপারিশ করা হচ্ছে। অথচ সেখানেই মাত্র একজন যাত্রী পরিবহনের উপযোগী মোটরবাইক মহানগরের পরিবহনব্যবস্থাকে আরও দুর্বিষহ করে তুলছেন। বিশ্বের জনবহুল মেট্রোশহরে যেখানে বাইকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, সেখানে আমাদের নগর প্রশাসন অনেকটা নীরবেই অন্যান্য বাহনের সঙ্গে বাইকের সহাবস্থান সহ্য করে নিচ্ছেন।
ব্যাটারি–চালিত রিকশার সংখ্যা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো প্রতিদিন বাড়ছে। এই রিকশার আধিক্যে এখন পায়ে চালানো রিকশা প্রায় দেখাই যায় না। ব্যাটারি রিকশায় চালকের আসনব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণে প্রতিদিন কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে। তা ছাড়া ব্যাটারি রিকশার গ্যারেজগুলোতে অবৈধ বিদ্যুৎ–সংযোগ দিয়ে ব্যাটারি চার্জ করা হয়। আগামী গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের চাহিদা যখন বাড়বে, তখন লোডশেডিং-এ এর প্রভাব পড়বার শঙ্কা রয়েছে। ফলে বৈধ ও নিয়মিত বিল পরিশোধকারী বিদ্যুতের গ্রাহকেরা গরমে নাকাল হবেন।
এদিকে রাজপথ থেকে রাজধানীর প্রায় প্রতিটি অলিগলি এখন ফেরিওয়ালাদের নিয়ন্ত্রণে। আড়ত থেকে পাইকার হয়ে কয়েক হাত বদল হয়ে পণ্য ওঠে ফেরিওয়ালাদের ভ্যানে। ফলে খুচরা পর্যায়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অন্যতম কারণ ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালা। বাজারে যাওয়ার পরিবহন খরচ বাঁচাতে গিয়ে নগরবাসী অনেক সময় এঁদের থেকে পণ্য কিনে প্রতারিতও হচ্ছেন।
দূষণ, খাদ্যে ভেজাল, বস্তির নিম্নমানের আবাসন, যানজটসহ নানা সমস্যার পরও বাইকার, রিকশাচালক ও ফেরিওয়ালারা প্রতিদিন নগরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেছেন। কিন্তু কেন? মহানগরে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি, মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেশি। এ জন্য কর্মজীবী মানুষেরা বেশি আয়ের আশায় গ্রাম থেকে শহরে ছুটে আসেন।
বাইকারদের অধিকাংশই শিক্ষিত। প্রয়োজনীয় পেশাদারি দক্ষতা ও কাঙ্ক্ষিত চাকরির সুযোগ না থাকায় শিক্ষিত বেকাররা পারিবারিক সাহায্য বা কিস্তির সুবিধা নিয়ে মোটরবাইক কেনেন। গ্রামে সবাই সবাইকে চেনেন। শিক্ষিত হয়ে চাকরি না পাওয়া এবং মোটরবাইক চালনা পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া আমাদের গ্রামীণ সমাজে এখনো অবমাননাকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ জন্য গ্রামীণ উচ্চশিক্ষিত বেকারদের একটি বড় অংশ এলাকার মানুষদের কটাক্ষ থেকে রেহাই পেতে মহানগরে বাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। এখানে কেউ কাউকে নিয়ে মাথা ঘামান না।
গ্রামীণ শিক্ষিত বেকার যুবকদের একাংশ পারিবারিক সহায়তা বা ঋণ নিয়ে আজকাল ব্যাটারি রিকশা কিনছেন। গ্রামাঞ্চলে বা ছোট শহরে আয় কম বলে তাঁরা বেশি আয়ের আশায় মহানগরে ভিড় বাড়াচ্ছেন। ফলে বাড়ছে ব্যাটারি রিকশা, বাড়ছে যানজট। গ্রামীণ বেকারদের আরেকটি অংশ স্বল্প পুঁজি নিয়ে রাস্তার ধারে ভ্যান বা চৌকি বসিয়ে শাকসবজি, ফল-ফুল থেকে প্রায় সব পণ্যই বিক্রি করছেন।
ঢাকা শহরে প্রতিদিন ফেরিওয়ালারা কত কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেন, তার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে কিছু ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করে প্রাক্কলন করা যায় যে ঢাকা মহানগরের ফেরিওয়ালাদের সম্মিলিত বাৎসরিক বিক্রয় কয়েক বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ।
ব্যাটারি রিকশা ও বাইকারদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবীদের সংখ্যা হিসাবে যোগ করলে দেখা যাবে, জিডিপিতে তাদের বিশাল অবদান রয়েছে। আবার এসব অবৈধ ও অনিবন্ধিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জিইয়ে রাখতে চাঁদাবাজি, দখলদারি, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে কালো টাকার যে বিশাল লেনদেন পরিচালিত হয়, তার অঙ্কও কম নয়।
বেকারত্ব দারিদ্র্য সৃষ্টি করে। দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে মানুষ এমন অনেক পেশা বেছে নেন, যেগুলো আবার পরিবেশ দূষিত করে। সুতরাং বেকারত্বের সঙ্গে দারিদ্র্য ও দূষণের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বেকাররা একসময় পরিবার ও সমাজের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়ান। হতাশায় নিমজ্জিত বেকারদের মাদক গ্রহণ, মাদক পাচার, অনৈতিক ব্যবসা ও সন্ত্রাসের মতো সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। সেদিক দিয়ে বিচার করলে রাইডার, ব্যাটারি রিকশাচালক ও ফেরিওয়ালারা ইতিবাচক ও উৎপাদনমুখী কাজ করে পরিবার ও অর্থনীতিকে সচল রাখছেন।
একজন বেকার মাদকের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হালাল উপার্জন করে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন, চিকিৎসাসহ সব খরচ মেটাচ্ছেন, এটা অবশ্যই প্রশংসনীয় বিষয়। আমাদের উচিত, এ রকম জীবনযোদ্ধাদের উৎসাহিত করা, সম্মান করা।
কিন্তু গ্রামীণ বেকার জনগোষ্ঠী যদি রাজধানীতে অভিবাসন অব্যাহত রাখেন, তবে আর কয়েক দশকের মধ্যেই ঢাকার পতন ঘটবে। ঢাকা এই বিশাল জনসংখ্যা আর ধারণ করতে পারবে না। পানীয় জল, পয়োনিষ্কাশন, গণপরিবহন, বিদ্যুৎ সঞ্চালন, জ্বালানি, নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ সব নাগরিক অবকাঠামো ভেঙে পড়বে। ভবিষ্যতের ঢাকার জন্য চরম সংকট অপেক্ষা করছে। নগরবাসীর ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত সিটি করপোরেশনের নগরবিদেরা এবং নগরপিতারা কি অশনিসংকেত শুনতে পারছেন? নাকি জলাশয় ভরাট করে, প্রকৃতিকে বিপন্ন করে নগরকে আরও বর্ধিত করার পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত আছেন?
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেখানে বেশি ঘটবে, সেখানেই শ্রমের চাহিদা সৃষ্টি হবে। আর চাহিদা থাকলে জোগান আসবেই। বেকারত্ব বাংলাদেশের অন্যতম বড় সমস্যা। দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে গ্রামীণ জনপদের উচ্চশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষ কাজের আসায় ঢাকায় ছুটে এসেছে। এই বিশাল আকারের জনগোষ্ঠীকে সীমিত জায়গায় ঠাই করে দিতে গিয়ে নগরের পরিবেশ প্রতিদিন বিপন্ন হচ্ছে।
আজকে ঢাকা যে মহাসংকটের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে, তার মূল কারণ রাজধানী কেন্দ্রিক উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা। অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিকেন্দ্রীকরণ না করার কুফল এখন আমরা ভোগ করছি। এখনো যদি গ্রামকেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেখানে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা না হয়, তবে নগরমুখী জনস্রোত বন্ধ হবে না, ঢাকার পতনও ঠেকানো যাবে না।
শ্রমের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থায় শ্রমকে অত্যন্ত অবমূল্যায়ন করা হয়। মেধা খাটিয়ে, শ্রম দিয়ে, নৈতিকতার সঙ্গে উপার্জনের উৎসাহ আমাদের সমাজ দেয় না। সে জন্য আমাদের তরুণ-তরুণীরা ইংরেজদের ফেলে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থায় লেখাপড়া করে সাহেব হতে চান। টেবিলে বসে কলমের খোঁচায় অর্থ উপার্জন করতে চান। এ জন্য সবাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে উৎসাহী। রাষ্ট্রও একটি উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করে রেখেছে, যার সঙ্গে কর্মমুখী ও বাজারমুখী দক্ষতার বিশাল ব্যবধান রয়েছে। ফলে প্রতিবছর লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে; কিন্তু প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মী তৈরি হচ্ছে না। দক্ষ কর্মীর অভাব পূরণে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনতে হচ্ছে। এটা কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দীনতার বহিঃপ্রকাশ নয়? এই অব্যবস্থাপনা থেকে কি বের হওয়ার পথ বের করা উচিত নয়?
দেশের বিশাল শ্রমশক্তিকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়ে কৃষি, শিল্প ও সেবাভিত্তিক করতে হবে। কারিগরি শিক্ষাকে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে হবে। একটি সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপরীতে দুটি করে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিশ্বমানের দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে হবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন হওয়ার জন্য গ্রামীণ যুবশক্তিকে কৃষি উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করতে হবে।
গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নত হলে কৃষি উৎপাদন ও বিপণন সহজ হবে। কৃষি উদ্যোক্তারা গ্রামে বসেই ভালো আয় করবেন। ফলে শহরমুখী মানুষের ঢল কমবে। কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর জোড় দিতে হবে, এতে বিশ্ববাজারে আমাদের দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়বে। উচ্চশিক্ষা কেবল মেধাবীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
এ জন্য সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতেও কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সব বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে কর্মমুখী উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্স–নির্ভর উৎপাদনমুখী কোর্স চালু করতে হবে। শিক্ষা যেন নৈতিকতা, শৃঙ্খলা, নিষ্ঠা, শিষ্টাচার ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে, দ্রুত সেই কৌশলপত্র তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।
ড. শায়খ আহমদ লেখক, গবেষক, সহকারী অধ্যাপক (অ্যাডজান্ট ফ্যাকাল্টি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]