কমরেড হায়দার আকবর খান রনো ছিলেন আমার কাছে রনো কাকু। আমার বাবা কমরেড আজিজুর রহমান দীর্ঘদিন রনো কাকুর সঙ্গে ওয়ার্কার্স পার্টির শীর্ষ ফোরাম পলিটব্যুরোতে থাকার কারণে আমাদের পরিবারের সঙ্গে তাঁর অকৃত্রিম ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেই ঘনিষ্ঠতা কাকুর পরিবারের সঙ্গেও একই মাত্রায় বজায় ছিল। রনো কাকুর মা কানিজ ফাতিমা মোহসিনা ছিলেন এই ঘনিষ্ঠতার মূল অনুঘটক। যখনই তাদের বাসায় গিয়েছি বা দিনের পর দিন থেকেছি, তাঁর স্নেহের ঘাটতি পাইনি। রনো কাকুর একমাত্র মেয়ে রানা আপাও ছিলেন একসময়কার ছাত্রমৈত্রীর কেন্দ্রীয় নেতা। জামাতা রাজু ভাইও ছিলেন আমাদের কেন্দ্রীয় নেতা। এ ছাড়া রনো কাকুর ছোট ভাই হায়দার আনোয়ার খান জুনো ও তাঁর পরিবার একই সংগ্রামের সহযাত্রী হওয়াতে ঘনিষ্ঠতার পরিধি পুরো পরিবার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
সম্ভবত ১৯৯৪ সালের মাঝামাঝি আমি প্রথম কমরেড রনোর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে আসি। তখন বরিশাল ক্যাডেট কলেজে সবে ভর্তি হয়েছি। ছুটিতে বাবার সঙ্গে ঢাকায় এসেছি। তখন ওয়ার্কার্স পার্টির মধ্যে ১১ জনের পার্টির সুবিধাবাদী ঝোঁকের বিরুদ্ধে আলাদা অবস্থান ছিল। তাদের সঙ্গে রনো কাকু মাঝে মাঝে যুক্ত হতেন। এ রকম একটি যুক্ততার সভা বসেছিল রনো কাকুর ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাসায়। বাবা আমাকে বাসার বারান্দাতে বসিয়ে রেখে সভায় অংশ নিয়েছেন। বারান্দাতে বসে ছিলেন রনো কাকুর বাবা প্রকৌশলী হাতেম আলী খান। তিনি আমার সঙ্গে অনেক সময় ধরে গল্প করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে তখন প্রথম জানতে পেরেছিলাম নওশের আলী খানের কথা। অবিভক্ত বাংলার কিংবদন্তি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নওশের আলী ছিলেন রনো কাকুর নানা। দেশভাগকে মানতে না পেরে পূর্ববঙ্গের নড়াইলের সন্তান ওপার বাংলার রাজনীতিতে স্থায়ী হন। এ রকম একটি একরোখা প্রগতিশীল চিন্তার উত্তরাধিকার এ দেশের রাজনীতিতে বহন করে চলেছিলেন হায়দার আকবর খান রনো।
কমরেড রনোর সবচেয়ে বড় কীর্তি এ দেশের মার্ক্সবাদী তত্ত্ব গঠনে ভূমিকা। তাঁর সাহিত্যরসসমৃদ্ধ ও সহজবোধ্য মার্ক্সীয় তত্ত্ব রচনাশৈলীর তুলনা এখানে প্রায় বিরল। বিশেষ করে ছোট ছোট বাক্যে রচিত তাঁর লেখা সুখপাঠ্যের অনুভূতি দেয়। আমাদের রাজনীতি চর্চায় তাঁর গ্রন্থ ‘মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম’, ‘সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর’, ‘মার্কসীয় অর্থনীতি’ বেশ কাজে এসেছিল। ‘ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব’, ‘পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা’ এককথায় অনন্য। বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত তাঁর আত্মজীবনী ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ও এক অসাধারণ দলিল। আমি এই বইয়ের একটা বড় রিভিউ লিখেছিলাম সাখাওয়াত টিপুর অনুরোধে। রনো কাকু আমার এই রিভিউ পড়ে নাকি প্রশংসা করেছিলেন। বামপন্থি ছাত্র রাজনীতি করার সময় কমিউনিস্ট রাজনীতির প্রবেশিকা হিসেবে ‘গ্রাম শহরের গরীব মানুষ জোট বাঁধো তৈরি হও’ বেশ কার্যকর মনে হতো। আমার প্রয়াত বাবা কমরেড আজিজুর রহমান যখন ওয়ার্কার্স পার্টির গণপ্রকাশনের দায়িত্ব নেন তখন রনো কাকুকে দিয়ে বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বই লিখিয়েছিলেন। আবার এক সময় পার্টির শিক্ষা সিরিজের বইগুলো আমাদের প্রাথমিক মার্ক্সবাদ শিক্ষায় বেশ কাজে এসেছিল। আবার আমরা যখন ওয়ার্কার্স পার্টি পুনর্গঠিত করি তখন তাঁর ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকতাম। সেখানে ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মহামন্দার ওপর কর্নারস্টোন পাবলিকেশন এবং মান্থলি রিভিউ প্রেসের বেশ কয়েকটি বই আমি সংগ্রহ করি। রনো কাকু সেগুলো দেখে আমাকে টাকা দেন এবং আমি তাঁর জন্য সেই বইগুলো কিনে নিয়ে আসি। তাঁর ‘পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা’ রচনায় সম্ভবত এগুলো সহায়তা করেছিল।
আমার মতে, কমিউনিস্ট আন্দোলনে সবাই সমানভাবে সব দিকে ভূমিকা রাখতে পারেন না। এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই ভয়ানক দুর্বলতার জন্য আমরা রনো কাকুর তাত্ত্বিক অবদানকে আরও বিকশিত হতে দিইনি। এখন তাঁর দূর অনন্তের পথে যাত্রার কারণে এই ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতিসাধন হলো। তবে রনো কাকুর মতো লোক, যারা নিজেদের সর্বস্ব বিলীন করে দেশের শ্রমজীবী মানুষের জন্য সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের সুবিধাবাদ যেমন গ্রাস করতে পারে না, তেমনি বিস্মৃতির অতলেও তলিয়ে দেওয়া যায় না।
আজ রনো কাকুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। আমার বাবা চলে যাওয়ার পর পাঁচ বছরের মতো গত হয়েছে। কমরেড নুরুল হাসান, কমরেড জাকির হোসেন হবিসহ অনেক কমরেড আজ আর বেঁচে নেই। তবে রনো কাকুসহ এই কমরেডরা প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন দেশের নির্বাচনী গণতন্ত্র ফেরত আনার লড়াইয়ে; জনতুষ্টিবাদের আগ্রাসন প্রতিরোধে; উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থান ঠেকানোর সংগ্রামে; মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার বাড়বাড়ন্ত ঠেকানোর যুদ্ধে; সর্বোপরি দুনিয়াজোড়া মেহনতি মানুষের মুক্তির শ্রেণিযুদ্ধে। কমরেড হায়দার আকবর খান রনো লাল সালাম।
অনিন্দ্য আরিফ: সাংবাদিক, অনুবাদক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র র জন ত আম দ র পর ব র কমর ড
এছাড়াও পড়ুন:
পদ স্থগিত নেতার পক্ষে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির বিবৃতি, দ্রুত মুক্তি দাবি
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে সাদাপাথর লুটের মামলায় গ্রেপ্তার বিএনপি নেতা সাহাব উদ্দিনের মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে উপজেলা বিএনপি। গতকাল সোমবার উপজেলা বিএনপির পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়। কেন্দ্র থেকে পদ স্থগিত হওয়া একজন নেতার পক্ষে এমন বিবৃতি দেওয়ায় দলের ভেতরে ও বাইরে সমালোচনা শুরু হয়েছে।
গত শনিবার রাতে সিলেট নগরের আম্বরখানা এলাকা থেকে সাহাব উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৯)। তিনি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন। গত ১১ আগস্ট কেন্দ্রীয় বিএনপি চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ দলীয় নীতি ও আদর্শবিরোধী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করে।
গতকাল উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুল মন্নান ও সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, সাহাব উদ্দিন বিগত স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রসৈনিক ও মিথ্যা মামলায় নির্যাতিত নেতা। তাঁকে সাদাপাথর লুটের মামলায় মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠানোয় উপজেলা বিএনপির পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয় এবং অবিলম্বে তাঁর মুক্তি দাবি করা হয়।
এ বিষয়ে কথা বলতে উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুল মন্নানের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আকবরের সঙ্গে কথা হয়। তিনি সাহাব উদ্দিনের চাচাতো ভাই। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা মাঠে আছি। আমরা তাঁকে ভালোভাবে চিনি। তিনি কোনো লুটপাটে ছিলেন না। বরং লুটপাটের বিরুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে আমরা মিছিল, মানববন্ধন করেছি। এ তথ্য আমরা মৌখিকভাবে জেলা বিএনপিকেও জানিয়েছি।’
উপজেলা বিএনপির বিবৃতিতে সাহাব উদ্দিনের বিষয়ে ‘মিথ্যা অভিযোগে সদ্য পদ স্থগিত হয়েছে’ বলে দাবি করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তাঁরা রিসিভ করেননি। তাই এ বিষয়ে জেলা বিএনপির অবস্থান ও কোনো বক্তব্য জানা যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করা হয়েছে। এমন অবস্থায় উপজেলা বিএনপি কীভাবে ওই নেতার পক্ষে বিবৃতি দেয়, সেটা অবশ্যই সাংগঠনিকভাবে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। ব্যক্তির অপকর্মের দায় কেন সংগঠন নেবে? বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।
সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে সরকারি প্রায় ১৫০ একর জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। গত ১৭ মার্চ প্রথম আলোয় এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে ১৮ মার্চ সরকারি জমি উদ্ধারে অভিযানে নামে স্থানীয় প্রশাসন। প্রশাসন অভিযান চালিয়ে প্রায় ৭০ একর জমি উদ্ধার করে এবং ১০০টি পাথর ভাঙার যন্ত্র উচ্ছেদের পাশাপাশি প্রায় ৫০টি টিনশেড ঘর উচ্ছেদ করা হয়।
এ ছাড়া কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে সরকারি জমি দখলের ঘটনায় ১৯ মার্চ সাহাব উদ্দিনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় জেলা বিএনপি। পাশাপাশি অভিযোগ তদন্তে জেলা বিএনপির সহসভাপতি আশিক উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
গত ১০ এপ্রিল ভোলাগঞ্জে পাথর কোয়ারি পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে সাহাব উদ্দিন ও তাঁর স্বজনেরা জমি দখল ও লুটপাটে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, উপজেলা সভাপতির নেতৃত্বে এমন অপরাধ দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।
সাহাব উদ্দিনকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাঁকে ‘সাদাপাথর লুটপাটে অভিযুক্ত অন্যতম মূলহোতা’ হিসেবে উল্লেখ করে। সাদাপাথর লুটের ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ থানায় গত ১৫ আগস্ট খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর করা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই মামলায় অজ্ঞাতনামা এক হাজার থেকে দেড় হাজার জনকে আসামি করা হয়।