একটা কথা প্রচলিত আছে, যুদ্ধ শুরু হলে সবার আগে যার মৃত্যু ঘটে তা হচ্ছে ‘সত্য’। যুদ্ধ লাগলে মিথ্যা খবর ছড়ানো হয় আর সত্য চাপা পড়ে যায়। যুদ্ধের কাহিনি সৈন্যরা তৈরি করতে পারেন না। সেই কাহিনি তৈরি হয় মিথ্যা আর গুজব দিয়ে। বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ মরে, আহত হয়। কিন্তু তার আগেই খবরের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সেখানেই জয়-পরাজয় ঠিক হয়। যারা এসব খবর নিয়ন্ত্রণ করে, তারা শুরুতেই জিতে যায়।

যুদ্ধের সময় সত্যিটা জানার চেয়ে দেশকে এক রাখা বা যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন জোগানো বেশি জরুরি মনে করা হয়। তাই অনেক সত্যি কথা লুকিয়ে ফেলা হয় বা ঘুরিয়ে বলা হয়। যুদ্ধ মানেই প্রয়োজনীয় সবাইকে একসঙ্গে রাখার চেষ্টা। এর জন্য একটা জোরালো গল্প দরকার হয়, যাতে মানুষের মনোবল বাড়ে, যুদ্ধকে সঠিক মনে হয় আর শত্রুর প্রতি ঘৃণা জন্মায়। ইতিহাসে দেখা গেছে, সরকার ও সেনাবাহিনী যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন পেতে ইচ্ছা করেই এমন প্রচারণা চালায়।

সরকার বা সেনাবাহিনী যখন যুদ্ধের কথা বলে, তখন তারা বোঝায় যে দেশের স্বাধীনতা বা ভালোর জন্যই এই যুদ্ধ দরকার। তারা শত্রুকে বিপদ হিসেবে দেখায় আর নিজেদের সৈন্যদের সাহসী বলে তুলে ধরে। এতে মানুষ গর্বিত হয় ও দেশের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যায়। তারা সৈন্যদের কষ্টের কথা বলে, যুদ্ধে জেতার কাহিনি শোনায় আর শত্রুকে খারাপ, নিষ্ঠুর বা বোকা হিসেবে দেখায়, যাতে মানুষ শত্রুকে ঘৃণা করে। অনেক সময় শত্রুর দোষ বাড়িয়ে বলা হয়, মিথ্যা খবর ছড়ানো হয়, এমনকি খারাপ ভাষাও ব্যবহার করা হয়।

প্রচারণা শুধু বাইরের লোকদের মত বদলানোর জন্যই নয়, বরং নিজের দেশের মানুষ ও সৈন্যদের সাহস বাড়ানোর জন্যও দরকারি। শত্রুপক্ষের সৈন্যদের মনোবল ভাঙতেও এটা কাজে লাগে। আজকাল এই প্রচারণা সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো হয়। পোস্টার, সিনেমা, উত্তেজক কথাবার্তা ও স্লোগানের মাধ্যমেও এটা করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈন্যদের সামনে যুদ্ধকে একটা মজার অভিযান হিসেবে উপস্থাপন করা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শত্রুকে খারাপভাবে দেখিয়ে মানুষকে এক করা হয়েছিল। আজও যুদ্ধের সময় প্রচারণা একটা শক্তিশালী অস্ত্র, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা ছড়িয়ে মানুষের চিন্তাভাবনা বদলে দেয়।

সম্প্রতি ভারত যখন পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে হামলা চালাল, তখন এক নতুন ধরনের যুদ্ধ শুরু হলো—তথ্যের যুদ্ধ। দুই দেশের মানুষই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা রকম কথা ছড়াতে লাগল, আর এতে দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার ভয় তৈরি হলো। দুই দেশই চাইছিল যেন মানুষ তাদের সমর্থন করে।

এ রকম অবস্থায় সত্যিটা খুঁজে বের করা খুব কঠিন। কারণ, অনেক উল্টোপাল্টা খবর একসঙ্গে ছড়াতে থাকে। আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কারণে আগের মতো সহজে খবর লুকানো যায় না। কিন্তু দুই দেশের নিজেদের সংবাদমাধ্যম সাধারণত সরকারের কথাই বলে। তাই সরকার এখনো মানুষের চিন্তাভাবনা সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

এই যুদ্ধ আবারও মনে করিয়ে দেয় যে যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রথম শিকার হয় সত্য। তখন মিথ্যা গল্প, প্রচারণা আর গুজব ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ ঘৃণার মধ্যে ডুবে যায়। ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক এমনিতেই খারাপ, তার ওপর এই তথ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। দুই পক্ষই নিজেদের গল্পে জিততে চায়, আর এতে শান্তি স্থাপন আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে দুই দেশের নেতারাই লাভবান হন। তাঁরা সরকারি সংবাদমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো আবেগময় বা ভুয়া খবর ব্যবহার করে মানুষের সমর্থন আদায় করেন। সত্যি নিয়ে যখন সন্দেহ জাগে, তখন তাঁরা নিজেদের মতো করে ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারেন, শত্রুকে খারাপ বানাতে পারেন, এমনকি দেশের ভেতরের সমালোচকদেরও শত্রু বানিয়ে ফেলতে পারেন। ‘দেশের নিরাপত্তা’ আর ‘ঐক্যের’ কথা বলে তাঁরা মানুষকে নিজেদের গল্প বিশ্বাস করায়। তখন মানুষ নিজেরা চিন্তা না করে, যা বলা হয় তাই বিশ্বাস করে। আর যারা এই গল্পগুলো তৈরি করে, তারা অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

প্রচারণা হলো যুদ্ধের একটা কৌশল। এর মানে হলো সাধারণ মানুষ আর শত্রুকে ভুল খবর দিয়ে ধোঁকা দেওয়া। এই তথ্যের যুদ্ধে দুই পক্ষই দাবি করে তারা কত বিমান ধ্বংস করেছে বা কতজন মারা গেছে; কিন্তু একেক পক্ষ একেক রকম কথা বলে। সবাই দেখাতে চায় যে তারাই জিতেছে। একজন বলেছিলেন, ‘যুদ্ধের সময় সত্যিটা এত দামি যে তাকে সব সময় মিথ্যার আড়ালে রাখতে হয়।’ অর্থাৎ যুদ্ধের সময় দেশের নিরাপত্তা বা মনোবল ঠিক রাখতে সত্যি না বলে মিথ্যা বলাটাকেই জরুরি মনে করা হয়।

যখন চারদিকে মিথ্যা খবর, পুরোনো ভিডিও আর বিভিন্ন দাবি ঘুরতে থাকে, তখন মানুষ কী করবে? প্রথমে বুঝতে হবে এটা একটা তথ্যের যুদ্ধ। সরকার বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব আবেগময় বা বড় দাবি করা হয়, সেগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখা উচিত। অনেক সময় ইচ্ছা করেই সত্যিটা লুকানো হয়। পুরোনো বা অন্য ঘটনার ভিডিও নতুন বলে চালানো হয়। 

তাই যেকোনো খবর দেখার সময় ভাবুন—এটা কে বলছে? সরকার বা কোনো দল কি এটা দিয়ে নিজেদের সুবিধা করতে চাইছে? নাকি কোনো অচেনা সোশ্যাল মিডিয়া পেজ, যা এক পক্ষের হয়ে কথা বলছে?

ভুল খবর দেখতে পেলে তা ছড়ানো বন্ধ করতে সাহায্য করুন। যারা কোনো ঘটনার ভিডিও বা ছবি শেয়ার করে, তা শেয়ার করার আগে যাচাই করুন। গুগলে ছবি খুঁজে দেখুন বা ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটে দেখে নিন এটা পুরোনো বা মিথ্যা কি না। যাচাই না করে আবেগময় বা বিভ্রান্তিকর কিছু শেয়ার করবেন না। এতে যুদ্ধ আর ঘৃণা আরও বাড়ে।

আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সত্যের চেয়ে আলোচনাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তাই সত্যিটা যাচাই করার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। যা-ই দেখি বা শুনি, তা নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে বোঝা দরকার। কোনো কিছু শুধু আবেগের বশে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। সবাই যদি সত্যিটা খোঁজার চেষ্টা করে, তাহলে ভুল-বোঝাবুঝি ও সংঘাত কমে যেতে পারে।

এই যুদ্ধ আবারও মনে করিয়ে দেয় যে যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রথম শিকার হয় সত্য। তখন মিথ্যা গল্প, প্রচারণা আর গুজব ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ ঘৃণার মধ্যে ডুবে যায়। ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক এমনিতেই খারাপ, তার ওপর এই তথ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। দুই পক্ষই নিজেদের গল্পে জিততে চায়, আর এতে শান্তি স্থাপন আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

তাই আমাদের দরকার প্রশ্ন করা, যাচাই করা আর চিন্তা করা। সত্যি খুঁজে বের করা কঠিন হলেও আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, সত্যি ছাড়া শান্তি সম্ভব নয়।

রিজওয়ান-উল-আলম সহযোগী অধ্যাপক, মিডিয়া, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, নর্থ সাউথ  বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য দ ধ র সময় ব স কর শত র ক তখন ম দরক র সরক র প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় বললেন কোহলি

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার পর ছোট ফরম্যাটের ক্রিকেটকে বিদায় বলেছিলেন বিরাট কোহলি। এবার লাল বলের ক্রিকেটে ১৪ বছরের ইতি টানলেন কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান।

আজ সোমবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টে কোহলি নিজেই এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। ইন্সটাগ্রামে কোহলি লিখেছেন, ‘টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাগি গ্রিন ক্যাপটি পরেছি তাও ১৪ বছর হয়েছে। সত্যি বলতে, কখনও ভাবিনি এই ফরম্যাটের যাত্রা আমাকে এত দূর নিয়ে যাবে। এটি আমাকে পরীক্ষা করেছে, গড়েছে এবং এমন কিছু শিক্ষা দিয়েছে যা সারা জীবন বহন করব।’

তিনি লিখেছেন, ‘এই ফরম্যাট ছেড়ে দেওয়া আমার জন্য সহজ কিছু ছিল না, কিন্তু এটাই সঠিক সময়। আমার সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করেছি এবং অনেক কিছু পেয়েছিও যা কখনও আশা করিনি। পেছনে ফিরে যখনই আমার টেস্ট ক্যারিয়ার দেখব মুখে হাসি থাকবে।’

অস্ট্রেলিয়া সফরেই টেস্ট থেকে সরে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন কোহলি। একাধিকবার সতীর্থদের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। আইপিএলের মাঝে একই বার্তা দিয়েছেন বোর্ডকে। টেস্ট ক্রিকেটে সাম্প্রতিক সময়ে কোহলির ফর্মও খুব একটা ভালো নেই। সবমিলিয়ে তাই এখন সাদা পোশাকের ক্রিকেটকে বিদায় বলাতেই মঙ্গল দেখছেন ভারতের এই সাবেক অধিনায়ক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ