দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ কোন ধরনের অস্ত্র বা সরঞ্জাম ব্যবহার করবে, সেই বিষয়গুলো রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা নির্ধারিত। অর্থাৎ পুলিশ চাইলেই তার ইচ্ছেমতো যেকোনো অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে না। তবে পুলিশের এসব অস্ত্র ব্যবহারে নির্দেশনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক নীতিমালা আছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো জাতিসংঘের ‘আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের দ্বারা বলপ্রয়োগ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের মৌলিক নীতিমালা (১৯৯০)’ এবং ‘কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশিকা (২০২০)’।

এসব নীতিমালায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারকে শেষ বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের জন্য বলা হয়েছে এবং প্রতিটি বলপ্রয়োগের ঘটনার দায়দায়িত্ব নির্ধারণ ও তদন্তের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের অন্যতম শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এসব আন্তর্জাতিক নীতিমালা মেনে চলতে হয়। বাংলাদেশে পুলিশের অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে দণ্ডবিধি, ফৌজদারি আইন, পুলিশ অ্যাক্ট ও পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল দ্বারা সুস্পষ্ট নির্ধারিত।

এ কারণে বলপ্রয়োগ ও অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুলিশ স্বেচ্ছাধীন নয়, বরং দেশীয় আইন ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা দ্বারা নির্ধারিত ও অনুমোদিত। তবে সম্প্রতি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশের কাছে ‘মারণাস্ত্র’ (পড়ুন প্রাণঘাতী) থাকা না–থাকা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। এর পক্ষে ও বিপক্ষে দুই ধরনের ব্যাখ্যা রয়েছে।

সরকারি নির্দেশ সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ মানতে বাধ্য। কাজেই সমস্যাটি এখানে অস্ত্রের? নাকি হুকুমের? পুলিশের অস্ত্র ব্যবহারের ধরনের সঙ্গে দেশের মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ও অপরাধপ্রবণতা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন হলো, পুলিশের কাছে প্রাণঘাতী অস্ত্র থাকা না–থাকার প্রশ্ন কেন আসছে। কারণ, গত জুলাই আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের শরীরে ৭.

৬২ এমএম ক্যালিবারের গুলি পাওয়া গেছে বলে বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে এসব গুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চীনের তৈরি টাইপ ৫৬ অ্যাসল্ট রাইফেলে ব্যবহার করা হয়। শুধু তা–ই নয়, এটি বিশ্বের অন্যতম বেশি ব্যবহৃত এবং ছড়িয়ে পড়া আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর একটি।

তবে দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সরকারি বাহিনীগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই অস্ত্র ব্যবহার করে। অন্যদিকে উন্নত দেশগুলো এর থেকে আরও বেশি কার্যকর অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। উন্নত দেশগুলো নিয়মিত পুলিশিংয়ের ক্ষেত্রে একই সঙ্গে লিথ্যাল ও নন-লিথ্যাল শর্ট আর্মস বা হ্যান্ডগান ব্যবহার করে।

অন্যদিকে বিশেষ অভিযান বা বিশেষ পরিস্থিতিতে লং ব্যারেল অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। আপনি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, ব্রাজিল কিংবা চীনের মতো দেশগুলোর প্রত্যেক দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যের কাছে লেস-লিথ্যাল উইপন যেমন লাঠি, পেপার স্প্রে, ইলেকট্রিক শক দেওয়ার টিজার, রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল, ফ্ল্যাশব্যাগ গ্রেনেড ও হ্যান্ডকাফ থাকে। একই সঙ্গে লিথ্যাল উইপন সাইড আর্মস হিসেবে এক বা একাধিক পিস্তল রাখে, যাতে প্রত্যেক পুলিশ সদস্য প্রয়োজন অনুযায়ী তা ব্যবহার করতে পারেন। এ ছাড়া প্রত্যেকের কাছে ওয়াকিটকি, বডিওর্ন ক্যামেরা ও অন্যান্য কমিউনিকেশন ডিভাইস থাকে। তাঁদের ইউনিফর্মের ডিজাইনটিকে এমনভাবে করা হয়, যাতে করে এসব অস্ত্র ও কমিউনিকেশন ডিভাইস ইউনিফর্মের অংশ হিসেবেই থাকে। এ কারণে বিদেশের দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের ডিউটির সময় দুই হাত ফ্রি থাকে, যাতে জরুরি প্রয়োজনে তিনি সহজেই সাড়া দিতে পারেন। যুক্তরাজ্য ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কয়েকটি দেশের পুলিশ নিয়মিত টহলে লিথ্যাল উইপন রাখে না, তবে তাদের সঙ্গে সশস্ত্র ইউনিট থাকে।

পক্ষান্তরে বাংলাদেশের পুলিশ যে ধরনের ইউনিফর্ম ব্যবহার করে, তাতে বিদেশি পুলিশের মতো এসব অস্ত্র ও সরঞ্জাম ব্যবহার করা যাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যদিও পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স কয়েক বছর আগে পুলিশের নিয়মিত ডিউটির সময়ের জন্য ‘ট্যাকটিক্যাল বেল্ট’ চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত সেটির বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতার পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকালে প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে একই সঙ্গে নন-লিথ্যাল, লিথ্যাল ও ক্রাউড কন্ট্রোল সামগ্রী দিতে না পারার কারণে তা পুলিশ সদস্যের নিজের ও জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার প্রবল ঝুঁকি থাকে।

বর্তমানে পুলিশ লং ব্যারেল অস্ত্র নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিউটি করে, এটি খুবই কঠিন কাজ। শুধু অস্ত্রই নয়, বরং পুলিশের যাবতীয় ইউনিফর্ম, অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রীর বিন্যাস, ডিউটি স্টাইল একটির সঙ্গে আরেকটি ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। পুরো সিস্টেমকে না বদলে কেবল আংশিক বদলে দেওয়ার ফলাফল কেমন হবে, তা সময়েই বলে দেবে।

জুলাই আন্দোলনে রাইফেলের ব্যবহারের ঘটনা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। কিন্তু এখানে আমরা মৌলিক একটি বিষয় ভুলে যাচ্ছি, সেটি হলো, কেন এই আন্দোলন দমাতে লং ব্যারেল অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে? এটি তো এমন নয় যে হঠাৎ করেই জুলাই আন্দোলনের আগে পুলিশকে এসব অস্ত্র প্রদান করা হয়েছে। পুলিশের লং ব্যারেল অস্ত্র ব্যবহারের ইতিহাস শত বছরের পুরোনো। পূর্ব থেকেই পুলিশের এসব অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিটি পদক্ষেপ আইন দ্বারা বিধিবদ্ধ। জুলাই আন্দোলনে লং ব্যারেল অস্ত্র ব্যবহারের সরকারি নির্দেশনা ছিল, তা বিভিন্ন মিডিয়া প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।

বিদ্যমান পুলিশ আইন অনুসারে, সরকারি নির্দেশ সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ মানতে বাধ্য। কাজেই সমস্যাটি এখানে অস্ত্রের? নাকি হুকুমের? পুলিশের অস্ত্র ব্যবহারের ধরনের সঙ্গে দেশের মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ও অপরাধপ্রবণতা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশকে হতে হয় সমসাময়িক অপরাধীদের তুলনায় সব দিক থেকে স্মার্ট ও অগ্রগামী।

এ কারণে পুলিশের অস্ত্রের থাকা না–থাকার মতো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে বাংলাদেশের অপরাধীদের হাতে থাকা অস্ত্রের ধরন, জনগণের আস্থা, নিরাপত্তাবোধ, সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলার মধ্যকার সম্পর্ককে বহুমাত্রিকভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি। কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা নয়, বরং পুরো বিষয়টিকে সামষ্টিকভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। পুলিশ যদি লিথ্যাল উইপন ব্যবহার বাদ দেয়, তাহলে অপরাধীরাও এমন অস্ত্র ব্যবহার বাদ দেবে, তার গ্যারান্টি কী?

মো. ইমরান আহম্মেদ পিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ, বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইকের পিএইচডি গবেষক

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ত র ব যবহ র র প ল শ সদস য ইউন ফর ম ধরন র সরক র র ইউন অপর ধ

এছাড়াও পড়ুন:

আঠারো শতকের সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ খাজা মীর দর্দ

আবদালি মারাঠিদের উৎপাত ও অত্যাচারে অন্য কবিরা যখন একে একে দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌ চলে গিয়েছিলেন, তখনো প্রিয় শহর দিল্লি ছাড়েননি সৈয়দ খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৪ খ্রি.), বরং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থানকারী কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার যে পার্থক্য ছিল, শুধু সে কারণেই তিনি সেই জায়গায় যাননি তা নয়, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর, কারও তারিফ করে কখনো কসিদা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, সর্বোপরি তাঁর জীবনদর্শনও ছিল সমকালিক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন। মির্জা রফী সওদার চেয়েও সাত বছরের অগ্রজ মীর দর্দ এই সবকিছুই নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, পারস্য ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে অনেক কিছু গ্রহণও করেছেন, তবু আমাদের ধারণা, পারিবারিক বংশধারার প্রভাবেই তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যচিন্তা শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল।

মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন।

মাহমুদ আলী খান জামী তাঁর ‘দর্দ কে সো শের’ (প্রকাশকাল: ১৯৫৫ খ্রি., দিল্লি) গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা মীর দর্দের দাদা বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে বুখারা থেকে এ দেশে এসেছিলেন, আর বাবা খাজা মাহমুদ নাসির আন্দালিব ছিলেন ‘শায়েরে উর্দু’ এবং ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুফি। ভিন্ন মতে, তাঁর বাবার নাম (মাহমুদ নাসির নয়) মুহাম্মদ, আর তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন না, ছিলেন ফারসি ভাষার কবি। এঁরা ছিলেন নকশবন্দী ঘরানার পথিকৃৎ খাজা বাহাউদ্দিনের বংশধর ও অনুসারী। সুফি পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই মাত্র বাইশ বছর—ভিন্ন মতে, সাতাশ বছর বয়সে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সুফি শুদ্ধাচারী হয়ে ওঠেন দর্দ এবং সুফি তত্ত্বসংক্রান্ত একাধিক বই লেখেন। ফলে তিনি যখন শের ও গজল লেখেন, তখন সেগুলোতে স্বভাবগত কারণেই সুফি মরমি কবিতার সহজগভীর ভাবের ছায়া পড়েছে। নিচে দর্দ কে সো শের বই থেকে—অন্যত্র গজলরূপে গণ্য এবং গীত—প্রথম ৩টি শের পড়লে এ কথার সত্যতা মিলতে পারে :

তোহমতে চন্দ অপনে জিম্মে ধর চলে
জিস লিয়ে আয়ে থে হম সো কর চলে
জিন্দেগি হ্যয় য়া কোই তোফান হ্যয়
হম তো ইস জিনে কে হাথোঁ মে মর চলে
শমা কে মানিন্দ হম ইস বজম মে
চশম নম আয়ে থে দামন তর চলে

অর্থাৎ :

কত অপবাদ বয়ে নিয়ে আমি চলছি
অথচ যে কারণে এসেছি তা–ই করে গেছি
এ কোনো জীবন, নাকি তুফান
তার হাতেই তো আমি মারা যাব
এই সভার প্রদীপ ছিলাম আমি
এখন আমার চোখের জলে আঁচল ভিজে যায়

[অনুবাদ: লেখক]

অল্প বয়স থেকে যিনি এমন ভাবনায় তাড়িত, তাঁর গজলে এই প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। সুফি কবি ও সাধক হিসেবে স্বীকৃত হলেও গজলকার হিসেবে যেরকম গণ্য হননি খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, ঠিক একই কারণেই গজলকার হিসেবে কেউ কেউ তাঁর নাম সমকালের মীর তকী মীর ও মির্জা রফী সওদার কাতারে রাখতে কুণ্ঠিত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মীর তকী মীরের একটি মন্তব্য আছে, যা অনেকেই উদ্ধৃত করেন, তা হলো: তিনি নাকি আড়াইজন কবিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যার মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন মির্জা রফী সওদা আর অর্ধজন হলেন খাজা মীর দর্দ।

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

শের ও গজলের ক্ষেত্রে মীর তকি মীর শেষমেশ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই জায়গা থেকে বিচার করে তাঁর এই কথাটিকে সদর্থে ধরে নিলে কবিতায় খাজা মীর দর্দের অবদানকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। আসলে পারস্য কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে উর্দু গজলে যখন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীর সঙ্গে আলাপের আবহ তৈরি হচ্ছে, খাজা দর্দ তখন একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন সুফি ঐতিহ্য। সমালোচকদের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ উর্দু’, কিন্তু তাঁর ‘শমা-এ মহফিল’, ‘আহ-এ দর্দ’, ‘দর্দ-এ দিল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষা ও সুফিহৃদয়ের ভাব সেই সময় ও পরবর্তীকালের কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি অনবদ্য শের হলো: ‘তমান্না তেরি হ্যাঁয় অগর হ্যাঁয় তমান্না/ তেরি আরজু হ্যায় অগর আরজু হ্যায়’ অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা তোমারই আকাঙ্ক্ষা/ আশা তোমার জন্য, আদৌ আশা বলে যদি কিছু থাকে’। প্রেমের এমন একনিষ্ঠ নিবেদন খাজা দর্দের শেরেই পাওয়া সম্ভব। নিচে পড়ে নিতে পারি তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় শের:

হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে ম্যারে আরমান ল্যাকিন পির ভি কম নিকলে

অর্থাৎ :

এমন হাজার বাসনা আমার, যার প্রতিটি বাসনার জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত
কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো বটে; কিন্তু তা খুবই সামান্য

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

আরও পড়ুনএকাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি২৮ আগস্ট ২০২৫

মীর দর্দের এমন উচ্চাসনে পৌঁছার অন্য একটি কারণ হলো, তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই গান শোনা ও তার চর্চা বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, সে বিষয়ে তাঁর সবিস্তার আলোচনা এবং গানবিষয়ক গান লেখার উদাহরণ। আমাদের অজানা নয়, গান বিষয়ে কওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমির খসরুর একাধিক বাণী আছে, যেমন: ‘গান হলো আত্মার খোরাক’, ‘দরবেশের কাছে গান হলো ঐশ্বরিক জ্যোতির সমতুল’ ইত্যাদি, আর দর্দ লিখেছেন: ‘অগর ঘিনা নফস কো বড়্কায়ে তো হারাম, অগর দিল কো ইলাহ কি তরফ নরম করে তো হালাল’ অর্থাৎ গান যদি মনকে প্রবৃত্তিতাড়িত হতে উসকে দেয় তাহলে হারাম, আর স্রষ্টামুখী করলে হালাল’। এ বিষয়ে দর্দের যে শের রয়েছে, সেটি আরও সুন্দর :

সামা’ আহলে দিল কো হ্যা সোদমন্দ দর্দ
কে ইস সে নরম হোতা হ্যা পাত্থর কা দিল ভি

অর্থাৎ :

হৃদয়বান মানুষের জন্য গান উপকারী, হে দর্দ
কারণ পাথরের মতো হৃদয়ও তাতে গলে যায়।

উল্লেখ্য যে, গান বিষয়ে আলোচনা করবার সময় এ অঞ্চলের গবেষক ও সুফি-বাউল-ফকিরেরা ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও আমির খসরুর বইয়ের তথ্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে কোথাও সৈয়দ খাজা মীর দর্দের কথা পাওয়া যায় না। জাভেদ হুসেন দর্দের কয়েকটি গজল অনুবাদ করতে গিয়ে তার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘দর্দ ছিলেন একজন বড় সংগীতজ্ঞ। সুফি সাধনায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে হুরমতে ঘিনা নামে পুস্তিকা লিখেছেন। উর্দু গজলের গীতিময়তা আজ দেখা যায় তাতে দর্দের ভূমিকা ব্যাপক ও গভীর।’ এই পুস্তিকাটি দুর্লভ, ভবিষ্যতে এটি অনূদিত হলে শায়ের ও গজলকার মীর দর্দের পাশাপাশি সংগীতচিন্তক হিসেবে তাঁর পরিচয়টাও আমরা জানতে পারব।

অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।
ই–মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ