প্রায় যে ঘটে ব্যাপারটা তা নয় তবু সেই ছেলেবেলার স্মৃতি—তার ভাঙাচোরা টুকরো কখনো খই ফোটার মতো ফুটে ওঠে। সেই সব শব্দে এখনো চমকে উঠি।আমাদের ছেলেবেলায় লম্বা ভ্রমণ বলতে বাগেরহাট থেকে খুলনা আর খুলনা থেকে বাগেরহাট ফেরা। বাড়ি থেকে পি সি কলেজ রোড ধরে এগুলে একেবারে শেষ প্রান্তে রেলস্টেশন। মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাড়ির একফালি উঠোনের মতো ছোট্ট এক টুকরো প্লাটফর্ম। তাকে আদৌ প্লাটফর্ম বলা হতো কি না এখন ঠিক মনে পড়ছে না। তার গাঁথুনি লাল ইট, সিমেন্টের মেলবন্ধনটি শক্ত আভিজাত্যের সেরকম প্রকাশ না হলেও কাছাকাছি ছিল। তারই পাশ ঘেঁষে সে আমলের মিটারগেজ রেলপথ।
দুই ফুট ছয় ইঞ্চি সরু দুই পাতের এই রেলপথটিই তখনকার সময়ে বাগেরহাট আর খুলনার মাঝে একমাত্র যোগাযোগের নির্ভরযোগ্য পথ হিসেবে ব্যবহার হতো। ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথটি তৈরি করা হয়েছিল ১৯১৮ সালে। পরবর্তী সময়ে ১৩টি কোচ এবং আটটি মালগাড়ি চলাচল করত। রূপসা থেকে বাগেরহাট পর্যন্ত দশটা স্টেশন ছিল। স্টেশনের নামগুলোও ভারি চমৎকার—পূর্ব রূপসা, কর্ণপুর, সামন্ত সেনা, বাহির দিয়া, মূলঘর, খানজাহান পুর, যাত্রাপুর, ষাট গম্বুজ রোড, বাগেরহাট কলেজ ও বাগেরহাট। আমরা উঠতাম বাগেরহাট কলেজ স্টেশন থেকে।
হাজারো স্মৃতির কষ্টিপাথরে গাঁথা সেই রেলপথ পরিত্যাক্ত হয় ১৯৯৮ সালে।
৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথটি তৈরি করা হয়েছিল ১৯১৮ সালে। পরবর্তী সময়ে ১৩টি কোচ এবং আটটি মালগাড়ি চলাচল করত। রূপসা থেকে বাগেরহাট পর্যন্ত দশটা স্টেশন ছিল। স্টেশনের নামগুলোও ভারি চমৎকার—পূর্ব রূপসা, কর্ণপুর, সামন্ত সেনা, বাহির দিয়া, মূলঘর, খানজাহান পুর, যাত্রাপুর, ষাট গম্বুজ রোড, বাগেরহাট কলেজ ও বাগেরহাটবাবা সরকারি চাকরির সুবাদে প্রায়ই বাগেরহাট খুলনা যাতায়াত করতেন। বড় আপার শ্বশুর বাড়ি খুলনা। আমরা মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গী হবার সুযোগ পেতাম। তখন নিজেকে মনে হতো খাঁচা ছাড়া পাখির মতো। কু-ঝিকঝিক শব্দটার ভিতরেই কেমন যেন একটা নেশা ধরানো বিষয় ছিল। তারপর চাকা ঘুরত ধীরে ধীরে। আস্তে আস্তে গতি বাড়ত। জানালার কাছে এসে বসতাম। জোর বাতাসে কখন যেন মায়ের বেঁধে দেওয়া চুলের ঝুঁটির বাঁধন অলক্ষে শিথিল হয়ে পড়ত। সে বাতাসে আর আমার ঝাকড়া চুলের আন্দোলনের সাথে পাল্লা দিয়ে পিছন দিকে ছুটে চলত পাকা আমন ধানের খেত, রোদ চকচকে বিল, সবুজ সবজীর মাচান, নীল আকাশে সাদা মেঘের আলপনা। কখন যে রেলগাড়িটা আঁকাবাঁকা ছোট্ট এক নদীর সঙ্গী হয়ে যায়, না কি নদীটাই আমাদের সঙ্গী হয়। তারপর ছুটতে থাকে একসাথে। অনেকটা পথ একসাথে চলি আমরা। তারপর একটু আনমনা হতেই কোথায় যেন হারিয়ে যায় নদীটি। কোথাও খুঁজে পাই না তাকে। রেললাইনের ধারে সরু মেঠোপথ। সেই পথ ধরে একজন সাইকেল চালিয়ে চলে আমাদের সাথে সাথে। তারপর সেও হারিয়ে যায়, কোথাও তার অভাস খুঁজে পাই না। আবার ছুটে আসে সবুজ গাছগাছালি, গোলপাতার বন। তার সাথে চলতে থাকে আমাদের রেলগাড়ি। একটু জনাকীর্ণ লোকালয়ের মাঝখানে এসে থামে সে। সেখান থেকে কিছু লোক ওঠে গাড়িতে, তাদের মাথায় এটা ওটা বোঝা। কিছু দোকান, লোকজনের চিৎকার, ভিড়। ঘিঞ্জি একটা জায়গা। সেইসব পেরিয়ে আবার কু-ঝিকঝিক। রেলগাড়ি ঝমাঝম। হঠাৎ জানালার পাশে এসে দেখি সেই নদীটা আগের চেয়ে প্রশস্ত আর কী বিশাল দীর্ঘ, এখানে এসে স্থির দাঁড়িয়ে। বাবা বলত রূপসা স্টেশনে এসে গেছি। রূপসার ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে কত রংবেরঙের পাল তোলা নৌকা। আবীররঙা আকাশটা দাঁড়িয়ে ঠিক নদীর ওপারে মিলেমিশে। সে ছায়া পড়ে তার ছলছলে জলে।
বড় হয়ে আমি ঠিক রেলগাড়ি চালাব—সেই এইম ইন লাইফ কোথায় যেন ফিকে হয়ে যেত রূপসা ঘাটে এসে জোলো হাওয়ার তোড়ে। নদীতে ফেরি চলত একটা, সাধারণ মানুষের জন্য নৌকাই ভরসা। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হতো। তখন রূপসার নৌকার মাঝি হওয়ার প্রতিজ্ঞাটা দৃঢ় হতে থাকত।
খুলনা থেকে কয়েকদিন পর আবার ফিরতাম বিশাল আনন্দ নিয়ে আমাদের মিটারগেজ জীবনে। বাগেরহাট তখন নিতান্তই নিদ্রাতুর, স্তব্ধ-সবুজ মফস্বল।
কোনো কোনো দিন হাঁটতে হাঁটতে দাদার সাথে ঘুরতে যেতাম রেলস্টেশনে। সে আরেক মজা। দেখতাম দূর থেকে ছুটে আসা রেলগাড়িটি ধীর গতিতে এসে থামত স্টেশনে। যেন সমস্ত তর্জন-গর্জন বন্ধ করে নতমস্তকে সে এক অপরাধী। কালো ধোঁয়া ওড়ানো রেলগাড়িটি থেকে কিছু লোক নামত বাক্স-পেট্রা নিয়ে। কারো বা মাথায় বোচকা। মুখে ক্লান্তির ছাপ। মাথায় ঝাঁকাভরা রূপসা নদীর মাছ। বাগেরহাট বড়বাজারে বেচাকিনি হবে। কিছুক্ষণ থেকে রেলগাড়িটা আবার কোথায় যেন চলে যেত। ছোট মাথায় অতকিছু ধরত না। কেবল যাবার সময় হুইসেল বাজিয়ে চোখের সামনে নীল-সাদা ঝকঝকে আকাশটা কালো ধোঁয়ায় ঢেকে দিয়ে যেত। চাকাগুলো ঝিকঝিক শব্দ তুলত। তারপর স্টেশন সুনসান। শূন্যস্টেশন থেকে ফিরে আসতে মন খারাপ হতো। ফিরতি পথে দাদা আর আমি কোনোদিন ঝালমুড়ি, কোনোদিন কটকটি কিনে খেতে খেতে লাল স্টেশনঘরটি পেরিয়ে বাড়িমুখী হতাম।
আমাদের বাড়িটা ছিল এক ডাকসাইটে লোকের বাড়ির একেবারে লাগোয়া। ডাকসাইটে লোকটি ভাসানী ন্যাপ নেতা গোরাই মিঁয়া। আমরা খালু ডাকতাম। বাড়ির সামনে শাপের মতো পি সি কলেজ রোড গিয়ে শেষ হয়েছে সেই রেলস্টেশনে। সরুই পাড়ায় রাস্তার এপারে আমাদের বাড়ি, ওপারে সবুজ ঘাসে ভরা একচিলতে মাঠ। মাঠের প্রান্তে সানি আপাদের বাড়ি। তার পেছনে নিলুফা আপাদের। সানি আপাদের বাড়িটা ছিল আমার খুব প্রিয়। খিড়কির কাছে একটা পুরনো মেহেদী গাছ। গোড়াটা বাঁধানো। মেহেদী ফুলের সুবাসে বাড়িটা মৌ মৌ করত। আমার আকর্ষণ ছিল ওই মেহেদী গাছটা। আরো একটা আকর্ষণ, সেটি ভিতরে। সানি আপাদের বড় ভাই আবুবকর সিদ্দিক। আমরা দাদু বলে ডাকতাম। ছোটদের ভীষণ স্নেহ করতেন। ফর্সা একহারা গড়নে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, কাঁধে চাদর—বাগেরহাট পি সি কলেজের পরিপাটি বাংলার অধ্যাপক। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতে চলে গেলেন। তো সেই দাদুর সাজানো গোছানো মাঝারি ঘরটি ছিল আমাদের কাছে জাদুঘরের মতো। ঘরে একটা হারমোনিয়াম ছিল। দাদু কবিতা, গান লিখতেন, সুর দিতেন.
শহরের ভিতরে একটা সিনেমা হল ছিল। মাঝেমধ্যে নতুন সিনেমা আসত। রিক্সার তিন দিকে নায়ক-নায়িকার ছবি ছেপে বড় বড় পোস্টার বেঁধে দেওয়া হতো। মজার মজার গান বাজিয়ে মহল্লাময় সিনেমার প্রচার চলত তখন। সেই রিক্সার পেছনে ছুটত একদঙ্গল পোলাপান। একবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে ছুটে তাদের সঙ্গী হয়েছিলাম। অনেকটা পথ গিয়ে বাড়ি ফেরার পথটা হারিয়ে ফেলি।
বাড়ির সামনে দিয়ে যেত মিছিল। এখনকার মতো সব মানুষ রাস্তা জুড়ে নয়, দুই লাইনে সারিবব্ধ, দীপ্তকন্ঠে স্লোগান দিত—তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ। আয়ুব মোনায়েম ভাই ভাই এক দড়িতে ফাঁসি চাই। ভোটের আগে ভাত চাই নইলে এবার রক্ষা নাই। শুনে শুনে ছোটরা তা মুখস্ত করে ফেলতাম। মনে পড়ে সে ছিল ৬৯ এর ছাত্র-জনতার আন্দোলন।
রাত তখন পুরু কাঁথার মতো গভীর। চৈতে পাগলার সাড়া পেয়ে সানি আপাদের বাড়ির সিঁড়ির তলায় ঘুমিয়ে থাকা কুকুরটা পাড়া মাথায় তোলে। চরাচর তখন ঢেকে গেছে ঘন কুয়াশায়। দূরে হুইসেল বাজে। সবকিছু উপেক্ষা করে—মওলা তোমারে কেউ ডাকে না—আবার যিকির টানতে শুরু করে চৈতে পাগলা। পাগলদের কোনো ঘরবাড়ি থাকে না। চৈতে পাগলারও ছিল না। পি সি কলেজ রোড ধরে সে এগিয়ে যেত রেলস্টেশনের দিকে হাতের প্রাগৈতিহাসিক বাঁকানো লাঠিটা পিচঢালা রাস্তায় ঠক ঠক শব্দ করতে করতে। তখন নীল পাহাড়ের ওপর থেকে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ার শব্দ হতো ঘুমন্ত মানুষের স্বপ্ন জগতে।
সময়ে অসময়ে স্টেশনে গিয়ে একটু জিরিয়ে নেয় চৈতে পাগলা।
কোথায় হারিয়ে গেছে সে দিনগুলো!
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আপ দ র ব ব গ রহ ট আম দ র কল জ র ত রপর
এছাড়াও পড়ুন:
ফেলে আসা মিটারগেজ জীবন
প্রায় যে ঘটে ব্যাপারটা তা নয় তবু সেই ছেলেবেলার স্মৃতি—তার ভাঙাচোরা টুকরো কখনো খই ফোটার মতো ফুটে ওঠে। সেই সব শব্দে এখনো চমকে উঠি।আমাদের ছেলেবেলায় লম্বা ভ্রমণ বলতে বাগেরহাট থেকে খুলনা আর খুলনা থেকে বাগেরহাট ফেরা। বাড়ি থেকে পি সি কলেজ রোড ধরে এগুলে একেবারে শেষ প্রান্তে রেলস্টেশন। মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাড়ির একফালি উঠোনের মতো ছোট্ট এক টুকরো প্লাটফর্ম। তাকে আদৌ প্লাটফর্ম বলা হতো কি না এখন ঠিক মনে পড়ছে না। তার গাঁথুনি লাল ইট, সিমেন্টের মেলবন্ধনটি শক্ত আভিজাত্যের সেরকম প্রকাশ না হলেও কাছাকাছি ছিল। তারই পাশ ঘেঁষে সে আমলের মিটারগেজ রেলপথ।
দুই ফুট ছয় ইঞ্চি সরু দুই পাতের এই রেলপথটিই তখনকার সময়ে বাগেরহাট আর খুলনার মাঝে একমাত্র যোগাযোগের নির্ভরযোগ্য পথ হিসেবে ব্যবহার হতো। ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথটি তৈরি করা হয়েছিল ১৯১৮ সালে। পরবর্তী সময়ে ১৩টি কোচ এবং আটটি মালগাড়ি চলাচল করত। রূপসা থেকে বাগেরহাট পর্যন্ত দশটা স্টেশন ছিল। স্টেশনের নামগুলোও ভারি চমৎকার—পূর্ব রূপসা, কর্ণপুর, সামন্ত সেনা, বাহির দিয়া, মূলঘর, খানজাহান পুর, যাত্রাপুর, ষাট গম্বুজ রোড, বাগেরহাট কলেজ ও বাগেরহাট। আমরা উঠতাম বাগেরহাট কলেজ স্টেশন থেকে।
হাজারো স্মৃতির কষ্টিপাথরে গাঁথা সেই রেলপথ পরিত্যাক্ত হয় ১৯৯৮ সালে।
৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথটি তৈরি করা হয়েছিল ১৯১৮ সালে। পরবর্তী সময়ে ১৩টি কোচ এবং আটটি মালগাড়ি চলাচল করত। রূপসা থেকে বাগেরহাট পর্যন্ত দশটা স্টেশন ছিল। স্টেশনের নামগুলোও ভারি চমৎকার—পূর্ব রূপসা, কর্ণপুর, সামন্ত সেনা, বাহির দিয়া, মূলঘর, খানজাহান পুর, যাত্রাপুর, ষাট গম্বুজ রোড, বাগেরহাট কলেজ ও বাগেরহাটবাবা সরকারি চাকরির সুবাদে প্রায়ই বাগেরহাট খুলনা যাতায়াত করতেন। বড় আপার শ্বশুর বাড়ি খুলনা। আমরা মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গী হবার সুযোগ পেতাম। তখন নিজেকে মনে হতো খাঁচা ছাড়া পাখির মতো। কু-ঝিকঝিক শব্দটার ভিতরেই কেমন যেন একটা নেশা ধরানো বিষয় ছিল। তারপর চাকা ঘুরত ধীরে ধীরে। আস্তে আস্তে গতি বাড়ত। জানালার কাছে এসে বসতাম। জোর বাতাসে কখন যেন মায়ের বেঁধে দেওয়া চুলের ঝুঁটির বাঁধন অলক্ষে শিথিল হয়ে পড়ত। সে বাতাসে আর আমার ঝাকড়া চুলের আন্দোলনের সাথে পাল্লা দিয়ে পিছন দিকে ছুটে চলত পাকা আমন ধানের খেত, রোদ চকচকে বিল, সবুজ সবজীর মাচান, নীল আকাশে সাদা মেঘের আলপনা। কখন যে রেলগাড়িটা আঁকাবাঁকা ছোট্ট এক নদীর সঙ্গী হয়ে যায়, না কি নদীটাই আমাদের সঙ্গী হয়। তারপর ছুটতে থাকে একসাথে। অনেকটা পথ একসাথে চলি আমরা। তারপর একটু আনমনা হতেই কোথায় যেন হারিয়ে যায় নদীটি। কোথাও খুঁজে পাই না তাকে। রেললাইনের ধারে সরু মেঠোপথ। সেই পথ ধরে একজন সাইকেল চালিয়ে চলে আমাদের সাথে সাথে। তারপর সেও হারিয়ে যায়, কোথাও তার অভাস খুঁজে পাই না। আবার ছুটে আসে সবুজ গাছগাছালি, গোলপাতার বন। তার সাথে চলতে থাকে আমাদের রেলগাড়ি। একটু জনাকীর্ণ লোকালয়ের মাঝখানে এসে থামে সে। সেখান থেকে কিছু লোক ওঠে গাড়িতে, তাদের মাথায় এটা ওটা বোঝা। কিছু দোকান, লোকজনের চিৎকার, ভিড়। ঘিঞ্জি একটা জায়গা। সেইসব পেরিয়ে আবার কু-ঝিকঝিক। রেলগাড়ি ঝমাঝম। হঠাৎ জানালার পাশে এসে দেখি সেই নদীটা আগের চেয়ে প্রশস্ত আর কী বিশাল দীর্ঘ, এখানে এসে স্থির দাঁড়িয়ে। বাবা বলত রূপসা স্টেশনে এসে গেছি। রূপসার ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে কত রংবেরঙের পাল তোলা নৌকা। আবীররঙা আকাশটা দাঁড়িয়ে ঠিক নদীর ওপারে মিলেমিশে। সে ছায়া পড়ে তার ছলছলে জলে।
বড় হয়ে আমি ঠিক রেলগাড়ি চালাব—সেই এইম ইন লাইফ কোথায় যেন ফিকে হয়ে যেত রূপসা ঘাটে এসে জোলো হাওয়ার তোড়ে। নদীতে ফেরি চলত একটা, সাধারণ মানুষের জন্য নৌকাই ভরসা। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হতো। তখন রূপসার নৌকার মাঝি হওয়ার প্রতিজ্ঞাটা দৃঢ় হতে থাকত।
খুলনা থেকে কয়েকদিন পর আবার ফিরতাম বিশাল আনন্দ নিয়ে আমাদের মিটারগেজ জীবনে। বাগেরহাট তখন নিতান্তই নিদ্রাতুর, স্তব্ধ-সবুজ মফস্বল।
কোনো কোনো দিন হাঁটতে হাঁটতে দাদার সাথে ঘুরতে যেতাম রেলস্টেশনে। সে আরেক মজা। দেখতাম দূর থেকে ছুটে আসা রেলগাড়িটি ধীর গতিতে এসে থামত স্টেশনে। যেন সমস্ত তর্জন-গর্জন বন্ধ করে নতমস্তকে সে এক অপরাধী। কালো ধোঁয়া ওড়ানো রেলগাড়িটি থেকে কিছু লোক নামত বাক্স-পেট্রা নিয়ে। কারো বা মাথায় বোচকা। মুখে ক্লান্তির ছাপ। মাথায় ঝাঁকাভরা রূপসা নদীর মাছ। বাগেরহাট বড়বাজারে বেচাকিনি হবে। কিছুক্ষণ থেকে রেলগাড়িটা আবার কোথায় যেন চলে যেত। ছোট মাথায় অতকিছু ধরত না। কেবল যাবার সময় হুইসেল বাজিয়ে চোখের সামনে নীল-সাদা ঝকঝকে আকাশটা কালো ধোঁয়ায় ঢেকে দিয়ে যেত। চাকাগুলো ঝিকঝিক শব্দ তুলত। তারপর স্টেশন সুনসান। শূন্যস্টেশন থেকে ফিরে আসতে মন খারাপ হতো। ফিরতি পথে দাদা আর আমি কোনোদিন ঝালমুড়ি, কোনোদিন কটকটি কিনে খেতে খেতে লাল স্টেশনঘরটি পেরিয়ে বাড়িমুখী হতাম।
আমাদের বাড়িটা ছিল এক ডাকসাইটে লোকের বাড়ির একেবারে লাগোয়া। ডাকসাইটে লোকটি ভাসানী ন্যাপ নেতা গোরাই মিঁয়া। আমরা খালু ডাকতাম। বাড়ির সামনে শাপের মতো পি সি কলেজ রোড গিয়ে শেষ হয়েছে সেই রেলস্টেশনে। সরুই পাড়ায় রাস্তার এপারে আমাদের বাড়ি, ওপারে সবুজ ঘাসে ভরা একচিলতে মাঠ। মাঠের প্রান্তে সানি আপাদের বাড়ি। তার পেছনে নিলুফা আপাদের। সানি আপাদের বাড়িটা ছিল আমার খুব প্রিয়। খিড়কির কাছে একটা পুরনো মেহেদী গাছ। গোড়াটা বাঁধানো। মেহেদী ফুলের সুবাসে বাড়িটা মৌ মৌ করত। আমার আকর্ষণ ছিল ওই মেহেদী গাছটা। আরো একটা আকর্ষণ, সেটি ভিতরে। সানি আপাদের বড় ভাই আবুবকর সিদ্দিক। আমরা দাদু বলে ডাকতাম। ছোটদের ভীষণ স্নেহ করতেন। ফর্সা একহারা গড়নে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, কাঁধে চাদর—বাগেরহাট পি সি কলেজের পরিপাটি বাংলার অধ্যাপক। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতে চলে গেলেন। তো সেই দাদুর সাজানো গোছানো মাঝারি ঘরটি ছিল আমাদের কাছে জাদুঘরের মতো। ঘরে একটা হারমোনিয়াম ছিল। দাদু কবিতা, গান লিখতেন, সুর দিতেন. গান গাইতেন। একুশের গান লিখে আমাদের শিখিয়েছিলেন প্রভাত ফেরিতে গাইবার জন্য। ঘরটিতে ছাদ সমান সব উঁচু আলমারি। তাতে কত যে বই সাজানো তার ঠিকঠিকানা নেই। সেই একটি আলমারিতে ছিল শ্বেত পাথরের রবীন্দ্রনাথের ছোট্ট আবক্ষ মূর্তি। অবাক হতাম। তখন তো জানা ছিল না কত বিরাট মানুষ তিনি আর কেনই বা তাঁকে এভাবে বন্দি রাখা হয়েছে। তবে সেই ছোট বয়সেই মনে হতো মূর্তিটার ভিতরে যেন নিশ্বাস-প্রশ্বাস বইছে। আমি হাত বুলাতাম গ্লাসের বাইরে।
শহরের ভিতরে একটা সিনেমা হল ছিল। মাঝেমধ্যে নতুন সিনেমা আসত। রিক্সার তিন দিকে নায়ক-নায়িকার ছবি ছেপে বড় বড় পোস্টার বেঁধে দেওয়া হতো। মজার মজার গান বাজিয়ে মহল্লাময় সিনেমার প্রচার চলত তখন। সেই রিক্সার পেছনে ছুটত একদঙ্গল পোলাপান। একবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে ছুটে তাদের সঙ্গী হয়েছিলাম। অনেকটা পথ গিয়ে বাড়ি ফেরার পথটা হারিয়ে ফেলি।
বাড়ির সামনে দিয়ে যেত মিছিল। এখনকার মতো সব মানুষ রাস্তা জুড়ে নয়, দুই লাইনে সারিবব্ধ, দীপ্তকন্ঠে স্লোগান দিত—তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ। আয়ুব মোনায়েম ভাই ভাই এক দড়িতে ফাঁসি চাই। ভোটের আগে ভাত চাই নইলে এবার রক্ষা নাই। শুনে শুনে ছোটরা তা মুখস্ত করে ফেলতাম। মনে পড়ে সে ছিল ৬৯ এর ছাত্র-জনতার আন্দোলন।
রাত তখন পুরু কাঁথার মতো গভীর। চৈতে পাগলার সাড়া পেয়ে সানি আপাদের বাড়ির সিঁড়ির তলায় ঘুমিয়ে থাকা কুকুরটা পাড়া মাথায় তোলে। চরাচর তখন ঢেকে গেছে ঘন কুয়াশায়। দূরে হুইসেল বাজে। সবকিছু উপেক্ষা করে—মওলা তোমারে কেউ ডাকে না—আবার যিকির টানতে শুরু করে চৈতে পাগলা। পাগলদের কোনো ঘরবাড়ি থাকে না। চৈতে পাগলারও ছিল না। পি সি কলেজ রোড ধরে সে এগিয়ে যেত রেলস্টেশনের দিকে হাতের প্রাগৈতিহাসিক বাঁকানো লাঠিটা পিচঢালা রাস্তায় ঠক ঠক শব্দ করতে করতে। তখন নীল পাহাড়ের ওপর থেকে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ার শব্দ হতো ঘুমন্ত মানুষের স্বপ্ন জগতে।
সময়ে অসময়ে স্টেশনে গিয়ে একটু জিরিয়ে নেয় চৈতে পাগলা।
কোথায় হারিয়ে গেছে সে দিনগুলো!