অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের কথা কেন উঠেছিল
Published: 25th, May 2025 GMT
ঠিক সাড়ে ৯ মাসের মাথায় এসে দেশের মানুষ আর একবার থমকে গেল। কী হচ্ছে দেশে! ২২ ও ২৩ মে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় দেখেন, কোনো ভালো সংবাদ নেই। ২১ তারিখের পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনাম: প্রথম শিরোনাম, ‘শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, নেই পরিকল্পিত সমাধান’; দ্বিতীয়, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক প্রধান উপদেষ্টার’; তৃতীয়, ‘তিন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পরও অচলাবস্থা কাটেনি: এনবিআরে আন্দোলন’; চতুর্থ, ‘সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা চলছে: যৌথ সভায় ফখরুল’ এবং পঞ্চম, ‘সড়ক অবরোধে ভোগান্তি, কর্মচারীরাও বিক্ষোভে: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন’।
ইতিমধ্যে দুই মাস ধরে ৩১টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানেও কোনো আশার বাণী নেই। ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান আলী রীয়াজ বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য খুব স্পষ্ট। এমনকি এসব মতপার্থক্যের অনেকগুলো বিষয় মৌলিক বলে উল্লেখ করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আবেদন করেছেন, শেষ মাইলটি অতিক্রম করতে দুদিক থেকেই এগিয়ে আসতে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য ইতিমধ্যে জনসমক্ষে এসেছে। এই পার্থক্য যতটুকু না সংস্কারকেন্দ্রিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক, নির্বাচনকেন্দ্রিক। এমনকি রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য তেমন বোঝা যায়নি। নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি সংস্কার, খুনিদের বিচার ইত্যাদি নিয়ে প্রথম থেকে অনমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছিল। তাদের অবস্থান দাঁড়িয়েছিল বিএনপির বিপরীতে।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী এই তরুণ শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার নানা রকম কৌশল, দৃষ্টিভঙ্গি জনসমক্ষে আনছিলেন। শুরু থেকেই তাঁদের প্রতি ছিল মানুষের প্রগাঢ় ভালোবাসা। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছিল, রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ এই তরুণেরা বন্ধুর চেয়ে বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। নিজেরাও খণ্ডিত হয়ে যাচ্ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের প্রতি দুর্বল ছিলেন। বলেছিলেন, এত বড় একটা যুগান্তকারী অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী যুবকদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হতেই পারে। তিনি তাঁদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেবেন বলেছিলেন। তবে তাঁরা স্বপ্ন দেখছিলেন জাতীয় রাজনীতিতে মুখ্য শক্তি হওয়ার। প্রায় ক্ষেত্রেই বিএনপির রাজনীতির বিপরীতে অবস্থান করছিলেন।
স্যার, সময় আপনাকে একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব দিয়েছে। আপনার মতো মানুষ এই দায়িত্ব ফেলে চলে যেতে পারবেন না। যা করতে চেয়েছেন সবই করতে পারবেন, এ রকম কি হয়? কিন্তু ন্যূনতম প্রয়োজন বা ন্যূনতম যা করা যায়, তা আপনি নিশ্চয়ই করবেন। সে জন্যই তো আপনি নোবেল লরিয়েট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।ফ্যাসিবাদের পতনের পর সবচেয়ে বড় দল হিসেবে বিএনপি জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখাতে পারেনি। দলটির নেতা-কর্মীদের কথা ও কাজ সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়েছে। একটা জল্পনা তৈরি হতে যাচ্ছিল যে বিএনপি আগামী নির্বাচনে ভালো করতে পারবে না। আমার ধারণা, ইশরাকের মেয়র পদে শপথ নেওয়ার আন্দোলন একটি রাজনৈতিক আন্দোলন, যা মানুষের এই চিন্তার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আন্দোলনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহ প্রমাণ করেছে যে বিএনপি এখনো দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। দুঃখজনক যে তাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক ভালো নয়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপি আরেকবার সরকারকে বার্তা দিয়েছে যে বিএনপিকে উপেক্ষা করে সংস্কারপ্রক্রিয়া এগোবে না।
একটা প্রশ্ন এখানে করা যেতে পারে, কারও শক্তি বেশি বলে সে কি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারবে? সংস্কার তো একটি গুণগত উন্নয়নপ্রক্রিয়া। সিদ্ধান্ত কি সংস্কারের গুণগত দিক বিবেচনা করে নেওয়া হবে? নাকি শক্তি কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে হবে? গণতন্ত্র মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠতার শাসন। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা যেটাকে সমর্থন দেবেন, তারই ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে কিংবা দেশ পরিচালিত হবে। গুণগত বিষয়টি সদস্যদের জ্ঞান ও বিবেচনার কাছে আবেদন করা যেতে পারে। কিন্তু সেটার কোনো আইন বা বিধানগত নিশ্চয়তা নেই। একটা সমাজ জ্ঞান ও কৃৎকৌশলের দিক থেকে যত সমৃদ্ধ হবে, রাজনীতিবিদেরাও তত জ্ঞানসমৃদ্ধ হবেন। এই যে বিতর্কটা তোলা হয়েছে, আগে সংস্কার তারপর নির্বাচন, এই কারণেই সেটা কোনো বিতর্ক নয়। কারণ, অনন্তকাল ধরে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। একে থামিয়ে রাখার কোনো বিষয় নেই। আমরা আশা করতেই পারি যে পারস্পরিক আন্তরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে এই বিতর্কগুলো নিষ্পত্তির দিকে আসা সম্ভব।
সে ব্যাপারেও কোনো অগ্রগতি দেখি না। সেমিনারে, গোলটেবিল বৈঠকে গিয়ে প্রশ্ন করেছি, এ পর্যন্ত সরকার কী সংস্কার করেছে? মজার বিষয় হলো, পত্রিকায় দেখলাম, খোদ প্রধান উপদেষ্টা তাঁর সহকর্মী উপদেষ্টাদের কাছে স্বগতোক্তির মতো বলেছেন, সংস্কারের তো এখন পর্যন্ত কিছু করা যায়নি। কত দিনে করা যাবে? আদৌ করা যাবে?
এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় বলতে চাই। তবে তার আগে একটা প্রশ্ন বিএনপিসহ প্রায় সব কটি রাজনৈতিক দল (এনসিপি, জামায়াত এবং অন্যান্য ধর্মবাদী দল বাদে) নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে, জানিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সরকার সরাসরি কোনো জবাব দিচ্ছে না। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, তিনি ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন দিতে পারবেন। কিন্তু কোনো উপদেষ্টা ডিসেম্বর মাসের কথা বলেননি। আমাকে সংশ্লিষ্ট দুজন সাংবাদিক বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরের কথা বলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে যায় জুনের কথা। তা-ই কি?
এ রকম দেখেছি, প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরের কথা বললেও সেই দিনে কিংবা এক দিন পর কোনো কোনো উপদেষ্টা জুনের কথা বলেছেন। কেন? এখন সেনাবাহিনীর স্টাফপ্রধান জেনারেল ওয়াকার বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন দেওয়া উচিত। ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না? সেনাপ্রধান বলেছেন, কিন্তু সরকার বলছে না। এটার ব্যাখ্যা কী? প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কি খুব ভালো আছেন? জানতে ইচ্ছা করে!
এই মানুষটিকে আমি অনেক বছর আগে দেখেছি। খুব ঝামেলা পছন্দ করেন না। ঝামেলা এড়িয়ে যেতে চান। এড়িয়ে থাকতে চান। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের এক ঘনিষ্ঠ সহচরকে আমি বলেছিলাম, আপনারা তো রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলতে চান না। কিন্তু শাসন ব্যাপারটাই রাজনীতি। অরাজনৈতিকভাবে দেশ শাসন করা যায় না। আমি কি স্যারকে জিজ্ঞাসা করতে পারি, ‘আপনি আসলে কী ভাবছেন? হুলুস্থুল লেগে গেছে। দেশের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়েছে, আপনি পদত্যাগ চান। যদিও আপনি তা করেননি। তাহলে এ কথা বাজারে এল কেন?’ অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে নির্বাচন নিয়ে। কিন্তু তারপরও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ কেউ চাননি। গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত এক বৈঠক শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে থাকছেন। উনি বলেননি উনি পদত্যাগ করবেন।’
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য যখন তিনি প্যারিসে অস্ত্রোপচার শেষে দেশে এসেছিলেন, তখন ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘(হাসতে হাসতে) আমার কথা শুনতে হবে। না হলে আমি আবার ফিরে চলে যাব।’ এ রকম কথা আমি পরেও তাঁকে বলতে শুনেছি। একরাতে শুনলাম, বিদেশি টেলিভিশনে তিনি বলছেন, ‘আমি তো এখানে একটা ডিউটি করতে এসেছি। আমার কাজ শেষ হবে, তখন আমি আবার আমার আগের কাজে ফিরে যাব।’ মাঝেমধ্যেই মনে প্রশ্ন জাগত যে এখানকার সর্বময় দায়িত্ব কি তিনি উপভোগ করেন না? মূল কিছু সংস্কারের ব্যাপারে তিনি তো খুবই আন্তরিক ছিলেন। রাজনীতি তিনি পছন্দ করেন না। এটা তাঁর সব থেকে বড় ঘাটতি এই ক্ষেত্রে। তিনি যদি সত্যিই সরে যেতে চেয়ে থাকেন, তা কী কারণে?
স্যার, সময় আপনাকে একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব দিয়েছে। আপনার মতো মানুষ এই দায়িত্ব ফেলে চলে যেতে পারবেন না। যা করতে চেয়েছেন সবই করতে পারবেন, এ রকম কি হয়? কিন্তু ন্যূনতম প্রয়োজন বা ন্যূনতম যা করা যায়, তা আপনি নিশ্চয়ই করবেন। সে জন্যই তো আপনি নোবেল লরিয়েট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। যদি বাস্তব দেখে বলি, আপনি ডিসেম্বরে নির্বাচন টার্গেট করতে পারেন। এর মধ্যে যতটুকু সংস্কার করা যায়, তা করেন। রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকেন। আপনার সক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতার কথা তাদের বলেন। তাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানান। এখনো বাংলাদেশের মানুষ আপনাকে ভালোবাসে।
● মাহমুদুর রহমান মান্না সভাপতি, নাগরিক ঐক্য
* মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বল ছ ল ন ড স ম বর পদত য গ ন য নতম প রব ন বল ছ ন এ রকম ব এনপ সরক র প রথম রকম ক আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
কোরবানির পশুর চামড়ার নতুন দাম নির্ধারণ
এ বছর ঈদুল আজহা উপলক্ষে লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম গত বছরের চেয়ে ৫ টাকা বাড়িয়ে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। আর ঢাকার বাইরের চামড়ার দাম ৫টাকা বাড়িয়ে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা করা হয়েছে। একই সঙ্গে খাসি ও বকরির চামড়ার দাম ২ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
একই সঙ্গে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এ বছর গরুর লবণযুক্ত প্রতি পিস চামড়ার সর্বনিম্ন দাম ১ হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে ঢাকায় এই দাম হবে ১ হাজার ৩৫০ টাকা। এ বছর প্রতি বর্গফুটে চামড়ার দামের পাশাপাশি ছোট গরুর আয়তন হিসেবে এই সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার।
রবিবার (২৫ মে) দুপুরে সচিবালয়ের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন এসব তথ্য জানান।
আরো পড়ুন:
গরু বহনকারী গাড়ি মাঝপথে থামানো যাবে না: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
‘সড়ক ও মহাসড়কে কোরবানির পশুর হাট বসতে দেওয়া হবে না’
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “এ বছর ঢাকায় গুরুর চামড়া প্রতি পিস ১৩৫০ টাকার নিচে কেনা হবে না এবং ঢাকার বাইরের চামড়া ১১৫০ টাকার নিচে কেনা হবে না।”
গত বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৮ থেকে ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
ঢাকা/হাসান/সাইফ