অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের কথা কেন উঠেছিল
Published: 25th, May 2025 GMT
ঠিক সাড়ে ৯ মাসের মাথায় এসে দেশের মানুষ আর একবার থমকে গেল। কী হচ্ছে দেশে! ২২ ও ২৩ মে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় দেখেন, কোনো ভালো সংবাদ নেই। ২১ তারিখের পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনাম: প্রথম শিরোনাম, ‘শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, নেই পরিকল্পিত সমাধান’; দ্বিতীয়, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক প্রধান উপদেষ্টার’; তৃতীয়, ‘তিন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পরও অচলাবস্থা কাটেনি: এনবিআরে আন্দোলন’; চতুর্থ, ‘সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা চলছে: যৌথ সভায় ফখরুল’ এবং পঞ্চম, ‘সড়ক অবরোধে ভোগান্তি, কর্মচারীরাও বিক্ষোভে: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন’।
ইতিমধ্যে দুই মাস ধরে ৩১টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানেও কোনো আশার বাণী নেই। ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান আলী রীয়াজ বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য খুব স্পষ্ট। এমনকি এসব মতপার্থক্যের অনেকগুলো বিষয় মৌলিক বলে উল্লেখ করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আবেদন করেছেন, শেষ মাইলটি অতিক্রম করতে দুদিক থেকেই এগিয়ে আসতে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য ইতিমধ্যে জনসমক্ষে এসেছে। এই পার্থক্য যতটুকু না সংস্কারকেন্দ্রিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক, নির্বাচনকেন্দ্রিক। এমনকি রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য তেমন বোঝা যায়নি। নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি সংস্কার, খুনিদের বিচার ইত্যাদি নিয়ে প্রথম থেকে অনমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছিল। তাদের অবস্থান দাঁড়িয়েছিল বিএনপির বিপরীতে।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী এই তরুণ শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার নানা রকম কৌশল, দৃষ্টিভঙ্গি জনসমক্ষে আনছিলেন। শুরু থেকেই তাঁদের প্রতি ছিল মানুষের প্রগাঢ় ভালোবাসা। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছিল, রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ এই তরুণেরা বন্ধুর চেয়ে বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। নিজেরাও খণ্ডিত হয়ে যাচ্ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের প্রতি দুর্বল ছিলেন। বলেছিলেন, এত বড় একটা যুগান্তকারী অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী যুবকদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হতেই পারে। তিনি তাঁদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেবেন বলেছিলেন। তবে তাঁরা স্বপ্ন দেখছিলেন জাতীয় রাজনীতিতে মুখ্য শক্তি হওয়ার। প্রায় ক্ষেত্রেই বিএনপির রাজনীতির বিপরীতে অবস্থান করছিলেন।
স্যার, সময় আপনাকে একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব দিয়েছে। আপনার মতো মানুষ এই দায়িত্ব ফেলে চলে যেতে পারবেন না। যা করতে চেয়েছেন সবই করতে পারবেন, এ রকম কি হয়? কিন্তু ন্যূনতম প্রয়োজন বা ন্যূনতম যা করা যায়, তা আপনি নিশ্চয়ই করবেন। সে জন্যই তো আপনি নোবেল লরিয়েট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।ফ্যাসিবাদের পতনের পর সবচেয়ে বড় দল হিসেবে বিএনপি জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখাতে পারেনি। দলটির নেতা-কর্মীদের কথা ও কাজ সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়েছে। একটা জল্পনা তৈরি হতে যাচ্ছিল যে বিএনপি আগামী নির্বাচনে ভালো করতে পারবে না। আমার ধারণা, ইশরাকের মেয়র পদে শপথ নেওয়ার আন্দোলন একটি রাজনৈতিক আন্দোলন, যা মানুষের এই চিন্তার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আন্দোলনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহ প্রমাণ করেছে যে বিএনপি এখনো দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। দুঃখজনক যে তাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক ভালো নয়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপি আরেকবার সরকারকে বার্তা দিয়েছে যে বিএনপিকে উপেক্ষা করে সংস্কারপ্রক্রিয়া এগোবে না।
একটা প্রশ্ন এখানে করা যেতে পারে, কারও শক্তি বেশি বলে সে কি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারবে? সংস্কার তো একটি গুণগত উন্নয়নপ্রক্রিয়া। সিদ্ধান্ত কি সংস্কারের গুণগত দিক বিবেচনা করে নেওয়া হবে? নাকি শক্তি কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে হবে? গণতন্ত্র মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠতার শাসন। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা যেটাকে সমর্থন দেবেন, তারই ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে কিংবা দেশ পরিচালিত হবে। গুণগত বিষয়টি সদস্যদের জ্ঞান ও বিবেচনার কাছে আবেদন করা যেতে পারে। কিন্তু সেটার কোনো আইন বা বিধানগত নিশ্চয়তা নেই। একটা সমাজ জ্ঞান ও কৃৎকৌশলের দিক থেকে যত সমৃদ্ধ হবে, রাজনীতিবিদেরাও তত জ্ঞানসমৃদ্ধ হবেন। এই যে বিতর্কটা তোলা হয়েছে, আগে সংস্কার তারপর নির্বাচন, এই কারণেই সেটা কোনো বিতর্ক নয়। কারণ, অনন্তকাল ধরে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। একে থামিয়ে রাখার কোনো বিষয় নেই। আমরা আশা করতেই পারি যে পারস্পরিক আন্তরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে এই বিতর্কগুলো নিষ্পত্তির দিকে আসা সম্ভব।
সে ব্যাপারেও কোনো অগ্রগতি দেখি না। সেমিনারে, গোলটেবিল বৈঠকে গিয়ে প্রশ্ন করেছি, এ পর্যন্ত সরকার কী সংস্কার করেছে? মজার বিষয় হলো, পত্রিকায় দেখলাম, খোদ প্রধান উপদেষ্টা তাঁর সহকর্মী উপদেষ্টাদের কাছে স্বগতোক্তির মতো বলেছেন, সংস্কারের তো এখন পর্যন্ত কিছু করা যায়নি। কত দিনে করা যাবে? আদৌ করা যাবে?
এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় বলতে চাই। তবে তার আগে একটা প্রশ্ন বিএনপিসহ প্রায় সব কটি রাজনৈতিক দল (এনসিপি, জামায়াত এবং অন্যান্য ধর্মবাদী দল বাদে) নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে, জানিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সরকার সরাসরি কোনো জবাব দিচ্ছে না। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, তিনি ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন দিতে পারবেন। কিন্তু কোনো উপদেষ্টা ডিসেম্বর মাসের কথা বলেননি। আমাকে সংশ্লিষ্ট দুজন সাংবাদিক বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরের কথা বলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে যায় জুনের কথা। তা-ই কি?
এ রকম দেখেছি, প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরের কথা বললেও সেই দিনে কিংবা এক দিন পর কোনো কোনো উপদেষ্টা জুনের কথা বলেছেন। কেন? এখন সেনাবাহিনীর স্টাফপ্রধান জেনারেল ওয়াকার বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন দেওয়া উচিত। ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না? সেনাপ্রধান বলেছেন, কিন্তু সরকার বলছে না। এটার ব্যাখ্যা কী? প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কি খুব ভালো আছেন? জানতে ইচ্ছা করে!
এই মানুষটিকে আমি অনেক বছর আগে দেখেছি। খুব ঝামেলা পছন্দ করেন না। ঝামেলা এড়িয়ে যেতে চান। এড়িয়ে থাকতে চান। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের এক ঘনিষ্ঠ সহচরকে আমি বলেছিলাম, আপনারা তো রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলতে চান না। কিন্তু শাসন ব্যাপারটাই রাজনীতি। অরাজনৈতিকভাবে দেশ শাসন করা যায় না। আমি কি স্যারকে জিজ্ঞাসা করতে পারি, ‘আপনি আসলে কী ভাবছেন? হুলুস্থুল লেগে গেছে। দেশের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়েছে, আপনি পদত্যাগ চান। যদিও আপনি তা করেননি। তাহলে এ কথা বাজারে এল কেন?’ অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে নির্বাচন নিয়ে। কিন্তু তারপরও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ কেউ চাননি। গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত এক বৈঠক শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে থাকছেন। উনি বলেননি উনি পদত্যাগ করবেন।’
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য যখন তিনি প্যারিসে অস্ত্রোপচার শেষে দেশে এসেছিলেন, তখন ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘(হাসতে হাসতে) আমার কথা শুনতে হবে। না হলে আমি আবার ফিরে চলে যাব।’ এ রকম কথা আমি পরেও তাঁকে বলতে শুনেছি। একরাতে শুনলাম, বিদেশি টেলিভিশনে তিনি বলছেন, ‘আমি তো এখানে একটা ডিউটি করতে এসেছি। আমার কাজ শেষ হবে, তখন আমি আবার আমার আগের কাজে ফিরে যাব।’ মাঝেমধ্যেই মনে প্রশ্ন জাগত যে এখানকার সর্বময় দায়িত্ব কি তিনি উপভোগ করেন না? মূল কিছু সংস্কারের ব্যাপারে তিনি তো খুবই আন্তরিক ছিলেন। রাজনীতি তিনি পছন্দ করেন না। এটা তাঁর সব থেকে বড় ঘাটতি এই ক্ষেত্রে। তিনি যদি সত্যিই সরে যেতে চেয়ে থাকেন, তা কী কারণে?
স্যার, সময় আপনাকে একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব দিয়েছে। আপনার মতো মানুষ এই দায়িত্ব ফেলে চলে যেতে পারবেন না। যা করতে চেয়েছেন সবই করতে পারবেন, এ রকম কি হয়? কিন্তু ন্যূনতম প্রয়োজন বা ন্যূনতম যা করা যায়, তা আপনি নিশ্চয়ই করবেন। সে জন্যই তো আপনি নোবেল লরিয়েট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। যদি বাস্তব দেখে বলি, আপনি ডিসেম্বরে নির্বাচন টার্গেট করতে পারেন। এর মধ্যে যতটুকু সংস্কার করা যায়, তা করেন। রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকেন। আপনার সক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতার কথা তাদের বলেন। তাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানান। এখনো বাংলাদেশের মানুষ আপনাকে ভালোবাসে।
● মাহমুদুর রহমান মান্না সভাপতি, নাগরিক ঐক্য
* মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বল ছ ল ন ড স ম বর পদত য গ ন য নতম প রব ন বল ছ ন এ রকম ব এনপ সরক র প রথম রকম ক আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপির নির্বাচনী যাত্রা শুরু
সব জল্পনার অবসান হলো—বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন করছেন। তিনি ফেনী-১, বগুড়া-৭ ও দিনাজপুর-৩ আসনে প্রার্থী হবেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সোমবার বিএনপি ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তাতে দলের দুই শীর্ষ নেতার নির্বাচন করা এবং তাঁদের নির্বাচনী আসনগুলো নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও-১ আসনে নির্বাচন করবেন।
তারেক রহমান বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন, অনেক আগে থেকেই এমন আলোচনা আছে। তবে অসুস্থতার কারণে এবার খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংশয় ছিল। আবার তাঁর নিজেরও নির্বাচন করার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না।
দলীয় সূত্র বলছে, নির্বাচন ঘিরে নানামুখী শঙ্কা, বিশেষ করে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে নেতৃত্ব দিতে রাজি করানো হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রার্থী হওয়ার ঘোষণায় নেতা-কর্মীরা আনন্দিত।
স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, নানা কারণে আসন্ন নির্বাচন বিএনপির জন্য খুব স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচন করতে রাজি করানোর মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে নির্বাচনের গুরুত্বটা আরও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে নতুন কোনো জটিলতার উদ্ভব হলে, সেটা মোকাবিলায়ও তাঁর ভোটে অংশগ্রহণ পরিস্থিতির ওপর একটা প্রভাব ফেলবে।
জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে সোমবার ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। বাকি ৬৩টি আসনে প্রার্থিতা পরে ঘোষণা করা হবে।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, স্থগিত রাখা কিছু আসনে প্রার্থিতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে। আর কিছু আসন জোট ও সমমনা দলগুলোর প্রার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে, যাদের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে।
ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী, বিএনপির চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির ১২ জন সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। অন্যরা হলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন (কুমিল্লা-১), মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ (ঢাকা-৮), গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (ঢাকা-৩), আবদুল মঈন খান (নরসিংদী-২), আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১০), ইকবাল হাসান মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), সালাহউদ্দিন আহমদ (কক্সবাজার-১), হাফিজ উদ্দিন আহমদ (ভোলা-৩) এবং এ জেড এম জাহিদ হোসেন (দিনাজপুর-১)।
স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। তবে তিনি বলেছেন, এটি প্রাথমিক তালিকা। প্রয়োজন বোধ করলে স্থায়ী কমিটি প্রার্থিতা পরিবর্তন করতে পারবে।
সোমবার বিকেল পাঁচটার দিকে প্রার্থী ঘোষণার আগে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী সভা হয়। সেখানে জুলাই সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়। পরে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকেরাও উপস্থিত ছিলেন।
এবারের প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। তাঁকে ফেনী-৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনে প্রথম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছি। দল আমার ওপর আস্থা রেখেছে, সে আস্থা রাখার জন্য ধন্যবাদ। আমি আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে দেখা করব, সালাম জানাব।’
যে কারণে ঢাকার সাতটি আসন ফাঁকাঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে ১৩টিতে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সাতটি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, ঢাকায় প্রার্থিতা নিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। তাঁদের ধারণা, নির্বাচনী সমঝোতার জন্য আসনগুলোতে প্রার্থিতা স্থগিত রাখা হয়েছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সাতটি আসনের মধ্যে জাতীয় নাগরিক পাটির (এনসিপি) সঙ্গে সমঝোতা হলে তাদের জন্য অন্তত তিনটি আসন ছাড় দেওয়া হতে পারে। এ তালিকায় গণতন্ত্র মঞ্চ, বিজেপি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নামও আছে।
তবে এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।
ঢাকা-৯ আসন স্থগিত রাখা হলেও সেটা কার জন্য, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সেখানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবীব উন নবী খানকে (সোহেল) প্রার্থী করা হতে পারে বলে দলে আলোচনা আছে।
ঢাকা-১৪: মায়ের ডাক-এর সানজিদাঢাকা-১৪ আসনে এবার প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়লেন এস এ খালেকের ছেলে এস এ সিদ্দিক (সাজু)। সেখানে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের ব্যক্তিদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সংগঠক সানজিদা ইসলামকে (তুলি) প্রার্থী মনোনীত করেছে বিএনপি। এই আসনে ইতিমধ্যে জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার মীর আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান)। তিনি আট বছর গুম ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে দলটি অভ্যন্তরীণ জরিপসহ সাংগঠনিক উপায়ে প্রার্থী বাছাই সম্পন্ন করেছে। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের নাম প্রকাশ করে নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করল বিএনপি।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বিগত ১৫-২০ বছর ভোট দিতে পারেনি। এখন জাতি উৎসাহিত হচ্ছে ভোটের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। তিনি বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি পূরণ করার লক্ষ্যে বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণা করে একটা বড় পদক্ষেপ নিল। ইতিমধ্যে অনেকে মাঠে চলে গেছেন, এ ঘোষণার পর বাকিরাও মাঠে যাবেন। এর মাধ্যমে ভোটের একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হবে।
১০ নারী প্রার্থীঘোষিত ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকায় নারী রয়েছেন দশজন। এর মধ্যে অন্যতম বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাকিরা হলেন সিলেট-২ আসনে তাহসিনা রুশদীর, ফরিদপুর-২ আসনে শামা ওবায়েদ ইসলাম, ফরিদপুর-৩ আসনে নায়াব ইউসুফ আহমেদ, মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আফরোজা খান রিতা, শেরপুর-১ আসনে সানসিলা জেবরিন, ঝালকাঠি-২ আসনে ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো, যশোর–২ আসনে সাবিরা সুলতানা, ঢাকা-১৪ আসনে সানজিদা ইসলাম ও নাটোর-১ আসনে ফারজানা শারমিন।
মনোনয়ন না পেয়ে দুই মহাসড়ক অবরোধমাদারীপুর-১ আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করে কামাল জামান মোল্লাকে। এর প্রতিবাদে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী সাজ্জাদ হোসেন লাভলু সিদ্দিকীর অনুসারীরা রাত আটটার দিকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তাঁর অনুসারীরা সন্ধ্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।