সাম্প্রতিক ঘটনাবলি জাতীয় ঐকমত্য গঠনে আমাদের কী ইঙ্গিত দেয়
Published: 27th, May 2025 GMT
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর জনসাধারণের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা নিয়ে এই অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়। সেই সঙ্গে জনমনে এই ভাবনাও তৈরি হয় যে এবার আমরা পারব তো? অন্তর্বর্তী সরকার যে এই প্রত্যাশা যথাযথভাবে মেটাতে পারছে, সেটা খুব জোর গলায় বলা যাচ্ছে না। একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের পর ক্ষমতা গ্রহণ ও জনগণের সব প্রত্যাশা পূরণ খুব সহজ কাজ নয়।
আমাদের মধ্যে একটি দৃঢ় ধারণা ছিল যে এবার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে তোলা যাবে। সেই পথে আমরা কতটা সফল হতে পারছি, তা সময়ই বলে দেবে।
তবে সাম্প্রতিক কিছু বিষয় জনসাধারণের মধ্যে সেই পথে হাঁটার দ্বিধা ও কিছু হতাশা তৈরি করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এমনই সময় প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের আলোচনা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফেরত যাওয়ার চলমান সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে।
আরও পড়ুনঅধ্যাপক ইউনূস থাকছেন, সংকট কতটা কাটল ৫ ঘণ্টা আগেআশার কথা হলো, প্রধান উপদেষ্টা থাকছেন। আমরা আশা করব, খুব শিগগির অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে একটি মতৈক্যে পৌঁছা যাবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য কাজ করে যাওয়া বর্তমান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কারণ, অন্তর্বতী ব্যবস্থাকে যতই দীর্ঘায়িত করা হবে, এমন সংকট বৃদ্ধির আশঙ্কাও বাড়বে।
যদিও সরকারের একজন উপদেষ্টা মন্তব্য করেছেন যে কেবল নির্বাচন করার জন্য তাঁরা দায়িত্ব নেননি। নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কিছু বক্তব্য বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেলেও জাতীয় নির্বাচনের যথাযথ দিকনির্দেশনা সেখানে অনুপস্থিত ছিল। তাই একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক নূরুল কবীরের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার খুবই প্রণিধানযোগ্য। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা গত ৯ মাসে ক্রমেই হ্রাস পেয়ে চলেছে।’ বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ বিষয়ে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করছে। বিএনপি নানা সময় নির্বাচন নিয়ে কথা তুললেও অন্য দলগুলোর ভূমিকা তেমন একটা উচ্চকিত নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে যাঁরা এ ধরনের ধোঁয়াশা তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন, তাঁদের ভূমিকা নিয়েও সরকারের পুনর্বিবেচনা করা উচিত। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গেও একটি স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক সংলাপ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ ধরনের জাতীয় স্বার্থবিষয়ক বিষয়াবলির সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এতে করে সরকারের সঙ্গে অংশীজনদের দূরত্ব তৈরি হবে না।আর জনগণ দেখতে পাচ্ছে না সংস্কার নিয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি। নব্বইয়ের পর আমাদের দেশের মানুষের কাছে নির্বাচন যে একটি উৎসবে পরিণত হয়েছিল, সেই উৎসবের স্বাদ থেকে আমরা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত। বিগত আওয়ামী সরকারের সময় নির্বাচন ছিল একটি দুঃস্বপ্নের নাম।
অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে অতিদ্রুত নির্বাচন করার মতো সংস্কারের মাধ্যমে একটি রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করা, যাতে জনমনে আস্থা গড়ে ওঠে। সংস্কারের অজুহাত দিয়ে যেন নির্বাচন পেছানোর প্রয়াস করা না হয়।
আরও পড়ুনঅন্তর্বর্তী সরকার কতটা সবার হতে পারছে২৬ মে ২০২৫এ প্রসঙ্গে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম মনে করেন, ‘সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যে একটি অপ্রয়োজনীয় বিভাজন তৈরি করা হয়েছিল এবং ২০২৫–এর ডিসেম্বরের মধ্যেই দুটোই করা সম্ভব।’ এই বিভাজন দূর করার জন্য এই সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। দেশের জনগণও অধীর আগ্রহে সেদিকেই তাকিয়ে আছে।
আরও দুটি বিষয় অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে জনসাধারণের দূরত্ব তৈরির পেছনেও ভূমিকা রাখছে। এগুলো হলো মানবিক করিডর ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া। অন্তর্বর্তী ব্যবস্থায় এমন জনগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হচ্ছে। বিএনপি পরিষ্কারভাবে এ বিষয়ে তাদের অবস্থান প্রকাশ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বেশির ভাগ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া ও বাস্তবায়ন করার মতো ‘ম্যান্ডেট’ এই সরকারের রয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
অপর দিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের এক বক্তব্যে জানা গেছে যে তাঁরা মনে করেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান তাঁদের সেই ‘ম্যান্ডেট’ দিয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বলা হয়েছে যে তারা মানবিক করিডর নিয়ে কারও সঙ্গে এখনো আলোচনা করেনি।
মানবিক করিডর বা প্যাসেজ যে নামেই ডাকি না কেন, তা একটা জটিল বিষয়। এর সুদূরপ্রসারী ভূমিকা কী হবে, সেটিও ভেবে দেখা দরকার। বিষয়টি এই অঞ্চলের জটিল ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে জটিলতর করে তুলতে পারে বিধায় তা নিয়ে বিস্তর আলোচনার সুযোগ রয়েছে। সুতরাং তা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করাই উত্তম। এই বিষয়গুলো এতটা জরুরি না যে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তেমনটা হলে রাজনৈতিক দলসহ অন্য অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনার ভিত্তিতেই করা আবশ্যক।
সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে পরিষ্কার দিকনির্দেশনার অভাব ও জাতীয় স্বার্থসংবলিত বিষয়ে নানাবিধ বিতর্কিত মন্তব্য প্রদান এই অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকাকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে করে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি না হয়।
আরও পড়ুনরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে১৮ মে ২০২৫অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে যাঁরা এ ধরনের ধোঁয়াশা তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন, তাঁদের ভূমিকা নিয়েও সরকারের পুনর্বিবেচনা করা উচিত। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গেও একটি স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক সংলাপ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ ধরনের জাতীয় স্বার্থবিষয়ক বিষয়াবলির সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এতে করে সরকারের সঙ্গে অংশীজনদের দূরত্ব তৈরি হবে না।
আমরা বারবার দেশ গঠনের সুবর্ণ সুযোগ হারিয়েছি। স্বাধীনতার পরের সুযোগকে ‘বেহাত বিপ্লব’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের পরও তেমন উল্লেখযোগ্য ও মৌলিক বদল আনা যায়নি।
আবার আমরা সেই পথে হাঁটতে চাই না। তাই জনগুরুত্বপূর্ণ ও জাতীয় স্বার্থবিষয়ক সিদ্ধান্ত একটি ঐকমত্যের মাধ্যমে নেওয়ার চর্চা জারি রাখা জরুরি। রাজনৈতিক ও সামগ্রিক জাতীয় ঐকমত্য গঠনে একটি কমিশন কাজ করে যাচ্ছে। তবে পাশাপাশি যদি একে অপরের ওপর আস্থা তৈরি করা না যায়, তাহলে সেই ঐকমত্য কীভাবে গড়ে উঠবে? তাই এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে করে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক র জন ত ক সরক র র এ ধরন র ব যবস থ ঐকমত য অ শ জন র জন য দলগ ল
এছাড়াও পড়ুন:
অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া ছাড়া ঐকমত্য কি টেকসই হবে
বর্তমানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের অংশীদারদের সঙ্গে একধরনের আলোচনা প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এর লক্ষ্য হলো ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন সাংবিধানিক কাঠামো, প্রতিনিধিত্বশীল শাসন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক চুক্তি গঠনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আলোচনার পরিধি, কাঠামো ও অংশগ্রহণকারীদের বাছাই কতটা ন্যায়সংগত ও প্রতিনিধিত্বমূলক হচ্ছে?
বাংলাদেশ এখন একধরনের রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বস্তরে আধিপত্য বিস্তার করেছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক নির্বাচন ছিনতাই করেছে, বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করেছে, গুম-খুন চালিয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতা–কর্মী রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র–জনতার ওপর সহিংস হামলা চালায়। যেভাবে এই হামলা চালানো হয়েছিল, তা ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ। গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন নয়।
আরও পড়ুনক্ষমা না চাইলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার নেই২০ অক্টোবর ২০২৪এ রকম বাস্তবতার মধ্যেও আমরা যদি শুধু শাসক দলটির পতনকেই গণতন্ত্রের পূর্ণ বিজয় ধরে নিই, তাহলে তা হবে একটি ‘অর্ধসত্য’। কারণ, কোনো ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা শুধু সরকার বা প্রশাসনই তৈরি করে না, তা একটি দীর্ঘমেয়াদি মানসিক কাঠামোও গড়ে তোলে।
এই কাঠামোর অংশ হয়ে যায় কিছু গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান, এমনকি অনেক সাধারণ মানুষও—যারা হয়তো সরাসরি দমননীতি চালায়নি; কিন্তু চুপ থেকেছে, কিছু না দেখে থাকার ভান করেছে কিংবা নিরাপত্তা ও সুযোগের বিনিময়ে নির্যাতনকে বৈধতা দিয়েছে।
এই মানসিক কাঠামোর ভাঙন কেবল একজন শাসকের পতনেই শেষ হয় না; এটি সম্পূর্ণ হয়, যখন আমরা সাহস করে সেই মানুষদের কথাও বলি—যারা সরাসরি অন্যায় করেনি, কিন্তু চুপ থেকেছে বা নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে অন্যায় মেনে নিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কী করব? আমরা কি শুধু অপরাধীদের শাস্তি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকব, নাকি একটি ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলার কথা ভাবব?
আরও পড়ুনআওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের পর গ্রামগঞ্জের কর্মী-সমর্থকেরা কী ভাবছেন০৬ জুন ২০২৫একটি ‘সরল’ প্রশ্ন২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন ছিল জালিয়াতি ও প্রহসনের নির্বাচন। এ কারণে এ নির্বাচনগুলোর ভোটের ফলাফল বিবেচনায় নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আমার প্রশ্ন একেবারে মৌলিক এবং সরল। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট পেয়েছিল। দেশের অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটার একাধিকবার এই দলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল।
এবার যখন একটি নতুন গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সূচনা হচ্ছে, তখন কি এই বিশাল জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অবস্থান, চিন্তা ও মতামত পুরোপুরি উপেক্ষা করা হবে—এই প্রশ্নটি হয়তো অনেকেই বিবেচনায় নিচ্ছেন না।
কেউ কেউ হয়তো ভয় পাচ্ছেন—যেন তাঁদের গায়ে ‘দোসর’ বা ‘দালাল’–জাতীয় কোনো ট্যাগ না লেগে যায়। এ এক নতুন ধরনের পরিস্থিতি, যেখানে সমালোচনার বদলে চলে প্রমাণ ছাড়াই সন্দেহ আর কণ্ঠ রুদ্ধ করার প্রতিযোগিতা!
অনেকেই বলছেন, আওয়ামী লীগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত দলকে কেন সুযোগ দেব? এই দলের সমর্থকেরা এখনো খোলাখুলিভাবে অনুশোচনা প্রকাশ করেনি, ক্ষমা চায়নি। এই ব্যাপারটা খুবই বিস্ময়কর যে এই দলের সমর্থকেরা কীভাবে এতটা অনুশোচনাহীন হতে পারে? তারা আত্মসমালোচনা না করে এখনো ‘কনস্পাইরেসি থিওরি’ (ষড়যন্ত্র তত্ত্ব) নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে।
কিন্তু আমরা কি প্রশ্ন তোলা বন্ধ করে দেব? এই প্রেক্ষাপটেই বরং আমাদের আরও বেশি করে প্রশ্ন করতে হবে ভবিষ্যতের ইতিহাসে আমাদের সামষ্টিক ভূমিকা যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।
বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের ভোটার সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না হলেও ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় বিশ্বাসী দল বা মতকে সমর্থন করেন, নির্বাচনের সময় এই মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের ভোট দেন। আমরা কি পরিপক্ব ও দায়িত্বশীল উদ্যোগ নিয়ে তাঁদের একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন করে তাঁদেরকে ঐকমত্যের আলোচনার মঞ্চে আনতে পারতাম না?
আরও পড়ুনসংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ফেরার শঙ্কা যেখানে০৭ জুলাই ২০২৫আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাবিশ্বজুড়ে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনের পর যদি নতুন রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণের সময় শুধু প্রতিশোধ বা একচেটিয়া পক্ষপাতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তবে তা খুব কম ক্ষেত্রেই টেকসই হয়। সফল এবং স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য প্রয়োজন হয় আলোচনার, ক্ষমা ও অংশগ্রহণের এক প্রজ্ঞাপূর্ণ ভারসাম্য।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের পতনের পর নেলসন ম্যান্ডেলার উদ্যোগে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠিত হয়। এর লক্ষ্য ছিল, শুধু অপরাধী চিহ্নিত করা নয়, বরং একটি গভীর সামাজিক সংলাপের মাধ্যমে বিভক্ত জাতিকে পুনর্মিলনের দিকে নিয়ে আসা।
একইভাবে রুয়ান্ডার ১৯৯৪ সালের গণহত্যার পর ‘গাকাকা আদালত’ নামে একধরনের ‘কমিউনিটি বেইজড’ বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, যেখানে অপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি সহাবস্থানের নৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়।
লাতিন আমেরিকার বহু দেশেও ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন ফোরাম’-এর মতো কাঠামো দেখা গেছে; যেখানে অপরাধ, অপরাধী ও অনুশোচনা—সব কিছুকে যুক্ত করে সমাজে একটি নতুন সম্মিলিত চুক্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে।
আরও পড়ুনজাতিসংঘের প্রতিবেদন: আওয়ামী লীগের সামনে কী অপেক্ষা করছে১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫রাষ্ট্রবিজ্ঞানের খ্যাতিমান পণ্ডিত আরেন্ড লাইপহার্ট তাঁর ‘কনসোসিয়েশনাল ডেমোক্রেসি’ তত্ত্বে বলেন, বিভক্ত সমাজে যদি টেকসই গণতন্ত্র গড়ে তুলতে হয়, তবে সব বড় গোষ্ঠীকেই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; তারা পূর্বতন শাসকের সমর্থক হোক বা না হোক।
একইভাবে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন দ্য থার্ড ওয়েভ: ডেমোক্র্যাটাইজেশন ইন দ্য লেট টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি বইয়ে দেখিয়েছেন, গণতান্ত্রিক উত্তরণ তখনই টেকে, যখন নতুন শাসকগোষ্ঠী প্রতিপক্ষকে শত্রু নয় বরং অংশীদার হিসেবে দেখে।
বর্তমানে ঐকমত্যের আলোচনা প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করছেন; কিন্তু যাঁরা কোনো দলের মধ্যে নেই, তাঁদের জন্য একটি স্বাধীন ও সম্মানজনক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেত কি না, সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
আরও পড়ুনআওয়ামী লীগের নেই অনুশোচনা, ষড়যন্ত্র তত্ত্বে ভরসা১১ নভেম্বর ২০২৪বর্তমান বাস্তবতা ও রাজনৈতিক পূর্বাভাসঅনেকেই মনে করছেন যে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করতে পারবে না কিংবা করবে না। আওয়ামী লীগের অতীত ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। আওয়ামী লীগ সব সময়ই কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে। এমনকি রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও দলটি পুরোপুরি নির্বাচন বর্জনের পথে হাঁটেনি। কাজেই ভবিষ্যতে হয়তো নতুন কোনো নাম বা কাঠামোয় অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাধ্যমে হলেও দলটি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে—এমন সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমানে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি এমন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, যিনি সব সময় মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও সামাজিক সংহতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকার এবং বক্তৃতায় ইউনূস কখনোই আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেননি। তিনি বরং আওয়ামী লীগকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে দলটি গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসে।
আরও পড়ুনআওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা উচিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে৩০ অক্টোবর ২০২৪এ থেকে প্রতীয়মান হয়, ইউনূসের মধ্যে একধরনের ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন’ কৌশল কাজ করছে, যেখানে অপরাধের বিচার হবে, কিন্তু রাজনীতির ময়দানে প্রতিপক্ষকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করা হবে না।
এ ছাড়া জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পর্যবেক্ষণেও দেখা যাচ্ছে, তারা আওয়ামী লীগের অপরাধের বিচার চাইলেও দল হিসেবে নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী নয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২৪ সালের আগস্টে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘যদিও আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন সংঘটিত হয়েছে, তবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন এবং পূর্ণ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।’
যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত এক বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের পক্ষে থাকলেও রাজনৈতিক বহুত্ববাদ নির্মূলের বিপক্ষে।’
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সব গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনই হলো বাংলাদেশের জন্য বৈধতা পুনঃস্থাপনের একমাত্র পথ।
আগামী নির্বাচন যদি যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়, তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল আসবে কি না—তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে, ইউনূসের মতো একজন সংবেদনশীল নেতার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ না করেই কি নির্বাচন হবে?
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি অংশগ্রহণ করে তাহলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ভোট পেতে পারে, কিছু জরিপে এমন ফলাফল পাওয়া গেছে। এমন একটি দল, যাদের শতকরা ১৫-২০ শতাংশ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেই দলের সমর্থক বা প্রতিনিধিদের একেবারে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক রূপরেখা কতটা যুক্তিসংগত বা টেকসই হবে—তা নিয়ে এখনই প্রশ্ন তোলা দরকার।
আরও পড়ুনভারতের নীতিতে আওয়ামী লীগ–নির্ভরতা ও অপতথ্যের রাজনীতি০৫ ডিসেম্বর ২০২৪কিছু জরুরি প্রশ্নএই পরিস্থিতিতে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে তা হলো, আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা হত্যা, সন্ত্রাস, মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিল না, তারা কি একটি নতুন রাজনৈতিক কাঠামোয় ভিন্ন নামে অংশ নিতে পারবে? তাদের পুরোপুরি উপেক্ষা করা কি ঠিক হবে? সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, ধর্মনিরপেক্ষ ভোটার এবং একসময় আওয়ামী লীগ-ঘরানার আদর্শে বিশ্বাসী অনেক নাগরিক এখন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও সমাজে তাদের উপস্থিতি রয়েছে। তাহলে রাজনীতিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে না?
ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এই মত বা অবস্থানগুলো কোথাও দৃশ্যমান নয়। কমিশন কি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী কাঠামো গঠনের বিষয়টি আমলে নেবে না? আমরা কি এমন একটি প্রক্রিয়া দেখছি, যা ভবিষ্যতের জন্য আরেকটি সংকট তৈরি করছে?
মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
*মতামত লেখকের নিজস্ব
আরও পড়ুনআওয়ামী সমর্থকেরা কাকে ভোট দেবে২৮ জুন ২০২৫