একটি মিষ্টি আলু থেকে কি সত্যিই রোজকার প্রয়োজনের চার গুণ ভিটামিন পাওয়া যায়?
Published: 2nd, June 2025 GMT
মিষ্টি আলু দারুণ পুষ্টিকর খাবার। এতে আছে প্রচুর ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি৬, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজসহ বহু পুষ্টি উপাদান। শর্করাও আছে বেশ খানিকটা; তাই মিলবে অনেকটা ক্যালরিও। সেদ্ধ মিষ্টি আলু সহজপাচ্য। বাড়ন্ত শিশুর জন্য দারুণ খাবার। তবে খাদ্যতালিকায় যেকোনো খাবার যোগ করার আগে এর ভালোমন্দ বিবেচনা করা জরুরি, বিশেষত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। আর কীভাবে খাওয়া হলে পুষ্টি উপাদান দেহের সবচেয়ে বেশি কাজে আসবে, তা–ও জানা থাকা চাই। এমনটাই বলছিলেন ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ তামান্না চৌধুরী। মিষ্টি আলুর পুষ্টিগুণের বিস্তারিত জেনে নিন তাঁর কাছ থেকেই।
কতটা ভিটামিন পাবেনএটা ঠিক যে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের যতটা ভিটামিন এ প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেকটাই বেশি পাবেন একটি মিষ্টি আলু থেকে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় ঠিক কতটা বেশি পাচ্ছেন, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব মেলানো কঠিন। নারী ও পুরুষের জন্য এই হিসাব আলাদা। আকার-আকৃতির জন্য মিষ্টি আলুর ওজনের সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টি উপাদানেরও তারতম্য হয়। তাই একটি মিষ্টি আলু থেকে আপনি প্রয়োজনের ঠিক কতটা পাচ্ছেন, তা বলা মুশকিল। তবে একটি মাঝারি আকারের মিষ্টি আলু থেকে নিঃসন্দেহেই প্রয়োজনের বেশি ভিটামিন এ পেয়ে যাবেন। কতটা বেশি পেলেন, সেই হিসাব করা জরুরি নয়। ভিটামিন বি৬–ও পাবেন বেশ খানিকটা। তবে এতে ভিটামিন সি থাকলেও সেদ্ধ করার সময় উত্তাপে সেই ভিটামিন নষ্ট হয়ে যায়।
আরও পড়ুনশরীর ও মনের জন্য অত্যন্ত জরুরি ভিটামিন বি-১২–এর শোষণ বাড়াবেন কীভাবে৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ভিটামিনের উপকাররোজ একটি মিষ্টি আলু খেলে যে পরিমাণ ভিটামিন এ পাবেন, তা স্বাভাবিক অবস্থায় আপনার ত্বক ও চোখ ভালো রাখার জন্য যথেষ্ট। ভিটামিন এ অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। তাই মিষ্টি আলু খেলে আপনার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়বে। ত্বকের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে ভিটামিন এ। মিষ্টি আলুতে থাকা ভিটামিন বি৬ স্নায়ু সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।
আরও আছে যাপটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও আয়রনও পাবেন মিষ্টি আলুতে। পানি ও পর্যাপ্ত আঁশও মিলবে। রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে পটাশিয়ামের মাত্রা ঠিক রাখা প্রয়োজন। সার্বিক সুস্থতার জন্য বাকি উপাদানগুলোও জরুরি। বিশেষত ত্বকের সুস্থতার জন্য চাই পানি। পর্যাপ্ত আঁশ গ্রহণ করলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হবে। রক্তে খারাপ চর্বির মাত্রা কমবে। তবে উদ্ভিজ্জ উপাদান বলে মিষ্টি আলুর আয়রন দেহে খুব ভালোভাবে শোষণ না-ও হতে পারে।
আরও পড়ুনমুরগির হাড় চিবানো আসলেই কি ভালো০৮ নভেম্বর ২০২৪খেয়াল রাখুন ক্যালরির হিসাবনিকাশমিষ্টি আলুতে শর্করার পরিমাণ বেশি। অর্থাৎ ক্যালরির মাত্রাও বেশি। তাই তা নিয়মিত খেতে চাইলে অবশ্যই ভাত, রুটি বা অন্য কোনো শর্করাজাতীয় খাবারের পরিবর্তে খেতে হবে। রাতের মূল খাবার হিসেবে মিষ্টি আলু খাওয়া যেতে পারে, সঙ্গে থাকতে পারে মাছ কিংবা মুরগির মাংস। স্ন্যাকস হিসেবে মিষ্টি আলু খাওয়া যাবে না। কারণ, স্ন্যাকস হিসেবে মিষ্টি আলু খাওয়া হলে আপনার দেহের চাহিদার বেশি শর্করা গ্রহণ করা হয়ে যাবে। যোগ হবে বাড়তি ক্যালরি। এভাবে একসময় ওজন বাড়তে পারে যে কারও।
তা ছাড়া যাঁদের রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড (একধরনের চর্বি) কিংবা সুগারের মাত্রা বেশি, তাঁদের ক্ষেত্রে এসব সমস্যা বেড়ে যেতে পারে, যদি তাঁরা মিষ্টি আলু গ্রহণ করেন স্ন্যাকস হিসেবে। বুঝতেই পারছেন, মিষ্টি আলুর উপকার পেতে হলে শর্করা এবং ক্যালরির হিসাবটা খেয়াল রাখা খুব জরুরি।
১০০ গ্রাম ভাত থেকে আপনি ১১২ কিলোক্যালরি পান, ১০০ গ্রাম মিষ্টি আলু থেকে পাবেন ৯৭ কিলোক্যালরি। পরিমাণ বুঝে খাওয়া হলে ভাত বা রুটির মতো খাবারের স্বাস্থ্যকর বিকল্প হতে পারে মিষ্টি আলু; কারণ, ভাত বা রুটি থেকে আপনি মিষ্টি আলুর মতো ভিটামিন বা খনিজ উপাদান পাবেন না।
আরও পড়ুনম্যাগনেশিয়াম-সমৃদ্ধ সুপার হেলদি ৮ খাবার৫ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বিরল বালুচাটার সন্ধানে
১৪ বছর আগের কথা। বিরল ও দুর্লভ পাখির প্রজনন প্রতিবেশ নিয়ে গবেষণার কাজে পঞ্চগড় এসেছি। বোদা, আটোয়ারী, দেবীগঞ্জ ও পঞ্চগড় সদরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে গাঙটিটি, হলুদ লতিকা হট্টিটিসহ বেশ কিছু প্রজাতির পাখি দেখলাম। সবশেষে ভারত সীমান্তবর্তী তেঁতুলিয়ার কাজীপাড়া এসে ওদের সঙ্গে যোগ হলো অতি বিরল শেখ ফরিদ বা কালো তিতির। কিন্তু এসব পাখির মা ক্ষণে ক্ষণেই খুঁজছিলাম চড়ুই আকারের অতি বিরল আরেকটি পাখিকে। তেঁতুলিয়া শহরের রাস্তার পাশে এই পাখিকে ২০১০ সালে বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী প্রয়াত মুনির আহমেদ খান ও তাঁর স্ত্রী পক্ষী আলোকচিত্রী তানিয়া খান দেখেছিলেন। এর পর থেকেই পাখিটিকে দেখার ইচ্ছা। কিন্তু মাত্র এক বছর পর জায়গামতো বারবার গিয়েও পাখিটির দেখা পেলাম না।
এরপর ২০১৭ সাল পর্যন্ত আরও তিনবার তেঁতুলিয়া গেলাম। কিন্তু ফলাফল একই। অবশ্য ২০২০ সালে একজন আলোকচিত্রী রাজশাহীর পদ্মার চরে পাখিটির দেখা পান। এরপর ২০২৩ সালে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার বেড়ামন গাঁও চরে বার কয়েক দেখা গেল। অনেকেই ছবি তুললেন। খবর পেয়ে ১১ নভেম্বর পাখিটির সন্ধানে পাখিপ্রেমী আমরা ১১ জন শীত শীত ভোরে ঢাকা থেকে রওনা হলাম। মাওয়ার পুরোনো ফেরিঘাটে নেমে জাকির মাঝির ইঞ্জিন নৌকায় চরের দিকে রওনা হলাম। পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে আমাদের নৌকা যাওয়ার সময় সেতুর সঙ্গে একটা ফটোসেশন হয়ে গেল।
ঠিক ৫০ মিনিট প্রমত্ত পদ্মার বুকে চলার পর নৌকা চরে ভিড়ল। চরের মাটিতে পা রাখতেই স্ত্রী পাখিটির দেখা পেয়ে গেলাম। যে পাখিকে দীর্ঘ সাত বছর ধরে খুঁজছি, আজ তাকে অতি সহজে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লাম। স্ত্রী পাখিটির প্রথম ছবি তোলার ১১ মিনিট পর পুরুষটির দেখা পেলাম। কিন্তু ওর একটি ভালো ছবি তোলার জন্য প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলো। পরে পাখিটিকে শেরপুরেও দেখা গেল।
এতক্ষণ বিরল যে পাখিটির গল্প বললাম, সেটি এ দেশের আবাসিক পাখি বালুচাটা বা ধুলচাটা। ইংরেজি নাম অ্যাশি-ক্রাউন্ড স্প্যারো-লার্ক বা ফিঞ্চ-লার্ক। অ্যালাইডিডি গোত্রের এই ভরত পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Eremopterix grisea। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাস করে।
বালুচাটা চড়ুই আকারের কীটপতঙ্গভুক পাখি। দেহের দৈর্ঘ্য ১২ থেকে ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন ১৪ থেকে ২০ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী ও পুরুষের চেহারায় ভিন্নতা রয়েছে। পুরুষের মাথার চাঁদি ও ঘাড়ের পেছনটা ধূসর-বাদামি। চোখ বরাবর চওড়া কালো পট্টি। পিঠ বালু-বাদামি। ডানার পালক কালচে ছোপছাপে ভরা। গাল থেকে কান-ঢাকনি ও বুকের দুই পাশ ময়লা সাদা। গলার অর্ধেকটায় কালো রঙের ফিতে। বুক-পেট ও দেহের নিচ চকলেট কালো। অন্যদিকে স্ত্রী একবারেই সাদামাটা। পিঠ ও দেহতলের ওপরে কিছু সূক্ষ্ম লম্বালম্বি দাগসহ দেহ পুরোপুরি বালু-বাদামি। স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে চঞ্চু খাটো ও ত্রিকোণাকার, রং হালকা, শিং-ধূসর। চোখ লালচে/হলদে-বাদামি। পা, পায়ের পাতা ও নখ মেটে-বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে অনেকটা মায়ের মতো।
এ পর্যন্ত এদেরকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, মুন্সিগঞ্জের লৌহজং ও শেরপুরের চরাঞ্চলে দেখা গেছে। খোলামেলা শুষ্ক পাথুরে এলাকা, কণ্টকময় ঝোপঝাড় ও ঘাসে ঢাকা পরিত্যক্ত খেত, বালুময় নদীতট বা শুকনা জোয়ার–ভাটার কাদাচরে এরা বিচরণ করে। সচরাচর জোড়ায় বা ছোট দলে বালুমাটিতে ঘোরাঘুরি বা ধূলিস্নান করতে দেখা যায়। তবে শীতে বড় দলে থাকতে পারে। মাটিতে হেঁটে হেঁটে শুকনা ধূলিময় ভূমি ঠুকরে বিভিন্ন ধরনের বিচি, শক্ত খোলসযুক্ত পোকামাকড়, পিঁপড়া ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ খায়। পুরুষ পাখি বৃত্তাকারে উড়ে উড়ে বাঁশির মতো ‘টুইল-ডিডল-ডিডল...’ স্বরে গান গায়।
বছরের যেকোনো সময় প্রজনন করতে পারে। মাটির প্রাকৃতিক খোদলে ঘাস, পালক ও চুল বিছিয়ে বাসা বানায়। বাসার চারদিকে নুড়ি পাথর দিয়ে বেষ্টনী দেয়। অল্প দূরত্বের মধ্যে একাধিক বাসা পাওয়া যায়। ডিম পাড়ে ২ থেকে ৩টি; রং ধূসর-সাদা বা ফিকে হলুদ, তাতে থাকে বেগুনি ও বাদামি ফুটকি ও ছোপ। ডিম ফোটে ১১ থেকে ১৪ দিনে। ১০ থেকে ১২ দিনে ছানারা উড়তে শেখে। মা-বাবা মিলেমিশে ডিমে তা দেওয়া এবং ছানাদের লালন পালন করে। আয়ুষ্কাল প্রায় চার বছর।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ