বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সেখানে পর্যটন সীমিত করা হয়েছে। ডিসেম্বর-জানুযারি—এ দুই মাসে প্রতিদিন নির্দিষ্টসংখ্যক পর্যটক দ্বীপটিতে যেতে পারেন। ঐতিহ্যগতভাবে মাছ ধরা ছাড়া অন্য কোনো পেশা এখানে নেই বললেই চলে। বালুমাটি ও লবণপানির কারণে কৃষির সুযোগও একেবারে সীমিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যটন ঘিরেই মূলত দ্বীপটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চাকা সচল থেকেছে। ফলে পর্যটন সীমিত হওয়ায় এমনিতেই ৮ বর্গকিলোমিটারের দ্বীপটির প্রায় ১১ হাজার বাসিন্দার জীবিকা সংকটের মুখে পড়েছে।
পর্যটকেরা সেন্ট মার্টিনে যেতে না পারলেও দ্বীপটির বাসিন্দারা ট্রলারে করে টেকনাফে যেতে পারেন। চাল, ডাল, আলু, তেল, ডিম, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য টেকনাফ থেকেই দ্বীপটিতে যায়। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের কারণে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা বিরূপ আবহাওয়ার কারণে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন পথে ট্রলার চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে দ্বীপটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। চাহিদার তুলনায় জোগান কমে গেলে অর্থনীতির চিরাচরিত সূত্র অনুযায়ীই দাম বাড়বে।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, সেন্ট মার্টিনে একটি ডিম ১৮-২০ টাকায়, ১ কেজি আলু ৫০ টাকায় এবং সবজির কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জীবিকা ও আয়ের সুযোগ বড়ভাবে সংকুচিত হয়ে আসা একটা জনপদের বাসিন্দাদের পক্ষে এতটা বাড়তি ব্যয় করে খাদ্যপণ্য কেনা কতটা দুঃসাধ্য হতে পারে, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।
উপজেলা খাদ্যগুদামের কর্মকর্তার বরাতে আমরা জানতে পারছি, ১৫ দিন আগে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জন্য বরাদ্দ করা ভিজিডি, ভিজিএফসহ খাদ্যসহায়তার চাল এসেছে। ফলে চালের সংকট হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু ভাত খেয়ে তো মানুষ দিন পার করতে পারবে না। চালের সঙ্গে তাদের জন্য অন্যান্য খাদ্য উপকরণও লাগবে।
সেন্ট মার্টিনের বর্তমান সংকটকে শুধু বৈরী আবহাওয়ার কারণে সৃষ্ট সংকট হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। আবহাওয়া ভালো হলে দু–এক দিনের মধ্যে এবারের সংকট কেটে যাবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এটা আমাদের দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনার বড় দুর্বলতারও প্রতিফলন। শুধু চালকে ত্রাণসহায়তা হিসেবে দেওয়ার যে রেওয়াজ, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। এ সময়ে নগদ সহায়তা ভুক্তভোগীদের অনেক উপকারে আসে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, সেন্ট মার্টিনের বাজারে পণ্য সরবরাহ যাতে স্বাভাবিক থাকে, তার বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। জরুরি পরিস্থিতিতে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর জাহাজ অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেই পারে।
পর্যটন সীমিত হওয়ায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বাসিন্দাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যাপারেও সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখা দরকার, অভাব, দারিদ্র্য দীর্ঘ মেয়াদে অস্থিরতা ও অসন্তোষ তৈরি করতে পারে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বকরি ঈদের গেরান
বকরি ঈদের চান উঠনের ১০ দিনের দিন বকরি ঈদ। মাগার যার আওকাত আছে, অর বাড়িতে হাটে যায়া গরু-বকরি দ্যাখন, দাম দস্ত্তুরকরণ শুরু অয়া যায় ঈদের এক হপ্তা আগে থেকা। আগে অহনকার মথন ঘরে ঘরে গরু কোরবানি অইতো না।
মাগার যে বাড়িতেই বকরি ঈদে গরু আহুক, মহল্লার সব পোলাপান ঐ গরু লিয়া দিন-রাইত পেরেশান থাকতো, আর বকরি ঈদের খুশি কেউর কম পড়তো না। যারা কোরবানি দ্যায়, অগো পোলাপান ঈদের নয়া কাপড়লত্তার ধার ধারে না, অগো গরু অইলেই চলে। অহন তো গরুর লগে ফ্রিজ কিননের ধুম লাইগা যায় যারা কোরবানি না দ্যায় অগো ভিতরে বি। বকরি ঈদে কেউ কোরবানি না দিলে বি গোশত থাকে আঢালা সব বাড়িতে। বকরি ঈদে যারা কোরবানি দ্যায়, অরা আপনা এ্যাগানা সবতের কোরবানির গোশত বাইটা চিরা খায়।
আগে ঢাকাইয়া গো ভিতরে বকরি ঈদে মাইয়ার হৌড় বাড়িতে আলাম গরু পাঠানের রেওয়াজ আছিলো না। যার উপরে কোরবানি দেওয়ার ওয়াজিব, ওই আপনা ট্যাকায় কোরবানি দিবো– এইটাই হুকুম। ঐসমে বিয়াই বাড়িতে কোরবানির রান পাঠানের রেওয়াজ আছিলো, অহন তক এই রেওয়াজ আছে। ঢাকাইয়ারা খালি মাইয়ার হৌড় বাড়িতে গরুর রান পাঠায় না, পোলার হৌড় বাড়িতে বি গরুর আলাম রান পাঠায়। মাগার কিছু নয়া পয়সাআলারা বিমাইরা এক হড়িপিতে নাইমা মাইয়ার হৌড় বাড়িতে আনাম গরু পাঠায়া নিজের আওকাত বুঝানের কোশিস করে। এইসব ফুটানি নয়া পয়সাআলারা দ্যাখায়। ঢাকাইয়া রহিস ঘরানার মাইনষে এইসব বাইলা ফুটানির বাতে নাই।
ঢাকাইয়ারা বকরি ঈদের এন্তেজার করে বহুত দিলে জাহাসে। এইটার মূল ওয়াজা অইছে কোরবানির গোশতের বহুত খোশবুদার কোর্মা। হাড্ডি ছাড়া বড়ো বড়ো গোশতের টুকরা চর্বিতে ডুবায়া ভুনা ভুনা কইরা বহুত দিন রাইখা দেওনের পন্থা জানে ঢাকাইয়ারা। বকরি ঈদে কোরবানির গোশত গরমকরনের সমে যে গেরান বাইর অহে, ঐটার গেরান পুরান ঢাকার গল্লি কুনছির বাতাসে ঘুইরা মাইনষের নাক দিয়া মগজ তক যায়া হান্দাইতো। ঐ কোর্মার মজাদার খোশবুতে সব ঢাকাইয়া মাতোয়ারা। আর ঐ কোর্মার ঝুরি গোশত ঝুরঝুরা মুচমুচা ঝুরি গোশতের লগে খাস্তা নিমসুকা রুটি, আহা! ঐটার সামনে বেহেস্তি খানা ক্যায়া চিজ? আমি কইবার পারুম না। বকরি ঈদের বাদে গোশত খতম অহন না তক সবতে ঐ গোশত খাওনে ডুইবা থাকতো। আমি ঐ কোর্মার কথা কয়া খতম করবার পারুম না। গরম গরম ভাত আর ঐটার লগে কোর্মার এক টুকরা গোশতের লগে কাঁচা পিঁয়াইজ আর কাঁচামরিচ বা ত্যালে টালা হুকনা মরিচ, ঐটাই কাফি, আর কিছু লাগে না।
ঐ কোর্মা পোলাও, খিচুড়ি, ভাত, রুটি পারাটা, নান, নিমসুকা রুটি দিয়া খায়। যতোই খাও, প্যাট ভইরা যাইবো, মাগার জি ভরবো না। যুদি কুনু ঢাকাইয়া কেউ কইবো আমি ঐ কোর্মা খাই না, তাইলে আমরা কমু ওই সরাসর মিছা কথা কইতাছে, আর অরে আমরা ঢাকাইয়া বইলা স্বীকার করুম না। যারা কোরবানির গোশতের কোর্মা একবার খাইছে, ওই মরতে দমতক ঐ কোর্মার গেরান আর স্বাদ ভুলবার পারবো না। যুদি বি বকরি ঈদে মাইনষের ঘরে ঘরে গোশত দিয়া নানান কিসিমের কালিয়া কোপ্তা, কোয়াব, কাটলেট, কিমা, তরে তরে খানা তৈয়ার অহে, আর সবতে কবজি ঢুবায়া খানাপিনা করবো– এইটাই বকরি ঈদের রেওয়াজ।
ঈদের দিন আর ঈদের বাদের দিন আগুনে ঝলসাইনা গোশতের কোয়াবের জ্বল্লা জ্বল্লা গেরান এই দুইদিন তক বাতাসে ভাইসা বেড়ায়। আগে কেউ নেহারি বা গরুর পায়চা তৈয়ার করতো না, অহন ঈদের দিন রাইতেই নেহারির পাতিলা চুলায় চইড়া যায়। মাগার আগে যে কোর্মা বকরি ঈদে ঢাকাইয়া গো গরিব পয়সাআলা সবতের ঘরে ঘরে তৈয়ার অইতো, ঐটার কুনু জোয়াব নাই, এককথায় কইবার গেলে এক্কেরে লাজোওয়াব। অহন ঘরে ঘরে ফ্রিজের চল আহনে ঐ কোর্মা কেউ তৈয়ার করবার চায় না। মাগার অহন বি ময় মুরব্বিরা এই কোর্মা রান্ধনের হুকুম দ্যায়, আর কিছু বউ, মাইয়া তৈয়ার বি করবার পারে। আমি অহনতক চোখ বন্ধ করলে, আমার ছোট ওক্তের কথা খেয়াল করলে, কোরবানির গোশতের কোর্মার বেহেস্তি গেরান অহন বি মাহেসুস করি।
যে বাড়িতে গরু কোরবানি অইতো, অরা নিজে গো কোরবানির গোশত বাটতে বাটতে যুদি কিছু আপনা এ্যাগানার বাড়িতে দিতে কম পইড়া যাইতো, তাইলে অগো নিজের বাড়িতে কুনু বাড়ির হিস্যা অইলে ঐ গোশত বি বাইটা দিতো, যিমুন কেউ কইবার না পারে অমুকের বাড়ি থেকা এইবার গোশত আহেনি।
আমার ছোট ওক্তে দেখছি, ঢাকাইয়া গরিব পয়সাআলা সব বাড়ি বাড়িতে, বকরি ঈদে বাড়ির বউ-মাইয়ারা আগে মেন্দি বাইটা, বাদে নানান কিসিমের ময় মসলা পাটায় বাটন শুরু কইরা দিতো। বকরি ঈদের আগের দিন রাইতে সবতে হাতে মেন্দি পিন্তো, মাগার কাম কাজের ঠ্যালায় হাতে পানি লাগতে লাগতে সব রং ফ্যাদা অয়া যাইতো ঈদের দিন। ঈদের দিন মায়েরা বিহান থেকা লিয়া রাইত তক পেরেশান থাকতো, কোরবানির গোশত যিমুন কুনুমতেই পইচা না যায় একজারাসি গাফলতির লেগা। এল্লেগা মায়েগো পশিনার লগে কোর্মার গেরান একলগে মিলা-ঝুইলা সব একলগে আমাগো নাকে ধাক্কা দিতো। ঈদের বাদে মায়েরা যবে রোজ বিয়ালে লাকড়ির চুলায় গোশত গরম করতো, ঐসমে পোলাপানরা সবতে চুলার সামনে বয়া গরমা গরম গোশত পেয়ালা ভইরা লিয়া খাইতো। আগে ঘরে ঘরে ফ্রিজ আছিলো না বইলা বকরি ঈদের হপ্তা ভইরা গরিব পয়সাআলা ঢাকাইয়া গো ঘরে ঘরে গোশতের ঢলাঢলি আছিলো। দেইখা মনে অইতো, কোরবানির গোশতের বহুত বরকত। মাগার অহন সব বরকত ফ্রিজের ভিতরে যায়া হান্দে।
আগে যারা কোরবানি দিতো, অগো ঐ কোর্মার লগে মহরমের আশুরার দিন ঘরে ঘরে খিচুড়ি রাইন্ধা গরিব মাইনষের ভিতরে বাটনের রেওয়াজ আছিলো। যারা কোরবানি দিতো না, অরা বি তাব্বি নিজের ঘরে কোর্মা দিয়া খিচুড়ি রাইন্ধা বালবাচ্চা লিয়া খাইতো আশুরার দিন, নেকি পাওনের উম্মিদে। এই কোর্মা এক বচ্ছরের বি রাখন যায় চর্বিতে ঢুবায়া। ঢাকাইয়ারা অগো নিজে গো নানি-দাদি থেকা পাওয়া মুনশিয়ানায় অরা এইটা হিকা আইছে অগো আগের পোস্তানের খান্দিনী পরম্পরায়। এই পরম্পরা অহন বি আছে, মাগার সামনে থাকবো কিনা, আমি জানি না।
আখতার জাহান : সাহিত্যচর্চা করেন পুরান ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায়