আবারও সোমালিয়া হয়ে করাচির পথে সেই এমভি আবদুল্লাহ
Published: 3rd, June 2025 GMT
জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রায় এক বছরের মাথায় আবারও স্পেন থেকে সোমালিয়ার দস্যুপ্রবণ এলাকার সামনে দিয়ে করাচি যাচ্ছে এমভি আবদুল্লাহ। জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপের জাহাজটি নিয়মিত পণ্য পরিবহন করছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার স্পেন থেকে পণ্য নিয়ে করাচির পথে রয়েছে জাহাজটি।
জাহাজটির ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশীদ এবারও হাল ধরেছেন এমভি আবদুল্লাহর। তবে জলদস্যুদের কাছে আক্রান্ত হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি এখনো মুছে যায়নি। সে জন্যই ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে তিনি সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। গত ৩১ মে সোমালিয়ার উপকূলের কাছাকাছি এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘সোমালিয়ার দস্যু–আক্রান্ত এলাকা দিয়ে আবারও যাচ্ছে আমাদের জাহাজ আবদুল্লাহ। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’
আরও পড়ুনযে কারণে কম সময়ে ছাড়া পেল এমভি আবদুল্লাহ১৪ এপ্রিল ২০২৪জাহাজ চলাচল শনাক্তকারী সংস্থাগুলোর ওয়েবসাইটে দেখা যায়, জাহাজটি ১ মে স্পেন থেকে পণ্য নিয়ে করাচির উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। এরপর আফ্রিকা উপকূল সোমালিয়া হয়ে এখন ওমানের কাছাকাছি রয়েছে জাহাজটি। ৭ জুন জাহাজটির করাচি বন্দরে পৌঁছানোর কথা।
২০২৪ সালের ১২ মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে কেএসআরএম গ্রুপের এই জাহাজ ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার দস্যুরা। মুক্তিপণ দিয়ে ৩৩ দিনের মাথায় ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে জাহাজটি মুক্ত হয়। এরপর জাহাজটি প্রথমে আমিরাতের আল-হামরিয়া বন্দরে পৌঁছায়। সেখানে পণ্য খালাস শেষে আরেকটি বন্দর থেকে চুনাপাথর বোঝাই করে ১৪ মে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায় জাহাজটি।
জানতে চাইলে কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর জাহাজটি নিয়মিত পণ্য পরিবহন করছে। যেখানে পণ্য পরিবহনের ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে যাচ্ছে। জাহাজটিতে বরাবরের মতো নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে।
আরও পড়ুনকত মুক্তিপণে ছাড়া পেল এমভি আবদুল্লাহ১৪ এপ্রিল ২০২৪.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জলদস য দ র ক আবদ ল ল হ জ হ জট
এছাড়াও পড়ুন:
অপহৃত হওয়া জেলেরা কি ফিরবেন না পরিবারের কাছে
তখন করোনার কাল। কুড়িগ্রাম জেলার ২৬ জন জেলে তাঁদের কাজের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভারত থেকে বাংলাদেশের পথে রওনা দেন। কিন্তু করোনার কারণে হঠাৎ বিধিনিষেধ আসে। তাঁরা রাস্তায় আটকা পড়েন। তবু ঝুঁকি নিয়ে কয়েক দিন পর আবার বের হন। আসাম পুলিশ তাঁদের আটকায়।
মানববন্ধন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠনের শরণাপন্ন হয়ে ছাড়িয়ে আনতে আনতে একজন জেলখানায় মারা যান। এরপর বাকিরা বাংলাদেশে ফিরতে পারেন। কিছুদিন আগে সাতজন জেলে ভারতের মেঘালয়ে আটকা পড়েন। তাঁরা এখন ভারতের জেলে। ভারতের আদালত কী রায় দিয়েছেন জানি না। পরিবারগুলোর কান্না থামছে না। এটা গেল চিলমারীর ব্রহ্মপুত্রপারের জেলেপাড়ার ঘটনা।
আগে বঙ্গোপসাগরের ভারত সীমান্তে বাংলাদেশি জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর প্রায়ই পত্রিকায় আসত। ভারতীয় কোস্টগার্ডও ধরে, ভারতীয় জলদস্যুরাও ধরে। এগুলো ‘ডাল-ভাত ব্যাপার’। ভারত বড় শক্তি। তারা স্থলে মারবে, পানিতে মারবে—এটাই নিয়তি। দয়া করে লাশ ফেরত দিলে তাতেই আমরা খুশি।
দুই.১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ দৈনিক ইত্তেফাক–এর খবর থেকে জানা যায়, ৪০ জেলেকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি, উদ্ধার হননি আগের ৮১ জনও। কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিনের অদূরে সাগর থেকে মাছ ধরার পাঁচটি ট্রলারসহ ৪০ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মির সদস্যরা। পাঁচটি ট্রলারের মধ্যে তিনটি টেকনাফ পৌর এলাকার, অন্য দুটির মালিক শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, জেলেদের উদ্ধারে কাজ চলছে। এ বিষয়ে বোট মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে বলেও জানান সাজেদ আহমেদ।
কিন্তু বিজিবি, কোস্টগার্ড ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা দেশবাসী জানে না। শুধু জানা যাচ্ছে, জেলেরা এখনো উদ্ধার হয়নি। পরিবার–স্বজনদের অপেক্ষা বাড়ছে।
তিন.১৫১৭ সালের কথা। পর্তুগিজরা বাংলার উপকূলে আসে। প্রথম দিকে এরা বাণিজ্য করলেও ধীরে ধীরে দস্যুতা, অপহরণ ও দাস ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে।
হুগলি, চট্টগ্রাম ও সুন্দরবন থেকে শুরু করে নোয়াখালী থেকে বরিশাল পর্যন্ত উপকূল এদের ডাকাতির শিকার হয়। গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ করে নারী, শিশু ও পুরুষদের ধরে নিয়ে যেত এবং দাস হিসেবে বিক্রি করত। এদের নিয়ে যেত পর্তুগিজ উপনিবেশে (গোয়া, মালাক্কা), এমনকি ইউরোপ পর্যন্ত। আর মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল থেকে আসা মগ জলদস্যুরা ডাকাতি চালাত বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, সীতাকুণ্ড ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলের মানুষদের তুলে নিয়ে যেত। বিক্রি করা হতো আরাকানের রাজধানী ম্রাউক উ এবং চট্টগ্রামের কাছে দাসের হাটে।
ফরাসি পর্যটক সেজার ফ্রেডেরিক লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলে দস্যুর হাতে ধরা পড়লে মুক্তি নেই, তারা মানুষ ধরে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে।’ ডাচ পর্যটক ভ্যান ডেন ব্রুক ১৭ শতকে আরাকানিদের দাস ব্যবসার বর্ণনা দিয়েছেন। এই সময়কালে বাংলার উপকূল থেকে অপহৃত মানুষের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে কিছু জায়গা জনশূন্য হয়ে পড়ে। এতে স্থানীয় অর্থনীতি ভেঙে যায়। গ্রামবাসীরা ভয়ে চলে যায় উপকূল ছেড়ে ভেতরের দিকে।
মোগল শাসকেরা জানতেন, তাঁদের সমৃদ্ধি এই জেলে, কৃষক ও কারিগরদের ওপর নির্ভরশীল। শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৬ সালে এই পর্তুগিজ ও মগদের দমন করেন। এখন কে করবেন দমন?
চার.মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জেরবার। আগে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীরা মাঝেমধ্যে বাহাদুরি দেখাতেন, আমরা নিরীহ বাঙাল হিসেবে মেনে নিতাম। ইদানীং তাঁদের তাড়িয়ে আরাকানের দখল নিয়েছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। তারা আমাদের জেলেদের সেন্ট মার্টিনে যেতে দেয় না, মাছ ধরতে দেয় না। প্রতি সপ্তাহে জেলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার টেরই পায় না।
উজানের ব্রহ্মপুত্র থেকে ভাটির সমুদ্র—সর্বত্রই জেলেদের জীবন কচুপাতার মতো টলমল। তাঁদের শ্রম ছাড়া আমাদের পাতে মাছ ওঠে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় জেলেদের নৌকাই ছিল আমাদের ভরসা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলে গেছেন, তাঁদের ‘পল্লীতে ঈশ্বর থাকেন না’। রাষ্ট্র থেকে বলা হয়, বঙ্গোপসাগর হলো বাংলাদেশের সদর দরজা; কিন্তু সেই সাগরেই আমাদের জেলেদের নিরাপত্তা নেই।
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
[email protected]