Samakal:
2025-11-04@06:40:40 GMT

শৈশব ও নতুন শহর

Published: 3rd, June 2025 GMT

শৈশব ও নতুন শহর

শৈশবের কয়েকটি ঈদের স্মৃতি আজও ভীষণভাবে মনে পড়ে। সেই স্মৃতি ভরা বর্ষার নাকি ঈদের, আলাদা করা মুশকিল। 
আমাদের পরিবারে ঈদে একটা গরু কোরবানি হতো– সেটা পারিবারিকভাবে বাবা আমার দাদা, নানা, পূর্বপুরুষদের নামে দিতেন। আমি দাদা-দাদি বা নানা-নানিকে পাইনি। দেখিনি। কিন্তু তাদের নামে কোরবানি হচ্ছে দেখেছি। তাই কোরবানি আমার কাছে পূর্বপুরুষদের রক্তের স্মৃতি দাবি করার মতো ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। সেটা ঘটেছিল গোপনে। সচেতনভাবে নয়। তাই পশু কোরবানির সঙ্গে পূর্বপুরুষদের নাম উচ্চারণ আমার জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার ছিল। পূর্বপুরুষদের স্মৃতি বহন এবং তাদের কাছে সব সময় আশীর্বাদ চাওয়া, কাজের মধ্য দিয়ে তাদের মুখ উজ্জ্বল করার একটা ভাব আমার মধ্যে স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠেছে মনে হয়। 
আর গরু ছাড়াও সঙ্গে থাকত ছাগল ও ভেড়া। যতদিন পরিবারে সচ্ছলতা ছিল, এটাই ছিল রীতি। আমার বাবা-মা দুজনেই খুব সামাজিক মানুষ ছিলেন। নোয়াখালীতে আমাদের পরিবারের সঙ্গে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী অনেক মানুষের খুবই সুসম্পর্ক ছিল। ঈদের দিনে তারা আমাদের বাড়িতে আসতেন। তাদের জন্য ভেড়া ও ছাগলের মাংস আলাদা করে কোরবানি হতো। ছোটবেলায় এসবের অর্থ বুঝতাম না। আমাদের এলাকার প্রতিটি পরিবার তখন ধর্মনিষ্ঠ হলেও তারা যে এক সামাজিক বন্ধনে জড়িত, তা তারা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করতেন। এটিও ছিল সেই বন্ধনের এক ধরনের সামাজিক অভিব্যক্তি।
ঈদের কথা আরও কিছু কারণে মনে পড়ে। সকালের খাবারে সবাই মিলে চাউলের রুটি আর ভেড়ার মাংস খাচ্ছি। এর পর গান, কবিতা, আবৃত্তি। ঈদে পোলাও রান্না হতো ঠিকই, তবে আমাদের কাছে ঈদের প্রধান খাবার ছিল চাউলের রুটি ও মাংস। সঙ্গে থাকত ফিরনি, যা ছিল রীতি; এসব হয়ে উঠেছিল ইসলামী পরিচয়ের চিহ্ন। এ সবকিছুই রান্না করতেন আমার মা। কোরবানির সময় গরুর যে চর্বি পাওয়া যেত, তিনি তা ফেলতেন না। চর্বি গলিয়ে সংরক্ষণ করতেন বৈয়ামে, সারা বছর তা দিয়ে পিঠা বানাতেন। গরুর চর্বিতে ভাজা সেই পিঠা ছিল অপূর্ব সুস্বাদু– দুটি খেলেই পেট ভরে যেত। এই পিঠা খেয়েই আমি বড় হয়েছি।
নোয়াখালীতে সুধারাম থানায় আমার বেড়ে ওঠা। আমাদের গ্রামের নাম ছিল লক্ষ্মীনারায়ণপুর। এ নিয়ে আমার একটি কবিতাও আছে। এ নামেরও একটা তাৎপর্য আছে– যে গ্রামে লক্ষ্মী ও নারায়ণ একসঙ্গে বাস করে। ঐতিহাসিকভাবে এটা হিন্দুপ্রধান এলাকা ছিল। এ গ্রামে নাথপন্থা, যাদের আমরা যোগী বলি, সেই যোগীদেরও বাস ছিল। তারা ঠিক গ্রামে থাকত না, গ্রামের কাছেই একটা খালের ধারে তাদের আশ্রমের মতো কিছু একটা ছিল বলে মনে পড়ে। অনেক সময় এ যোগীদের আমরা দেখতাম, আমরা ‘যৈগ্যা’ বলতাম। তারা মাঝে মাঝে ঈদের সময় আমাদের বাড়িতে আসত।
আমি অবিমিশ্র নোয়াখালীর মানুষ– বিশুদ্ধ নোয়াখালী বলতে যা বোঝায়। আমি মেঘনায় ঘরভাঙা মানুষ। আমাদের পুরো শহরটাই মেঘনার ভাঙনের মধ্যে চলে যায়। তারপর আমরা আরও উঁচু জায়গায় বসতি করি। সেই গ্রামটাই এখন মাইজদী কোর্ট বলে পরিচিত। আমরা এই মাইজদী কোর্টেই বড় হয়েছি। পুরোনা নোয়াখালী শহর আমি দেখিনি। তাই আমার মধ্যে মেঘনায় ভেসে যাওয়া একটা শহরের স্মৃতি কাজ করে। এর সঙ্গে আমার বুদ্ধদেব বসুর কথা মনে পড়ে। কারণ, বুদ্ধদেব বসু এই শহরে ছিলেন। তিনি বড় হয়েছেন এই শহরে। 
ছোটবেলায় আমার চোখের সামনে একটা শহরের গোড়াপত্তন দেখেছি। বিভিন্ন পাড়া, রেজিস্ট্রার অফিস গড়ে উঠছে। এসব কথা মনে পড়ছে– কারণ ঈদের মতো অনুষ্ঠানে পাড়ার সবাই এক হয়ে যেতেন। ঈদ শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি সামাজিক উৎসব। ফলে সামাজিকতার বন্ধন সেখানে কার্যকর থাকে।
তখন মাদ্রাসা কিন্তু এখনকার মতো ছিল না। অর্থাৎ এখন যেমন বিদেশ থেকে টাকা আসছে। পেট্রো ডলার কওমি মাদ্রাসার চরিত্র বদলে দিয়েছে। কোরবানি হয়ে গেলে মাদ্রাসার ছোট ছোট ছেলে চলে আসত গরু, ছাগল বা ভেড়ার ছাল সংগ্রহের জন্য। আমরা এই ছাল মাদ্রাসাকে দিয়ে দিতাম। এটা জানতাম এটা মাদ্রাসার ছাত্রদের প্রাপ্য; এটাতে তাদের অধিকার। শুধু তা-ই নয়। কোরবানির মাংসের একটা বড় অংশ এই এতিম বাচ্চাদের দেওয়া হতো। ইসলামে দত্তক নেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। ইসলাম মনে করে, তুমি যখন আরেকজনের সন্তানকে দত্তক নিচ্ছো, তখন তুমি আসলে বাচ্চা প্রাইভেটাইজেশন করছো, তুমি সম্পত্তি রক্ষার জন্য এ কাজ করছো। আল্লাহ যদি তোমায় সন্তান না দিয়ে থাকে, তাহলে এ সম্পত্তি সামাজিক সম্পত্তি হয়ে যাবে। পরে আবিষ্কার হয়েছে, সন্তান না থাকলে ভাইয়েরা পাবে, বা অন্যরা পাবে। এগুলো পরে এসেছে। পারিবারিক দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। ইসলামের উদ্দেশ্য আরও মহৎ ছিল। নিঃসন্তান ব্যক্তির সম্পত্তি গণসম্পত্তি বা পাবলিক প্রপার্টি হয়ে যাবে, যার ওপর এতিমের অধিকার আগে। ইসলাম রক্তের সম্পর্কের ঊর্ধ্বে মানুষের সঙ্গে মানুষের দিব্য সম্পর্ক রচনায় বিশ্বাস করে। তাই সন্তান পালক নেওয়া বা এডপশন ইসলামে নিষিদ্ধ। যারা এতিম বাচ্চাকে নিজের সন্তান গণ্য করে না তারা রসুলের উম্মতের দাবিদার হতে পারে না। এসব আমরা ছেলেবেলায় শুনতাম। সমাজে সবচেয়ে বেশি অধিকার এতিম বাচ্চাদের। একদিকে দত্তক নেওয়ার নিয়ম নেই; অন্যদিকে এতিম বাচ্চাদের অধিকার সবার আগে– একটা অদ্ভুত সুন্দর ধর্ম। ঈদের সময় মাদ্রাসার ছোট বাচ্চারা যখন ছাল নিতে আসত, তখন আমরাও তো ছোট। ওই বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতাম। আবার এক মাদ্রাসায় দিলে আরেক মাদ্রাসার ছেলেরা এসে ওদের সঙ্গে ঝগড়া, রাগারাগি করত। আমরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আশপাশের সব মাদ্রাসাকেই ছাল দিতাম। গ্রামে এই এতিম বাচ্চাদের প্রতি আমরা একটা আলাদা দরদের জায়গা দেখতে পেতাম। সেই ইসলাম– যা সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে তা আমাদের জীবদ্দশায় ক্ষয় হয়ে গেল। আমরা পেট্রো-ডলার ও রাজতান্ত্রিক মতাদর্শকে এখন ‘ইসলাম’ বলে থাকি। আমরা জাহেলিয়া যুগে ফিরে গিয়েছি। আফসোস। আমি তো ‘এতিম’ বিষয়টা বুঝতাম না। তখন মা বলতেন, এতিম হলো– ওদের মা-বাবা নেই, অথবা কোনো একজন নেই। বাচ্চারা আসত। এসেই আমাদের সঙ্গে চাউলের রুটি আর মাংস খেতে বসে যেত। আমাদের আগে তারা খাবার পেত; কারণ ঈদের দিন ওদের অধিকার আগে। কোরবানির এই সামাজিক তাৎপর্য খুবই স্পর্শ করত আমায়। এখনও ভুলিনি। 
আমার গোটা শৈশব-কৈশোর ওই নতুন গড়ে ওঠা শহরেই কেটেছে। পড়েছি জিলা স্কুলে। তখন এটা ঠিক গ্রাম নয়। শহর সবেমাত্র পত্তন হয়েছে। তাই গ্রামের মতোই সবকিছু খুব খোলামেলা। বসতি ছিল খুব কম। আর স্কুলটা ছিল মাটির ঘর; ওপরে টিন দেওয়া। আমরা হাফপ্যান্ট পরে যেতাম স্কুলে। বর্ষাকালে পুরো জায়গাটা পানিতে ডুবে যেত। আর পানিতে ছিল বড় বড় জোঁক। শুকনা পথে যেতে চাইলে অনেক দূর ঘুরে যেতে হবে। অথচ ওইখান থেকে আমাদের স্কুল দেখা যায়। মাঝখানে মাঠ, পানিতে ভরতি; আর পানিতে জোঁক। আমরা করতাম কি– প্যান্টটা খুলে মাথায় বেঁধে নিতাম, বইপত্রও মাথায় নিয়ে নিতাম। মাঠ পার হয়ে একজন আরেকজনকে দেখতাম জোঁক ধরল কিনা। জোঁক ধরতও। তখন এগুলো টান দিয়ে ছাড়াতাম। বর্ষার সেই বৃষ্টিতে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। ভরা মাঠ থইথই করছে। ওই পানি কিন্তু দূষিত ছিল না। এতে কোনো নোংরা আবর্জনা ছিল না। 
আমি শৈশবে ছিলাম দুর্দান্ত দুষ্ট, দুরন্ত। পানিতে দাবড়ানো, গাছে চড়া, মাঠে ঘোরা ছিল রোজকার ঘটনা। পরে পড়েছি চৌমুহনী কলেজে। সেখানে বহু নামকরা মানুষ পড়েছেন, শিক্ষকতা করেছেন। এটা ছিল মফস্বল এলাকা। যদিও এখানে অনেক বিখ্যাত মানুষজন পড়িয়েছেন ও পড়েছেন। আমরা সাত মাইল হেঁটে ওই কলেজে যেতাম। ট্রেনে যাওয়া যেত। সব সময় ট্রেন পাওয়া যেত না। তখন রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম; কয়েক ঘণ্টা লাগত। প্রায় গ্রাম– যেখানে লক্ষ্মী ও নারায়ণ যুগপৎ অধিষ্ঠান করতেন, সেখানে এক ধর্মপ্রাণ কিন্তু শিক্ষায় প্রবল আগ্রহী পরিবারে ইসলামের মহৎ দিকগুলোর আবহে আমি বড় হয়েছি। আমার মা-বাবা, ভাইবোন সবার সম্পর্কে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। ব্যক্তির চেয়ে সমাজ বড়, সামষ্টিকতা বা সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বাস করার স্বপ্ন আমার শৈশবের বেড়ে ওঠার অভ্যাস থেকে তৈরি হয়েছে। কোরবানির সময় শুনতাম আমরা শুধু মোহাম্মদের উম্মত নই; আমরা মিল্লাতে ইব্রাহিমের অন্তর্ভুক্ত। কোরবানি তাঁর স্মৃতি ধারণের মধ্য দিয়ে নতুন বিশ্বসমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি।
তাই স্বপ্ন দেখি, একদিন আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান সেই বিশ্বাস আরও দৃঢ় করেছে। v

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এত ম ব চ চ দ র ক রব ন র আম দ র আম র ম পর ব র করত ন ইসল ম র সময়

এছাড়াও পড়ুন:

মাঠ আর আগের মতো নেই: সারজিস

‘প্রতীক ভাড়া দেওয়ার দিন শেষ। জোট করলেও নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।

মঙ্গলবার (০৪ নভেম্বর) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড পেজে দেয়া এক পোস্টে এই মন্তব্য করেন তিনি।

পোস্টে সারজিস লিখেছেন, “প্রতীক ভাড়া দেওয়ার দিন শেষ। জোট করলেও নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে।”

তিনি আরো লিখেছেন, “মাঠ আর আগের মতো নেই। আগের ইকুয়েশন এবার মিলবে না। সময়মত মিলিয়ে নিয়েন।”

নিবন্ধিত দল জোট করলেও নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে—এমন বিধান রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করেছে সরকার।

এর আগে ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন করে। এরপর জোট মনোনীত প্রার্থীকে নিজ দলের প্রতীকে ভোট করা নিয়ে বিএনপি আপত্তি তুললেও জামায়াত ও এনসিপি ২০ ধারার এ সংশোধন বহাল রাখার দাবি জানায়। শেষ পর্যন্ত এই ধারা অপরিবর্তিত রেখেই সোমবার অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।

ঢাকা/ইভা

সম্পর্কিত নিবন্ধ