আজমল সাহেব সরকারি অফিসের ছোট কর্তা। বেতন যা পান, তাতে সংসার চলে। তবে সঞ্চয় থাকে না। ঈদবাজারের সময় স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের বায়না মেটাতে তাঁকে গলদঘর্ম হতে হয়। এ জন্য ঈদকে কোনো দিনই তাঁর উৎসব মনে হয়নি। ঈদ সামনে এলেই তাঁর ভীরু বুকটা দুরু দুরু করতে থাকে।

প্রতিবার কোরবানির ঈদে তাঁকে মোটা ঠেকায় পড়তে হয়। সেই জন্য কোরবানির ঈদ কাছাকাছি এলে আজমল সাহেব বউ–বাচ্চাদের কাছ থেকে একটু দূরে থাকতে চান। হঠাৎ কোথাও বেড়াতে যেতে চান। অফিশিয়াল ব্যস্ততার ভান করেন। তবে বউ–বাচ্চারাও আজমল সাহেবের এই কৌশল বুঝে গেছে।

এবার ঈদের সপ্তাহখানেক আগেই একদিন বাসার সবাই আজমল সাহেবের শোবার ঘরে এসে হাজির। আজমল সাহেবেরও বয়স হয়েছে। তিনি ছেলে-বউ সবারই পায়ের শব্দেরও ভাষা বুঝে গেছেন। একে একে তারা ঘরে ঢুকছে আর আজমল সাহেব হিসাব করছেন, এবার নিশ্চয়ই প্রভিডেন্ট ফান্ডে হাত দিতে হবে। যে ভাবনা, সেই কথা।

পরিবারের সবার এক কথা—এবার আর যৌথভাবে গরু কোরবানি দেওয়া যাবে না। এতে পাড়ায় মুখ দেখানো যায় না। ছেলেমেয়েদের কথার পরে আস্তে করে আজমল সাহেবের স্ত্রী খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘জীবনে তো আমার কোনো শখ-আহ্লাদ পূরণ করোনি। এখন ছেলেমেয়েরা তোমারই মুখ রাখার জন্য একটা কথা বলছে। এতে আর অমত কোরো না।’

আজমল সাহেব এবার মুখ খুললেন। বললেন, তাহলে তো এবার প্রভিডেন্ট ফান্ডে হাত দিতে হবে।

দেখো, ‘সারা জীবন কোনো হিসাব নিতে যাইনি। কোন ফান্ডের টাকা কোথায় ঢেলেছ, তুমিই ভালো জানো।’

খোঁচা খেয়ে আহত হলেও আজমল সাহেব সপ্রতিভ ভাব করে রইলেন। কারণ, তিনি খুব ভালো করেই জানেন এ বৈঠকে একটু ক্রিয়া করলে বড় একটা প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তে হবে। তার চেয়ে মুখ বুজে সব মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজেকে বুদ্ধিমান ভেবে আজমল সাহেব চুপ করে রইলেন। সিদ্ধান্ত হলো, এবার একাই একটা গরু কোরবানি দিতে হবে।

আজমল সাহেব প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুললেন। খরচ বাঁচানোর জন্য পাড়ার এক দালালের কাছে গেলেন। দালাল তাঁকে সেই রকম বোঝালেন।

‘স্যার, একটুও ভাববেন না। টাকা কম, গরু ভালো—এটাই হচ্ছে দালালের ফাংশন। আপনি একটুও চিন্তা করবেন না, স্যার। আপনাকে এমন সুন্দর একটা গরু মিলায়ে দেব, আপনার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারবেন না।’ দালালের কথায় আজমল সাহেবের মন ভরে গেল।

বাজারে গিয়ে সত্যিই দালাল একটা গরু মিলিয়ে দিল। আজমল সাহেব অবাক। দালাল ছেলেটা তার মন জয় করে নিয়েছে। হাট থেকে বের হয়ে আজমল সাহেব গরুর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলেন। কিছু দূর যেতেই দালাল ছেলেটা থামল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার, আপনি এভাবে গরুর সঙ্গে হেঁটে যাবেন, এটা খুব খারাপ দেখাচ্ছে। আপনি বাসায় চলে যান। আমি গরু নিয়ে আসছি।’

বাজারে গিয়ে সত্যিই দালাল একটা গরু মিলিয়ে দিল। আজমল সাহেব অবাক। দালাল ছেলেটা তার মন জয় করে নিয়েছে। হাট থেকে বের হয়ে আজমল সাহেব গরুর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলেন। কিছু দূর যেতেই দালাল ছেলেটা থামল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার, আপনি এভাবে গরুর সঙ্গে হেঁটে যাবেন, এটা খুব খারাপ দেখাচ্ছে। আপনি বাসায় চলে যান। আমি গরু নিয়ে আসছি।’

ছেলেটার কথা আজমল সাহেবের খুব মনে ধরল। তাই তো; তিনি কেন গরুর সঙ্গে হাঁটছেন? পাড়ার ছেলে ঠিকই গরু পৌঁছে দেবে। তা ছাড়া কম টাকায় এত সুন্দর একটা গরু মিলিয়ে দেওয়ার জন্য ছেলেটার প্রতি তাঁর একটা আস্থা তৈরি হয়েছে। আজমল সাহেব একটা রিকশায় উঠে পড়লেন।

গরুর গল্প শুনে বাসার সবাই বেজায় খুশি। হঠাৎ বাড়িতে আজমল সাহেবের যত্ন-আত্তি বেড়ে গেল।

‘আহা! ঘেমেনেয়ে যে একেবারে একাকার হয়ে গেছ! মুখ–হাত ধুয়ে ফ্যানের নিচে এসে বসো। হাজার হোক গরুর হাটের ধকল। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। কখন কী খেয়েছ, কে জানে। আমি তাড়াতাড়ি খাবার দিচ্ছি।’

কিছুক্ষণের জন্য আজমল সাহেব উদাস হয়ে গেলেন। সেই কবে বাসরঘর থেকে বের হয়েছেন। এই দীর্ঘ সংসারজীবনে এমন সমবেদনা কবে পেয়েছেন,মনে করতে পারছেন না।

হঠাৎ বাড়তি যত্ন পেয়ে আজমল সাহেব সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়েছেন। মাঝরাতে স্ত্রীর হাঁকডাকে আজমল সাহেব ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলেন। প্রথমে তাঁর ধারণা হলো, বাড়িতে বোধ হয় ডাকাত পড়েছে। তবে ধোঁয়াশা কাটতে সময় লাগল না। স্ত্রী পারলে তাঁর গলা চেপে ধরেন।

‘তোমার গরু কোথায়?’

গলায় এমন ভর দিয়ে কথাটা তিনি বললেন যে আজমল সাহেবের মনে হলো, গরুর চিন্তা বাদ দিয়ে এবার বোধ হয় স্ত্রীর গলার চিকিৎসা করাতে হবে। অল্পক্ষণের মধ্যেই যা বোঝা গেল, দালাল ছেলেটা গরু নিয়ে আসেনি। আজমল সাহেব থ হয়ে গেলেন। তাই তো; এত কম টাকায় এত ভালো গরু তো পাওয়ার কথা নয়। ভালো গরু দেখিয়ে দালাল তাঁর পকেটের টাকা কয়টা নিয়ে গরুসহ কেটে পড়েছে। তিনিও হাল ছাড়ার পাত্র নন; মনে মনে বললেন আজমল সাহেব। পাড়ার ছেলে। ফাঁকি দিয়ে যাবে কত দূর?

মাঝরাতেই তিনি দালালের বাসায় গিয়ে কড়া নাড়লেন। দালালের স্ত্রী দরজার ওপাশ থেকে বললেন, ‘সকালে আপনিই তো আমার স্বামীকে ডেকে নিয়ে গেছেন। সে আর বাড়িতে ফিরে আসেনি।’

তাঁর কথা শুনে আজমল সাহেব চটে গেলেন।

‘স্বামী-স্ত্রী মিলে নাটক করছ। দেখাচ্ছি মজা। এক্ষুনি থানায় যাচ্ছি।’ বলেই আজমল সাহেব হাঁটতে শুরু করলেন। দালালের স্ত্রী গলা উঁচু করে কী কী সব বলতেই থাকলেন। আজমল সাহেব আর তা কানে তোলার প্রয়োজন বোধ করলেন না।

থানায় এসে তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। দালালের স্ত্রী তার আগেই থানায় এসে অভিযোগ করে গেছে। তিনি নাকি দালালকে ডেকে নিয়ে গিয়ে গুম করেছেন।

ভেতরে ঢুকে নিজের পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিউটি অফিসার এ কাদের বললেন, ‘সরি স্যার, আপনার নামে একটা গুরুতর অভিযোগ এসেছে। ওই ছেলে উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে পুলিশি হেফাজতে থাকতে হবে। আজমল সাহেব তাঁর গরু হারানোর কথা তুলতেই পারলেন না। তাঁর মনে হলো, এটাই হচ্ছে দালালের আসল ফাংশন। গরুর হাটে যাওয়ার আগেই বোধ হয় দালাল ব্যাটা এই পরিকল্পনা করে রেখেছিল।

আজমল সাহেবকে সম্মান করে রাতে আর হাজতের ভেতরে ঢোকানো হলো না। ডিউটি রুমে একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখা হলো। চারদিকে মশা ভনভন করছে। একেক সময় মনে হতে লাগল, পারলে পা দুখানা মশাতে ছিঁড়ে নিয়ে যায়।

এত দিন বই-পুস্তকে পড়েছেন, পৃথিবী ঘোরে। আজ তাঁর বাস্তবেই মনে হতে লাগল যে পৃথিবী ঘুরছে। তাঁর পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। খুব আফসোস হতে লাগল। থানায় বসে এত বড় রাত পার করছেন। বউ–বাচ্চা কেউ তাঁর একবার খোঁজ নিল না। বিকেলে গরুর হাট থেকে ফেরার পর স্ত্রীর অতিরিক্ত যত্নের কথা মনে পড়ে তাঁর গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু এ–ও মনে হতে লাগল যে তাঁর গলা দিয়ে বোধ হয় আর কোনো আওয়াজই বের হবে না।

ভোরের দিকে একটি প্যাট্রল পার্টি থানায় ফিরল। তারা এসে ডিউটি অফিসারকে খবর দিল। সিটি বাইপাস মোড়ে একটি গরু নিয়ে এক দালাল বসে রয়েছেন। দূর থেকে এ কথা শুনে আজমল সাহেব যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলেন।

ডিউটি অফিসার এ কাদের বললেন, ‘সরি, স্যার। আপনার গরুর দালালকে পাওয়া গেছে। আমাদের আরেকটা টিম সেখানে যাচ্ছে। আপনি তাদের সঙ্গে যেতে পারেন।’

সত্যিই সিটি বাইপাস মোড়ে গিয়ে দালাল ছেলেটাকে দেখে আজমল সাহেবের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ছেলেটা সারা রাত গরু নিয়ে এখানে বসে রয়েছে!

আজমল সাহেবকে দেখে দালাল ছেলেটা কেঁদে উঠলেন।

‘স্যার, গরুটা হঠাৎ শুয়ে পড়েছে। আর উঠছে না। আমি সারা রাত ধরে কত রকম চেষ্টা করেছি। তুলতে পারিনি।’

ছেলেটার জন্য এবার সত্যিই আজমল সাহেবের মায়া হলো। কিছুক্ষণ পরই রাস্তায় গাড়ি চলাচল শুরু হলো। একটা ভ্যান ডেকে দুজন মিলে গরুটা গাড়িতে তুলে নিয়ে বাড়িতে ফিরলেন।

কিছুক্ষণ পরই পাড়ার ইমাম সাহেব এলেন আজমল সাহেবের গরু দেখতে। বাড়ির সবাই গরু দেখে ভীষণ খুশি। এবার আর ভাগে নয়, তাঁরা নিজেরাই একটা গরু কোরবানি করবেন, কিন্তু ইমাম সাহেবের কথা শুনে আজমল সাহেব আবারও থ হয়ে গেলেন। ইমাম সাহেব বললেন, এ গরু তো কোরবানি হবে না। অসুস্থ পশু কোরবানি করার বিধান নেই।

আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আজমল স হ ব র অফ স র ক রব ন ব ধ হয় র জন য বলল ন

এছাড়াও পড়ুন:

ঋণ নেওয়ার আগে যে ১০টি বিষয় অবশ্যই জানা উচিত

নানা কারণে আপনার ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। অনেক সময় মানুষ ব্যক্তিগত ঋণ, গৃহঋণ নেয়। আবার গাড়ি কেনার জন্যও অনেকে ঋণ নেন। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেও ঋণ নেওয়া হয়।

কিন্তু অনেকেই ঋণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু মৌলিক শব্দ সম্পর্কে জানেন না। ব্যাংকের কর্মকর্তারা যখন এসব শব্দ বলেন, তখন অনেক কিছুই বোঝেন না ঋণ নিতে ইচ্ছুক গ্রাহকেরা। ফলে নিয়মকানুন না জেনেই ঋণ নেন। এতে নানা অপ্রত্যাশিত ঝামেলা তৈরি হয়। তাই ঋণ নেওয়ার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোঝা খুব দরকার।

১. আসল টাকা (প্রিন্সিপাল)

আপনি যে পরিমাণ টাকা ঋণ নিচ্ছেন, সেটিই আসল। এর ওপরই সুদ ধরা হয়। কিস্তি পরিশোধের সঙ্গে আসল ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

২. সুদের হার (ইন্টারেস্ট রেট)

ঋণ নেওয়ার আগে সবচেয়ে ভাবতে হয় সুদের হার নিয়ে। সুদের হার বেশি হলে খরচ বেড়ে যায়। ঋণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সুদের হার। এটি স্থিরও হতে পারে, আবার বাজারদরের ওপর নির্ভর করে বাড়তে-কমতেও পারে।

৩. মাসিক কিস্তি (ইএমআই)

ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ বাবদ প্রতি মাসে যে নির্দিষ্ট টাকা আপনাকে দিতে হবে। সেটি হলো ইএমআই বা ঋণের কিস্তি।

৪. ঋণের মেয়াদ

কত বছরের মধ্যে ঋণ শোধ করতে হবে, সেটিই হলো ঋণের মেয়াদ। মেয়াদ বেশি হলে কিস্তি ছোট হয়। কিন্তু মোট সুদের টাকা বেড়ে যায়। ছোট মেয়াদে কিস্তি বড় হয়। কিন্তু মোট সুদের টাকা কমে।

৫. অ্যানুয়াল পারসেন্টেজ রেট (এপিআর)

শুধু সুদ ও আসল নয়, বরং ঋণের সব খরচ (যেমন ফি, চার্জ) মিলিয়ে আসল ব্যয় কত হবে, তার হিসাব হলো অ্যানুয়াল পারসেন্টেজ রেট (এপিআর)। এটিই প্রকৃত খরচ বোঝায়।

৬. আগাম পরিশোধ (প্রিপেমেন্ট)

ঋণের বোঝা কমাতে অনেকে ঋণের সুদ ও আসলের টাকা আগেই শোধ করে দিতে চান। এতে সুদের খরচ কমে যায়।

৭. প্রসেসিং ফি

আপনি ঋণের জন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করলেন। কিন্তু ঋণ আবেদন মঞ্জুর থেকে শুরু করে ছাড় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কিছু মাশুল দিতে হয়। এটিই প্রসেসিং ফি। এটি কখনো ঋণের টাকা থেকে কেটে নেওয়া হয়, আবার কখনো আলাদা দিতে হয়।

৮. স্থগিতকাল (মোরাটোরিয়াম)

বিশেষ পরিস্থিতিতে কিছুদিনের জন্য কিস্তি বন্ধ রাখার সুযোগকেই বলে স্থগিতকাল। তবে এই সময়েও সুদ জমতে থাকে। অনেক সময় ঋণ পরিশোধের জন্য বিশেষ কিস্তি ভাগও করে দেওয়া হয়।

৯. জামানত (কোলেটারাল)

ঋণের নিরাপত্তা হিসেবে আপনার সম্পদ (যেমন বাড়ি, সোনা, জমি) ব্যাংকে বন্ধক রাখা হয়। কিস্তি না দিলে ব্যাংক ওই সম্পদ বিক্রি করে টাকা তুলে নেয়।

১০. লোন-টু-ভ্যালু রেশিও

আপনি যত টাকা ঋণ নিচ্ছেন আর জামানতের মূল্য কত—এই অনুপাতকে বলে লোন টু ভ্যালু রেশিও (এলটিভি)। এর অনুপাত যত কম হয়, ব্যাংকের ঝুঁকি তত কম।

সম্পর্কিত নিবন্ধ