আমার নিবাস প্রত্যন্ত চলনবিলে। চলনবিলের সর্ববৃহৎ মাছের আড়ত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটিতে। এ আড়তে মাছচাষিরা যখন তাদের উৎপাদিত কষ্টার্জিত মাছ বিক্রি করতে যান, তখন স্থানীয় ভাষায় ‘ঢলতা’র ফাঁদে পড়েন। ‘ঢলতা’ হলো নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে মণপ্রতি কিছু বেশি নেওয়া বা দেওয়া।
মাছের আড়তে ক্রেতা একজন সাধারণ বিক্রেতার কাছ থেকে ৪০ কেজি মাছ কিনতে ৪৪-৪৫ কেজিতে এক মণ ধরেন। এখানে মণপ্রতি ৪-৫ কেজি মাছ বেশি নেওয়া হয়। অতিরিক্ত ৪-৫ কেজি মাছ বেশি নেওয়াকেই ‘ঢলতা’ বলে। এই ঢলতা দেওয়া মহিষলুটি আড়তের প্রায় ২৫ বছরের পুরোনো অভ্যাস। এটা শুধু যে মাছের ক্ষেত্রেই করা হয়, তা নয়।
উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলায় আমের মণ ৪০ কেজির বদলে ধরা হতো ৫৪ কেজিতে। এখানে ঢলতা প্রথার মাধ্যমে মণে ১৪ কেজি বেশি নেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে ৫ জুন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আলোচনায় সর্বসম্মতিক্রমে কেজি দরে আম কেনাবেচার সিদ্ধান্ত হয়। এর তিন দিন পরই আড়তদাররা কেজিপ্রতি ৩ টাকা কমিশন দাবি করেন। এতে গত সোমবার থেকে বন্ধ হয়ে গেছে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ এ অঞ্চলের আম কেনাবেচা।
মূলত আমের ভরা মৌসুমে আড়তদারের যে কোনোভাবে আমচাষিকে ঠকানোর অনেক কৌশলের মধ্যে এটিও একটি। যারা কেজিতে ৩ টাকা বা মণে ১২০ টাকা আড়তদারদের কমিশন আবদার মেটাতে চাচ্ছেন না, তাদের বাধ্য হয়ে বাজারে আম বিক্রি করতে হয় আগের মতো ৫৪ কেজিতে মণ ধরে।
এখন আলোচনায় আসি রাজশাহী অঞ্চলের পরিস্থিতি নিয়ে। রাজশাহীর বাঘা শাহি মসজিদ নির্মাণ করা হয় প্রায় ৫০০ বছর আগে। বাঘা মসজিদের দেয়ালে থাকা টেরাকোটায় আছে আমের মোটিফ। কিন্তু এ অঞ্চলের আমবাজারে যুগ যুগ ধরে চলছে ঢলতা প্রথা। আড়তদারদের চতুরতায় মণপ্রতি ১৪ কেজি বেশি নেওয়ার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে দেরিতে হলেও আম অধ্যুষিত উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোরসহ বিভিন্ন জেলায় আমচাষিদের বোধোদয় হতে শুরু করেছে। আড়তদাররা কেজিতে ৩ টাকা কমিশনের দাবিতে আম কেনাবেচা বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এতে ত্যক্ত-বিরক্ত আমচাষিরা। আর ঢলতার নামে ঠকে যাওয়া নাটোরের আমচাষিদের ভাষ্য, তাদের জেলায়ও প্রশাসন ঢলতা প্রথা বন্ধে বারকয়েক সভা করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আম মৌসুমে এ নিয়ে আম ক্রেতা আড়তদাররা বাগড়া ধরলেও সমাধান মেলে না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের আম ক্রেতা আড়তদারদের অহেতুক ও অযৌক্তিক কমিশন আদায় করার প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার আমচাষিরা ‘কৃষক সমিতি’ গঠন করেছেন, যেটা অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। বছরের পর বছর ঠকে যাওয়া আমচাষিদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে মৌসুমি আড়তদারদের ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়া ঠেকাতে আমচাষি, স্থানীয় প্রশাসনের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
হয়তো কোরবানির ঈদে টানা কয়েক দিন আম বিক্রির অধিকাংশ বাজার বন্ধ থাকায় বিক্রি করা যায়নি। এতে গাছেই পেকে ঝরতে শুরু করেছে হিমসাগর ও লক্ষ্মণভোগ। এ কারণে মঙ্গলবার রাজশাহীর অধিকাংশ চাষি আম নিয়ে ছোটেন বানেশ্বর হাটে। তবে পাইকার কম থাকায় প্রত্যাশা অনুযায়ী তারা দাম পাননি। তাই বলা বাহুল্য, আম নষ্ট হওয়ার আগেই ‘ঢলতা’, ‘কমিশন’ প্রথা বন্ধে কার্যকর প্রশাসনিক সমাধান আশু প্রয়োজন।
এম আতিকুল ইসলাম বুলবুল, সমকালের তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প ইনব বগঞ জ আড়তদ র আমচ ষ
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে পাঙাশের বৃহত্তম আড়ত দ্বীপনগর, পাওয়া যায় দেশি-বিদেশি অনেক মাছ
রাজধানীর গাবতলী–মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে বিজিবি মার্কেটে গড়ে ওঠা দ্বীপনগর মাছের আড়ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বেশ জমজমাট থাকে। এই তিন ঘণ্টায় বিক্রি হয় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে এসব নানা জাতের দেশি-বিদেশি মাছ।
এ আড়তে গরিবের মাছখ্যাত পাঙাশ থেকে শুরু করে রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, কই, শিং, টাকি, মাগুর, পুঁটি, বাইম, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও চাষের মাছ পাওয়া যায়। নদীর পাশাপাশি সাগরের বাইলা, চাপিলা, সুরমা, পোয়া, রিঠা, লইট্টা, টুনা প্রভৃতি মাছ পাওয়া যায়। ওমান, চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা মাছ সরাসরি এখানে আসে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৬ সালে প্রথমে বিজিবি মার্কেটে মাছ বিক্রি শুরু হয়। তবে ২০০৯ সালে এ বাজারে দ্বীপনগর আড়তের যাত্রা শুরু হলেও বাজার জমে ওঠে ২০১৫ সালের পর থেকে। পরে পাঁচটি হিমাগার ও একটি বরফকল নিয়ে এটি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ মৎস্য আড়তে পরিণত হয়, যেখানে ছোট–বড় প্রায় ৪০০ পাইকারি দোকান রয়েছে।
আড়তদার ও বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, দ্বীপনগর আড়তে জ্যান্ত মাছের পাইকারদের বিনা মূল্যে পানি সরবরাহ করায় তাঁদের প্রত্যেকের প্রায় ৫০০ টাকা করে সাশ্রয় হয়। তার ওপর যাতায়াতের সুবিধা ভালো, ওজনে কেউ মাছ কম দেয় না, চুরিও হয় না এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবেশে বেচাকেনা করা যায়। এসব কারণে এটি এরই মধ্যে ঢাকার অন্যতম বৃহৎ ও জনপ্রিয় আড়তে পরিণত হয়েছে। ফলে এখানে দিন দিন পাইকার বাড়ছে এবং মোকামও আশপাশে বিস্তৃত হচ্ছে।
দ্বীপনগর আড়তের ‘অটুট বন্ধন মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতি’র সভাপতি মো. ইনসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে দৈনিক প্রায় ৪০ হাজার কেজি পাঙাশ বিক্রি হয়, যা কারওয়ান বাজারেও হয় না। সব ধরনের মাছ মিলিয়ে দৈনিক দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়।’
* দ্বীপনগর আড়তে পাঙাশ, রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, কই, শিং, টাকি, মাগুর, পুঁটি, বাইম, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও চাষের মাছ পাওয়া যায়।* নদী ও সাগরের বাইলা, চাপিলা, সুরমা, পোয়া, রিঠা, লইট্টা, টুনা প্রভৃতি মাছও বিক্রি হয়।
* প্রতিবেশী ভারত থেকে শুরু করে ওমান, সুদান, জর্ডান, চীন ও জাপান থেকে আমদানি করা মাছ এখানে বিক্রি হয়।
আড়তদার ও পাইকারদের দাবি, এটি দেশে পাঙাশ মাছের সবচেয়ে বড় আড়ত। এখানে দিনে ৩৫ থেকে ৪০ ট্রাক পাঙাশ মাছ আসে। এসব ট্রাকে ৩০ থেকে ৪০টি করে পাঙাশের ড্রাম থাকে। এর একেকটিতে ৪০ কেজি মাছ থাকে। গড়ে ৩৫টি ট্রাকে ৩৫টি করে ড্রাম এবং প্রতি ড্রামে ৪০ কেজি ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, এখানে দৈনিক ৪৯ হাজার কেজি পাঙাশ মাছ বিক্রি হয়, যার দাম ৬৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
বিশেষ করে রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, শ্যামলী, গাবতলী, সাভার, উত্তরা এবং আবদুল্লাহপুর এলাকার পাইকারেরা দ্বীপনগর আড়তে মাছ কিনতে আসেন। অটুট বন্ধন মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি মনির হোসেন বলেন, কম দামে পাওয়া যায় বলে পাইকারেরা এখানে মাছ কিনতে আসেন। তাঁর নিজস্ব বরফকল রয়েছে। ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বরফের পাটা বিক্রি করেন। তাই বাইরে থেকে বরফ আনতে হয় না।
সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফোটার আগেই বিভিন্ন এলাকার পাইকারেরা মাছ কিনতে দ্বীপনগর আড়তে চলে আসেন। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নিলামের হাঁকডাকে সরগরম হয়ে ওঠে পুরো আড়ত। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা তাজা ও হিমায়িত মাছের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আনা মাছের বেচাবিক্রি শেষ হয়ে যায়। ৯টার পরপরই সব ব্যস্ততা শেষে ধোয়ামোছার কাজ শুরু হয়ে যায়।
সাভার নবীনগর থেকে আসা পাইকার ফরিদুল ইসলাম জানান, তিনি এখান থেকে দৈনিক ১৫০–২০০ কেজি সাগরের মাছ নিয়ে এলাকার বাজারে বিক্রি করেন।
আড়তদারেরা জানান, দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, টেকেরহাট, খুলনা, রাজশাহী, মোংলা, সাতক্ষীরাসহ সব অঞ্চল থেকেই মিঠাপানি এবং নদী ও সাগরের মাছ আসে দ্বীপনগর আড়তে। ওমান, সুদান, জর্ডান, জাপান, চীন এবং ভারত থেকেও সামুদ্রিক মাছ আনা হয়।
মেসার্স ঢাকা গাবতলী ফিশ আড়তের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দৈনিক ৫ টনের মতো মাছ বিক্রি হয়, যার দাম ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার মতো।’ তাঁদের হিমাগারে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২ মাস পর্যন্ত মাছ ঠিক থাকে। প্রয়োজনে তাপমাত্রা আরও কমানো যায় বলে জানান তিনি। তবে আড়তদারদের হিসাবে এসব হিমাগার থেকে দৈনিক ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয়।
৫৫০ টাকা করে বাইম মাছ কেনার পর আদাবর বাজারের একজন পাইকার প্রথম আলোকে জানান, তিনি এই মাছ বিক্রি করবেন ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। পোয়া মাছ কিনেছেন ৩৩০ টাকা কেজি দরে, বেচবেন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। ওই পাইকার আরও জানান, আগে কারওয়ান বাজার থেকে মাছ কিনলেও এখন সুবিধা থাকায় দ্বীপনগরে আসেন। প্রতিদিন পাঙাশ, তেলাপিয়া, রুই মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৫০ থেকে ৭০ কেজি মাছ কেনেন।