অনলাইনে পণ্য বিক্রির কমিশনে ভ্যাট বেড়ে তিন গুণ, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় ছোট উদ্যোক্তারা
Published: 12th, June 2025 GMT
ইন্টারনেট যেন আরও সহজলভ্য হয়—এ রকম প্রত্যাশাই ছিল ই-কমার্সসহ অনলাইনে ব্যবসা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর। এ জন্য তারা আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে ইন্টারনেটের দাম কমানোর দাবি জানিয়েছিল; কিন্তু তাদের সেই আশায় গুড়ে বালি। উল্টে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ অনলাইনে পণ্য বিক্রয় কমিশনের ওপর ভ্যাটের হার ৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রেখেছেন। এতে চিন্তায় পড়েছেন এ খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। ভ্যাট বাড়ানোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় আছেন তাঁরা।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে এখনো বিনিয়োগকারী কম, বাজারও দুর্বল। পাশাপাশি ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগও কম। এ খাতে ভ্যাট বাড়িয়ে সরকার কতটা রাজস্ব পাবে, তা–ও খুব একটা স্পষ্ট নয়। তাঁরা বলেন, বাজেটে বিভিন্ন খাতে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সে তুলনায় এ খাত থেকে খুব নগণ্য অর্থ আদায় হবে। আর লোকসানে চলা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগের টাকা থেকেই বাড়তি ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে।
আগে ই–কমার্স ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্য বিক্রেতারা ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) দিতেন। অর্থাৎ কোনো পণ্য বিক্রি করে ১০০ টাকা মুনাফা হলে ৫ টাকা ভ্যাট দিতে হতো; কিন্তু এখন সেই বিক্রেতাকে ভ্যাট দিতে হবে ১৫ টাকা। তাঁরা বাড়তি ভ্যাটের বোঝা সামলাতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবেন, যা ভোক্তাদেরই দিতে হবে। যেসব প্ল্যাটফর্ম নিজেরা পণ্য সংগ্রহ করে পণ্য বিক্রি করে তারা নিজেরাই ভ্যাট দেবে। অর্থাৎ ভ্যাট বাড়লে এই খাতের উদ্যোক্তা ও ভোক্তা উভয়ের ওপরই প্রভাব পড়বে। তাতে ই-কমার্স ব্যবসার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান চালডালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ওয়াসিম আলিম বলেন, ‘ই-কমার্স এমন কিছু না যে নিজে নিজে সম্প্রসারিত হয়। যেসব দেশ এ খাতে সফল হয়েছে, তারা মাথাপিছু ৭০ থেকে ২০০ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশে সেখানে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র তিন ডলারের কম। এখন সেই ঘাটতি পূরণ করার বদলে আমরা নতুন করে ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছি।’
ওয়াসিম আলিম আরও বলেন, ‘ই-কমার্স একটি শহরের অবকাঠামোর ওপর ২০ শতাংশ পর্যন্ত চাপ কমিয়ে দিতে পারে। চীন ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে; কিন্তু আমরা উল্টো পথে হাঁটছি।’
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্যমতে, দেশে অনলাইন ও ই–কমার্স খাতের বর্তমান বাজারের আকার ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ খাতে ছোট–বড় প্রায় পাঁচ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিক্রেতা রয়েছে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ই–কমার্স প্ল্যাটফর্মের বেশির ভাগ ব্যবসায়ীরই দোকান ভাড়া করে বিক্রির সামর্থ্য নেই। সে জন্য তাঁরা অনলাইনে পণ্য বিক্রি করেন। তাই সরকার বাড়তি ১০ শতাংশ করারোপ করার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এসব নতুন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।
রাইড শেয়ারিং, ডেলিভারি ও কুরিয়ার সেবাদাতা পাঠাওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফাহিম আহমেদ বলেন, ই–কমার্সের মাধ্যমে দেশের অ–প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক ধারায় নিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে, যা ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর আহরণের পথকে সুগম করবে।
ফাহিম আহমেদ বলেন, ‘দেশের জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) অনলাইন ও ই-কমার্স খাতের অবদান মাত্র শূন্য ৩ শতাংশ। এ রকম অবস্থায় ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে এ খাতে বিনিয়োগের গতি সীমিত হবে, যা আমাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে গ্রাহকদের বাড়তি সুবিধা ও মূল্য ছাড় দেওয়ার সুযোগ কমাবে।’
দারাজ বাংলাদেশের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার হাসিনুল কুদ্দুস বলেন, ‘দারাজের ৯৫ শতাংশ বিক্রেতা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই)। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত ভ্যাট তাঁদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়ব। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগও কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।’
অর্ধেকের বেশি মানুষ ই-কমার্স সেবার বাইরে
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের আইসিটির প্রয়োগ ও ব্যবহারবিষয়ক ত্রৈমাসিক জরিপের তথ্য বলছে, স্মার্টফোন ব্যবহারের তুলনায় ইন্টারনেট ব্যবহার খুব বেশি বাড়েনি। গত ডিসেম্বর শেষে দেশের ৫২ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার সরাসরি ইন্টারনেট ব্যবহার করত। এর আগে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শহর-গ্রামনির্বিশেষে পরিবার (খানা) পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর হার ছিল ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের প্রায় অর্ধেক পরিবার সরাসরি ইন্টারনেট সেবার বাইরে রয়েছে।
প্রযুক্তি পণ্য বিক্রির ই-কমার্স পিকাবোর সহপ্রতিষ্ঠাতা মরিন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে অনলাইন ব্যবসার অবকাঠামো, ইন্টারনেটের বাড়তি দাম ও সক্ষমতা নিয়ে নানা ধরনের জটিলতা রয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে এ খাত আরও বড় হবে। তখন এ বাড়তি কর আরোপ করলে সেটা যুক্তিসংগত হতো। এ খাতে আমাদের কর্মসংস্থান গত কয়েক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। তবে বর্তমান উঠতি পর্যায়ে এ খাতে ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ আমাদের জন্য বাড়তি চাপ।’
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই–ক্যাব) প্রশাসক সাঈদ আলী বলেন, দেশের ই–কমার্সের বেশির ভাগই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। তাই বাড়তি ভ্যাটের কারণে প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ফলে রাজস্ব আয় বাড়াতে গিয়ে সরকারকে এর চেয়ে বেশি ভর্তুকি দিতে হতে পারে।
অনলাইনে খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ফুড পান্ডা প্রথম আলোকে জানায়, ‘অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো বিক্রেতাদের কাছ থেকে যে কমিশন নেয় তার ওপর বাড়তি ভ্যাট বসানো হলে আমাদের সেবার খরচ বাড়বে। এতে আমাদের সেবার মূল্য বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপের কারণে পণ্যের মূল্য হঠাৎ বেড়ে গেলে অনলাইন সেবার চাহিদা কমে যেতে পারে। তখন ভোক্তারা অনলাইন সেবার বিকল্প ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকবে। এর প্রভাব পুরো ই-কমার্স ও অনলাইন ডেলিভারি খাতের ওপর পড়বে।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ল য টফর ম ই কম র স ব যবহ র আম দ র ব যবস সরক র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
ড. ইউনূস ও তারেকের বৈঠক জাতির জন্য স্বস্তির বার্তা: ১২ দলীয় জোট
১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক সব আশঙ্কার অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। আগামী রমজানের আগেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে যে ফলপ্রসূ ঐকমত্য হয়েছে, তা অনিশ্চয়তা কাটিয়ে দেশের মানুষের জন্য এনেছে স্বস্তির বার্তা, আশার আলো। শুক্রবার যৌথ বিবৃতিতে এসব কথা বলেন তারা।
নেতারা বলেন, সমগ্র বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সংযোগ ঘটিয়ে এপ্রিল থেকে সরে এসে নির্বাচনের জন্য ফেব্রুয়ারি প্রথমার্ধে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে নির্বাচন আয়োজনে ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
তারা বলেন, আজকের এই বৈঠক যেন শুধু কথার কথা না থাকে, প্রয়োজনীয় সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের এই সৌহার্দ্য ও সহমতের মধ্য দিয়ে জয় হবে গণতন্ত্রের, বাংলাদেশের, জনগণের।
বিবৃতিতে সই করেন- ১২ দলীয় জোট প্রধান ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, এলডিপির চেয়ারম্যান ও জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম, জোটের সমন্বয়ক বজাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, জমিয়াতে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মুফতি গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপার) স-সভাপতি রাশেদ প্রধান, ন্যাশনাল লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ফারুক রহমান, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন পারভেজ, ইসলামী ঐক্য জোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুর রাকিব, ইসলামিক পার্টির মহাসচিব আবুল কাশেম, প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দল (পিএনপি) চেয়ারম্যান ফিরোজ মো. লিটন ও নয়া গণতান্ত্রিক পার্টির সভাপতি এম এ মান্নান।