১ নভেম্বর ২০১৮। টার্কিশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইটটি ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ছাড়ল ভোর ৫টায়। বিমান থেকে অবতরণের সময় ওপর থেকে ও ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে বসা অবস্থায় স্বচ্ছ কাচে নাক লাগিয়ে দেখলাম বসফরাস প্রণালির জলে অজস্র জলযান। কিছু স্থির, কিছু চলমান। এই প্রণালিতে সন্ধ্যাকালে নৌভ্রমণের কাহিনি পড়েছি প্রিয় লেখক ওরহান পামুকের লেখায়। বিমানে, এমনকি ট্রানজিটে বসে পড়তে লাগলাম সেই বহুল আলোচিত বইটি ‘ইস্তাম্বুল: একটি শহরের স্মৃতিকথা’।
তারপর সুইডেনগামী বিমানে আবার উড়াল শুরু। রোমাঞ্চকর সময় পার করেছি ওই ফ্লাইটে। জানালার পাশে সিট হওয়ায় বাইরে তাকিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম, তা অতুলনীয়। অ্যারাবিয়ান নাইটসে এমন কিছু কৃত্রিম দৃশ্য সংযুক্ত থাকত। বিশাল বিশাল তুলার স্তূপ এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সাজানো। স্বর্গীয় দৃশ্য অবলোকনের আনন্দে মন নেচে উঠল ময়ূরের মতো।
স্টকহোম বিমানবন্দর থেকে ট্রেনে চেপে বসলাম মূল শহরের উদ্দেশ্যে। পৌঁছার পর অপেক্ষায় থাকা আয়োজক কোম্পানির তিনজন–গানার, পিটার ও বেকহাম আমাদের স্বাগত জানিয়ে হোটেলে নিয়ে এলো। বিদায়ের সময় তারা জানিয়ে গেল, আগামীকাল দুপুরের পর আমাদের নিয়ে বের হবে নৌভ্রমণে; রাতে হবে নৈশপার্টি। পরদিন থেকে ট্রেনিং শুরু হবে। সেদিন সকালটা আমরা আমাদের মতো করে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরলাম। শিডিউল অনুযায়ী দুপুর ২টায় তাদের একজন হোটেল লবিতে চলে আসে। প্রথমে সে আমাদের নিয়ে যায় নিকটবর্তী বালটিক সাগরের একটি ঘাটে, সেখানে আগে থেকে চারজন ছিল, যারা ভ্রমণের জন্য একটি দোতলা বোট ঠিক করে রেখেছিল। ঘাটে অপেক্ষার সময় গানার বললো, সাত দিন বাদে আজ একটু সূর্য দেখলাম।
বলা বাহুল্য, স্টকহোম শহরটি বালটিক সাগরের তীরঘেঁষে। বালটিক সাগরকে আটলান্টিক মহাসাগরের একটি শাখা বলা যায়। এটিকে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে নর্ডিক দেশ ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, সুইডেনসহ বালটিক দেশ লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া। তাছাড়া জার্মানি, পোল্যান্ড, রাশিয়াসহ মধ্য ইউরোপের বিস্তীর্ণ সমভূমি এই সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। মূলত সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম শহরটির সঙ্গে বালটিক সাগরের অসংখ্য দ্বীপ যুক্ত হয়ে নির্মাণ করেছে এক বৃহৎ দ্বীপপুঞ্জ।
বোটের মধ্যেই মধ্যাহ্নভোজের চমৎকার ব্যবস্থা ছিল। ডাইনিং টেবিলের চারপাশ ঘিরে বসে সুইডিশ ম্যানু খেতে বেশ লাগল। মসলাবিহীন আধা সেদ্ধ সবজির আইটেম অসাধারণ। সামুদ্রিক মাছ আর মাংস তো ছিলই। বোটের দেয়ালে টাঙানো সুইডিশ শিল্পীদের চিত্রকর্ম তাদের অপার রুচিশীলতার পরিচায়ক। আয়োজক প্রতিষ্ঠানের মূল কর্ণধার গানার। গানারের সঙ্গে বোটে অনেক বিষয়ে আলাপ হয়। সত্তরোর্ধ্ব গানার খুব বন্ধুবৎসল ও আমোদপ্রিয়। আমাদের বেশির ভাগ আলাপ ছিল ফরাসিতে। মাঝে মাঝে ইংরেজিতে। গানার দুর্দান্ত ফরাসি জানে। ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ফরাসি ভাষা শেখাটা যেন আশীর্বাদ হয়ে এলো। এভাবে আমার সঙ্গে তার একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
বোটযাত্রা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জমে উঠল আড্ডা। কথা প্রসঙ্গে গানার জানায়, তাদের জীবনে ধর্মের কোনো স্থান নেই। গির্জায় মানুষ ‘রোববারে’ও যায় না। গানার আরও যোগ করে, একসময় রাজা আর পাদ্রিরা মিলে সমাজ শাসন করত। সবকিছুই ছিল গির্জা নিয়ন্ত্রিত। নির্দেশ অমান্য করলে রাজার সহযোগিতায় জনসাধারণকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হতো। এক পর্যায়ে সাধারণ মানুষ বিদ্রোহ শুরু করে। নিধর্মী হলেও সুইডেনে তেমন কোনো অপরাধ নেই। অপরাধীর অভাবে কারাগারগুলো গির্জার মতোই প্রায় বন্ধ।
পিটারের কাছে পেলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য। যদিও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ও সন্তানের বিষয়টি আগেই জানা ছিল, সরাসরি একজন নেটিভের কাছে তার বাস্তবতা ও কারণ জানতে পেরে বেশ অবাক হলাম। আমরা তখন বোটের বাইরে দ্বিতীয় তলায় রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করতে করতে আলাপে মত্ত ছিলাম। পিটারের তিন ছেলেমেয়ে। বিয়ে করেছ তোমরা? প্রশ্ন করতেই সে জানাল তাদের এখানে বেশির ভাগ মানুষ বিয়ে করে না। ঝামেলা এড়াতে তারা বিয়ের ব্যাপারে অনাগ্রহী।
পিটারের আবাস শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে। পিটারের মতো অফিসের জন্য শহরের বাইরে থেকে সবাই আসে বলে রাস্তাঘাটে জনমানুষের চাপও নেই। ফলে শহরের কেন্দ্রস্থলে কোনো ব্যক্তিগত যান চোখে পড়ে না।
সুইডেনে শিশুদের সর্বত্রই অগ্রাধিকার। সন্তানের দেখাশোনার জন্য মা-বাবা সরকার থেকে ভাতা পান। শিশু অসুস্থ থাকলে মা-বাবা দু’জনই অসংখ্য দিন বেতনসহ ছুটি কাটাতে পারেন। তারা মনে করে শিশু রাষ্ট্রের সন্তান, পিতামাতা কেবল লালনপালনকারী।
স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েদের সুইডিশ ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিও শেখানো হয়। নিজেদের মধ্যে সুইডিশ ভাষায় কথা বললেও বিদেশিদের সঙ্গে সাবলীল ও শুদ্ধ উচ্চারণে ইংরেজিতে কথা বলে তারা। একইসঙ্গে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষা চর্চায় রাখা বাধ্যতামূলক।
সুইডেনের মতো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কল্যাণমূলক (ওয়েলফেয়ার) দেশগুলোতে কর্মঘণ্টা অনুযায়ী মানুষের আয়ের একটা সীমা দেওয়া থাকে। ইচ্ছে করলেও তারা অতিরিক্ত আয় করতে পারে না। ওই সীমিত আয় দিয়ে তাদের সারা মাসের খরচ সুন্দরভাবে চলে যায়। ব্যবসা করলে বণ্টিত মুনাফার ওপর করের হার অনেক বেশি। কেবল ব্যবসায় সম্প্রসারণের জন্য মুনাফা মালিকপক্ষের মধ্যে বণ্টন না করে পুনর্বিনিয়োগ করলে কর-সুবিধা পাওয়া যায়।
কখনও গানারের সঙ্গে, কখনও পিটারের সঙ্গে আলাপ চলতে থাকে। তারা তথ্য দিয়ে আমার কৌতূহল নিবারণ করে। মাঝে মাঝে আড্ডায় যুক্ত হয় গানারের সহকর্মী ত্রিনিদাদের মেয়ে মেলিন্ডা। পিতৃভূমি ত্রিনিদাদ শুনে মেলিন্ডাকে যখন ভিএস নাইপলের কথা বললাম, সে চিনতে পারল। বুঝতে পারলাম, সে মোটামুটি সাহিত্যের খবর রাখে। তবে সিরিয়াস পাঠক নয়। উপমহাদেশের কোনো লেখকের নাম জানে কিনা জিজ্ঞেস করতে সে বলল, টেগোরের কিছু লেখার অনুবাদ পড়েছি ইংরেজিতে। এটিও জানি তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। পুরস্কারটি নিতে টেগোর স্টকহোমে এসেছিলেন।
সন্ধ্যার আধো আলো আধো অন্ধকারে দূরের ছোট দ্বীপগুলোকে রূপকথার দেশ মনে হয়। সেখানে ধনী ব্যক্তিরা চাইলেই গোটা দ্বীপ কিনে দ্বীপের একদম ওপরে ঘর নির্মাণ করে বসবাস করার সুযোগ পায়। বোট থেকে আলোকময় ঘরগুলোর দৃশ্য বড় মনোরম। মনে পড়ে প্রাচীন বাংলাসাহিত্যের চর্যাপদের পদ–টিলার ওপর ঘর/ নিত্য অতিথি আসে/ হাঁড়িতে ভাত নেই।
সন্ধ্যার অনেক পর বোট থেকে নামলাম। হাঁটা ছাড়া গত্যন্তর নেই। খেয়াল করলাম, প্রায় সবার হাতেই সিগারেট। নারী-পুরুষের বালাই নেই। আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় বারে। সন্ধ্যার পর এসব বারে যাওয়া ওদের নিত্যদিনের অভ্যাস। আবহাওয়াজনিত কারণে এই অভ্যাস গড়ে উঠেছে। তারপর গন্তব্য পার্শ্ববর্তী ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমরা পৌঁছে গেলাম সেখানে। v
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আম দ র র জন য র সময় শহর র র একট
এছাড়াও পড়ুন:
তুলশীগঙ্গার তীরে সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ির মেলা
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রাম ঘেঁষে তুলশীগঙ্গা নদীর অদূরে সন্ন্যাসতলীর বটতলা। জায়গাটিতে প্রায় একশ বছর আগে থেকে বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শুক্রবার আয়োজন হয় ঘুড়ির মেলা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অন্তত ৫০ গ্রামের হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে শুক্রবার সন্ন্যাসতলী ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মেলার দিনক্ষণ মনে রেখে সময়মতো দোকানিদের পাশাপাশি দর্শনার্থীরা ভিড় জমান নিভৃত পল্লীতে। আগে মেলার দিন বৃষ্টি হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। প্রচণ্ড গরম ও তাপপ্রবাহের মধ্যেই চলে এ আয়োজন। বৈরী পরিবেশের কারণে উৎসবের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, সন্ন্যাসতলীর এ ঘুড়ি উৎসব শুরুর দিন বিকেলে বটতলায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় সন্ন্যাস পূজা পালন করেন। তাদের এ পূজা-অর্চনা ঘিরেই মূলত এ মেলার উৎপত্তি। তবে শুরুর কথা কেউ বলতে পারেননি। প্রবীণরা শুধু জানেন, একশ বছরের বেশি সময় ধরে তারা এ মেলার আয়োজন দেখে আসছেন।
মেলার নিজস্ব জায়গা না থাকলেও এর ব্যাপ্তি প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই এক দিনের এ মেলা ঘিরেই জেলার জামালগঞ্জ চারমাথা থেকে ঐতিহাসিক আছরাঙ্গাদীঘি পর্যন্ত রকমারি পণ্যের দোকান বসে। এখান থেকে সংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আসবাব থেকে শুরু করে ছোট মাছ ধরার বাঁশের তৈরি পণ্য খলসানি, টোপা, ডালা, চালুন কিনে নেন অনেকে।
সুতার তৈরি তৌরা জাল, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, মিষ্টান্ন, প্রসাধনী, মাটির তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলার ব্যবস্থাও। আর মেলার বড় আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো ও বিক্রি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন ঘুড়ি বিক্রি করতে।
প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি তেমন হাওয়া-বাতাস না থাকায় এবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা সেভাবে জমে ওঠেনি। তবে ঘুড়ি বেচাকেনা ও শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। এ উপলক্ষে আসা হাজার হাজার দর্শনার্থীর নিরাপত্তার জন্য মেলায় সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল ছিল।
আদমদীঘির শিববাটি গ্রামের ঘুড়ি ব্যবসায়ী সালাম হোসেনের ভাষ্য, সন্ন্যাসতলীর মেলা বড় হওয়ায় তিনি এসেছেন ঘুড়ি বিক্রির জন্য। মেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘুড়ি বিক্রি করতে পেরে তিনি খুশি। জয়পুরহাটের পার্বতীপুর এলাকার ঘুড়ি ব্যবসায়ী মফিজ উদ্দিন ও মজনু সরদার বলেন, পূর্বপুরুষের আমল থেকে এ মেলার কথা শুনে আসছেন তারা।
মেলা উদযাপন ও পূজা কমিটির সদস্য মহব্বতপুর গ্রামের মন্টু মণ্ডল বলেন, মেলাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও এটি আসলে সব ধর্মালম্বীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন হোসেনের ভাষ্য, এক দিনের আয়োজনে যে এত লোকের সমাগম হতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মেলায় যেন অনৈতিক কর্মকাণ্ড না হয়, সে ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ক্ষেতলাল থানার ওসি মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন সতর্ক আছে। মেলায় অনৈতিক আচরণ লক্ষ্য করা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।