বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন অভিযোগ করে বলেছেন, ‌‘সরকার বিভিন্ন উপায়ে পরিকল্পিতভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সেবায় বাধা সৃষ্টি করছে। আমরা নগরবাসীকে সেবা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অথচ সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে সেবায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে এবং দায়ভার আমাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে।’ বুধবার নগর ভবনে কর্মচারী ও ‘আমরা ঢাকাবাসী’র চলমান আন্দোলনে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘আন্দোলন চলমান থাকা অবস্থাতেও আমরা জরুরি সেবা চালু রেখেছি। কিন্তু সরকার থেকে‌ বিশেষ করে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের কাজ করতে নিষেধ করেছেন বলে শুনতে পেয়েছি।’

ইশরাক হোসেন বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) জানতে পেরেছি, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা ও সচিব আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তারা জন্ম নিবন্ধন বা নাগরিক সনদে স্বাক্ষর না করেন। একটা ন্যক্কারজনক কাজ করতে চাচ্ছে। তারা চাচ্ছে, সেবায় বিঘ্ন ঘটিয়ে আমাদের ওপর দায় চাপাতে।’

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘গতকাল আসিফ মাহমুদ বলেছেন, আমি নাকি আইন লঙ্ঘন করেছি এবং ফৌজদারি অপরাধ করেছি। আমি তাঁকে বলতে চাই, আমি যদি অপরাধই করে থাকি তাহলে আপনারা সরকারে থেকেও কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করছেন না।’

তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কেন নির্দেশ দিচ্ছেন না আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমরা এসব ভয় পাই না। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৭ বছর আমরা যুদ্ধ করেছি, জেল খেটেছি, গুম হয়েছি। যত ধরনের নির্যাতন আছে সহ্য করে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছি।’

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে ইঙ্গিত করে ইশরাক বলেন, ‘আজকে যা কিছু হচ্ছে সবকিছুর জন্যই বর্তমান সরকার দায়ী। সরকার লোকজন দিয়ে এসব কথা বলাচ্ছে এবং আমাদের হেয়প্রতিপন্ন ও খাটো করার চেষ্টা করছে।’
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব এনপ ইশর ক হ স ন ড এসস স আম দ র ইশর ক সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

মুক্তির প্রাথমিক শর্ত বৈষম্যের অবসান

জল ও পানির বিরোধের খবর তো আমরা জানিই। জিনিসটা একই। একই কল থেকে পাওয়া যাচ্ছে, একইভাবে তৃষ্ণা নিবারণ করছে। কিন্তু হিন্দু বলছে, সে জল পান করছে; মুসলমান বলছে, সে পান করছে পানি। এ নিয়ে ভীষণ গোলযোগ ছিল। অথচ ‘জলপানি’ পেতে হিন্দু-মুসলমান কোনো ছাত্রেরই আপত্তি ছিল না। আপত্তি থাকবে কেন? ওটা তো পুরস্কার, তাতে জল ও পানি মেশামেশি করে থাকলে অসুবিধাটা কোথায়? জলখাবারও ঠিকই চলত। পানিফল পেলে কেউ যে নামের কারণে তা ফেলে দিত, এমন মোটেই নয়।

সাধারণ মানুষ জল ও পানির পার্থক্য নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাত না; তারা জিনিসটা পেলেই খুশি থাকত। কিন্তু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ নিয়েই যত মুশকিল ছিল। তারা ভাষার ওই পার্থক্যকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চিহ্নগুলোর একটি হিসেবে আঁকড়ে ধরেছিল। সাম্প্রদায়িকতা জনগণের ব্যাপার ছিল না। ছিল দুই দিকের দুই মধ্যবিত্তের। তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে ঝগড়া-ফ্যাসাদ বাধিয়ে এমন ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি করল; অখণ্ড ভূমিকে দুই টুকরো করা ছাড়া গত্যন্তর রইল না। তাতে প্রকৃতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সব কিছুরই ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে ভাষা বিকাশেরও।

বাংলা প্রাকৃত ভাষা। প্রাকৃতজনের ভাষা। তারাই একে রক্ষা করেছে। শাসক শ্রেণির অবজ্ঞা ও উন্নাসিকতা ছিল; কিন্তু তারা ধ্বংস করতে পারেনি জনগণের ভাষাকে। বাংলা ভাষা রয়েই গেছে। ওই যে দুই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তাতে বাংলা ভাষার ওপর যে চাপটা পড়েছে, সেটা সামান্য নয়। হিন্দু মধ্যবিত্ত মুসলিম মধ্যবিত্তের তুলনায় এগিয়ে ছিল। এক সময়ে ফার্সি ছিল রাজভাষা; তখনকার অভিজাত শ্রেণি ওই ভাষা রপ্ত করেছে নিজেদের আভিজাত্যের অনুরোধে ও স্বার্থে। হিন্দুরাও ফার্সি শিখেছে। রাজা রামমোহন রায় চমৎকার ফার্সি জানতেন। যখন ইংরেজ এলো তখন ফার্সির জায়গায় ইংরেজি হলো রাষ্ট্রভাষা। হিন্দু অভিজাত শ্রেণি ইংরেজি শিখে নিয়েছে; মুসলমানরা সেভাবে শিখতে পারেনি। কিছুটা ছিল অভিমান, কিছুটা অর্থনৈতিক দুর্বলতা, যে জন্য তারা পিছিয়ে পড়ল। হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণিও গড়ে উঠল শিক্ষা, পেশা এবং বিশেষভাবে জমিদারি ব্যবস্থার কারণে। আধুনিক বাংলা গদ্য এই মধ্যবিত্তের হাতেই তৈরি। এরা সংস্কৃত জানতেন এবং ধর্মীয় কারণে সংস্কৃতের প্রতিই তাদের টানটা ছিল অধিক ও স্বাভাবিক। তাই তাদের হাতে যে গদ্য তৈরি হলো, তাতে আধিপত্য থাকল সংস্কৃতের। ফলে ভাষার মধ্যে একটা কৃত্রিমতা চলে এলো।

পরে মুসলিম মধ্যবিত্ত নিজেকে গড়ে তুলেছে। তারা এসে দেখে, তারা যে ধরনের ফার্সি-আরবি ও দেশীয় শব্দ ব্যবহার করতে অভ্যস্ত, বাংলা গদ্যে সেগুলোর স্থান হয় সংকুচিত নয়তো অবলুপ্ত। তাদের অভিমানে লাগল। তাদের একাংশ বাংলা ভাষাতে তথাকথিত মুসলমানি শব্দ কীভাবে প্রয়োগ করা যায়, সে ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে পড়ল।

এই উৎসাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে উৎকট আকার ধারণ করেছিল। তখন কেবল যে আরবি-ফার্সি শব্দ বাড়াবার চেষ্টা হয়েছে, তা নয়। আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেওয়া; নজরুলকে সংশোধন করার চেষ্টা যে হয়নি, তা-ও নয়। সর্বোপরি ছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ভয়াবহ সিদ্ধান্ত। পূর্ববঙ্গ বিদ্রোহ করেছে, স্বভাবতই।

বিদ্রোহী পূর্ববঙ্গ শেষ পর্যন্ত স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু এখনকার অবস্থাটা কী? ভাষার কাছ থেকে কোন খবরটা পাওয়া যাচ্ছে? সাহিত্যকে আমরা দর্পণ বলি। বলি সমাজ ও সংস্কৃতির দর্পণ। কিন্তু ভাষার ব্যবহারেও ছবি পাওয়া যায় বৈ কি– সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের ছবি। বলা বাহুল্য, ওই ছবি তৃপ্তিকর নয়। ওখানে এমন খবর মোটেই পাওয়া যাচ্ছে না যে, আমরা প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীন হয়েছি।

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই– বাঙালি মধ্যবিত্তের কারণেই বাংলা ভাষার এতটা উন্নতি ঘটেছে। সাহিত্য, সাংবাদিকতা, ব্যবহারিক জীবন– সর্বত্র বাংলা ভাষা আজ ব্যবহৃত ও সমৃদ্ধ। আমাদের সাহিত্যের সাধারণ অর্জনও সামান্য না মোটেই। কিন্তু এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি এটা মনেপ্রাণে চায়নি যে, সাধারণ মানুষ শিক্ষিত হোক। সবাই যদি শিক্ষিত হয় তাহলে মধ্যবিত্তের অহংকারের জায়গাটা বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। ভয় ছিল সেটাই, যদিও প্রকাশ্যে সে তা স্বীকার করেনি। এ দেশে শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি। সমষ্টিগত উন্নতিকে প্রধান বিবেচ্য করা হয়নি। হয়নি যে, তার কারণ ওই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশ উচ্চবিত্ত হয়ে গেছে। তারাই এখন দেশের শাসক। তারাই শাসন করে নানা নাম নিয়ে। এই শাসক শ্রেণি জনগণের সম্পদ ও অর্জনগুলোকে লুণ্ঠন করছে এবং তাদের যে রাজনীতি, সেটি ওই লুণ্ঠনের প্রতিযোগিতার বাইরে অন্য কিছু নয়। জনগণ থেকে এরা যে দূরবর্তী, তার নানা প্রাচীর, প্রকরণ ও চিহ্ন সাড়ম্বরে তুলে ধরে। এগুলোর মধ্যে ভাষাও একটি। এই ব্যাপারে আগেকার শাসকদের থেকে বর্তমান শাসকদের আচরণে কোনো পার্থক্য নেই। বিদেশি শাসকরা যেমন বাংলা ব্যবহার করত না; বাংলাদেশের শাসক শ্রেণিও পারলে সেই কাজই করে। অন্তত চেষ্টা যে করে, তা নিয়ে তো সন্দেহ করার সুযোগ নেই।

এই শ্রেণির সন্তানেরা ইংরেজির মাধ্যমে পড়াশোনা করে। অনেকেই বিদেশে চলে যায়। সম্পত্তিবানেরা সম্পত্তির প্রাচুর্যের অনুপাতে বিদেশ ভ্রমণ করে। পরিবারের একাংশ সেখানেই থাকে। দেশে যে থাকে তা অনেকটা বিদেশিদের মতোই। পণ্য, আসবাব, পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবনযাত্রার ধরনে বাঙালিত্বের বড়ই অভাব। ওদের স্মার্টফোন, ই-মেইল, ইন্টারনেট, সিডি– সর্বত্র ইংরেজির একচেটিয়া রাজত্ব। সবচেয়ে উৎকট হচ্ছে মুখের ভাষা। বাংলা বলে ইংরেজি মিশিয়ে।

ওদিকে স্মার্টফোন, টেলিভিশনের কারণে বই পড়ার অভ্যাস কমছে। ওই অভ্যাস অবশ্য কখনোই উল্লেখযোগ্য ছিল না। অধিকাংশ বাঙালিই ছিল অক্ষরজ্ঞানবঞ্চিত। এখন শিক্ষিতের হার বেড়েছে, কিন্তু পাঠাভ্যাস সে তুলনায় বৃদ্ধি পায়নি। আমাদের সংস্কৃতিতে দেখতে পাই যে, পড়ালেখার তুলনায় স্মৃতি ও শ্রুতির ওপরই জোরটা ছিল বেশি।

আগের কালের মানুষ স্মৃতির ওপরই নির্ভর করতে চাইতেন। শোনা কথার জোর ছিল; যে কারণে গুজব ও পরনিন্দার চর্চা ছিল প্রায় সর্বজনীন। মুখস্থ বিদ্যা ছিল সর্বোচ্চ বিদ্যা। পরে ‘পড়ালেখার’ চল বেড়েছে। এখানেও দেখা যাচ্ছে, বাঙালি পড়েছে যত, লিখেছে সে তুলনায় অনেক কম। আমরা শুনেছি এমন গুরুজনীয় পরামর্শ– একবার লেখা দশবার পড়ার সমান। পরামর্শটা যে ভিত্তিহীন ছিল, তাও নয়। তবু লেখার ব্যাপারে বাঙালি তেমন এগোয়নি। তার জীবনে কাগজের ব্যবহার ছিল নগণ্য।

বাংলা ভাষা যে বাংলাদেশে ভালো অবস্থায় নেই, তার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়– বাংলাদেশ এখন প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীন হয়নি। মুক্তির জন্য সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দরকার হবে, যা সকল প্রকার বৈষম্যের অবসান ঘটাবে। এর জন্য প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন। যে আন্দোলন সমাজকে মুক্ত করবে; মুক্ত করবে সমাজের মানুষকে। তখন আমরা স্বাভাবিক হবো।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ